বিশ্বজয়ের ইতিহাসে পৃথিবী দাঁপিয়ে বেড়ানো যোদ্ধাদের কথা উঠলে সুপরিচিত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট কিংবা চেঙ্গিস খানের কথাই আমাদের মনে পড়ে। এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্রাট বাবরের নামও সাধারণ মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। অথচ চেঙ্গিস খানেরই বংশধর এবং বাবরের পূর্বসূরিদের মধ্যেই একজন বিশ্ববিজেতার কথা ইতিহাসের আলোচনায় কখনোই খুব বেশি উঠে আসে না। তিনি হলেন তৈমুরীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা তৈমুর লং। হ্যাঁ, ১৪ শতকের সেই দিগ্বীজয়ী তৈমুর লং বা তৈমুর বেগের কথাই বলছি, যিনি মঙ্গোল বংশের সাধারণ একজন সেনাধ্যক্ষ থেকে নিজের যাত্রা শুরু করে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন সমগ্র বিশ্বে, হয়ে উঠেছিলেন ভয়ঙ্কর ক্ষমতাবান এক শাসক।
‘তৈমুর’ শব্দের অর্থ ‘লোহা’। লোহার মতোই শক্ত ছিলো তৈমুর বেগের হৃদয়। তার পুরো নাম তৈমুর বিন তারাগাই বার্লুস। ১৩৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ দুরন্ত, সাহসী ও বদমেজাজি ছিলেন তৈমুর। তৈমুর থেকে তৈমুর লং হয়ে ওঠার গল্পটাও কিন্তু একেবারেই আলাদা। তার নেতৃত্বে কিশোর বয়সেই গড়ে ওঠে এক ডাকাত দল। বলা হয়ে থাকে ডাকাতি করতে গিয়েই তীরের আঘাতে একটি পা অকেজো হয়ে যায় তার। সেই থেকেই তিনি হয়ে যান খোঁড়া তৈমুর বা তৈমুর লং।
পা খোঁড়া হয়ে গেলেও তৈমুরের জেদ কিংবা আত্মবিশ্বাস কোনো দিন এক বিন্দুও কমে নি। নিজের এই অক্ষমতা নিয়েই যুদ্ধ ও অস্ত্র পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। তার আগ্রাসী মনোভাব সব সময় যে কোনো কিছুর ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পেয়েছে। চেঙ্গিস খান ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। তিনিও চেঙ্গিস খানের মতো বিশ্ব জয় করতে চেয়েছিলেন এবং সফলো হয়েছিলেন।
তুঘলক তিমুর যেদিন তাকে বারালাসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন, সেদিন থেকেই তুঘলক তিমুরকেই ক্ষমতাচ্যুত করবার পরিকল্পনা করতে থাকেন তৈমুর লং। তবে একটা পর্যায়ে তৈমুর লং এর এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় তুঘলক তিমুরের কাছে। তাই তুঘলক তিমুরের প্রতিদ্বন্দ্বী আমীর হোসেনের বোনকে বিয়ে করে আমীর হোসেনের সহায়তায় প্রথমে তুঘলক তিমুরকে অপসারণ করেন তৈমুর। এর পর যৌথ শাসনের অন্তর্ভুক্তি হতে আমীর হোসেনকেও অপসারণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে তার স্ত্রী মারা গেলে তৈমুর সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে যান। আত্মীয়তার বন্ধন আর না থাকায় নির্দ্বিধায় তিনি হত্যা করেন আমীর হোসেনকে এবং মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তৈমুর লং। এটি ছিলো তৈমুর লং এর সফলতার প্রথম ধাপ মাত্র। এই আগ্রাসনের শেষটা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।
চেঙ্গিস খানের পদাঙ্ক তৈমুরকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করতো। মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসার পর পরই বিশ্ব জয়ে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। প্রথমে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং তকতামিশ খানকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে পারস্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
নিষ্ঠুরতায় তৈমুরের কোনো জুড়ি ছিলো না। তার পারস্য আগ্রাসনের প্রথম ধাপই ছিলো হেরাত নগরীতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা। তৈমুরের নিষ্ঠুরতার কাছে শেষ পর্যন্ত ১৩৮৩ সালে বশ্যতা মেনে নেয় হেরাত নগরী। হেরাত নগরীর পতনের পর তৈমুরের বর্বরতার গল্প পারস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। এর ফলে তেহরানসহ বেশ কিছু অঞ্চল এমনিতেই তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। তবে কিছু কিছু অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু তৈমুরের জন্য তো এসব বিদ্রোহ দমন করা ছিলো বাম হাতের খেলা। আবারও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আফগানিস্তানসহ অনেকগুলো অঞ্চলের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেন তিনি। গল্প আছে, আফগানিস্তানের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একের পর এক বসিয়ে ইস্পাহান শহরে একটি মিনার নির্মাণ করিয়েছিলেন তৈমুর। ক্রমাগত নিষ্ঠুর আগ্রাসনে ১৩৮৫ সালের মধ্যেই সম্পূর্ণ পারস্য হাতের মুঠোয় চলে আসে তৈমুরের।
এরই মধ্যে রাশিয়ার ক্ষমতা দিয়ে আসা তকতামিশ খান ধোঁকাবাজি করেন তৈমুরের সাথে। তৈমুরের মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে বসেন তিনি। কিন্তু তৈমুরকে পরাস্ত করা কি এতোই সোজা! কয়েক দফা যুদ্ধে বার বার শেষ পর্যন্ত তকতামিশ খানকেই পরাজিত হতে হয়েছে তৈমুরের কাছে। কেননা তৈমুর যেখানে হানা দেন, সেখানে আগুন ও রক্তের লাল রঙে ছেয়ে যায় আকাশ, হাহাকার ও আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস।
১৩৯৫ সালে মস্কো দখলের পর পরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তৈমুর, এবার যেতে হবে ভারতবর্ষে। ১৩৮৮ সালে ভারতবর্ষের সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর ক্ষমতার অন্তঃর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভারতবর্ষের এই অস্থিতিশীলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ভারতবর্ষ জয়ের উদ্দেশ্যে ১৩৯৮ সালে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন তৈমুর লং। দিল্লির সুলতান তখন নাসির উদ্দিন শাহ তুঘলক। দিল্লিতে পৌঁছানোর আগেই প্রায় এক লক্ষ সাধারণ ভারতীয়কে হত্যা করেন তৈমুর। তার নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ভারতবর্ষের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে।
সুলতান নাসির উদ্দিন শাহের বিশাল বিশাল যুদ্ধ হাতি থাকা সত্ত্বেও বেপরোয়া তৈমুরের সামনে শেষ পর্যন্ত টিকে নি প্রতিরোধ। উটের পিঠে খড়ের গাঁদা বোঝাই করে তাতে আগুন ধরিয়ে হস্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দিতেই আগুনের ভয়ে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করলো বিশালকায় হাতির দল। ফলে নিজের হস্তিবাহিনীর কারণেই পরাজিত সুলতানকে তৈমুরের হাতে ছেড়ে দিতে হলো দিল্লি তথা ভারতবর্ষ। তৈমুরের তান্ডবে দিল্লির আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। লাশের বন্যা বয়ে গেলো।
তৈমুরের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত নিস্তার পায় নি তৎকালীন সবচেয়ে শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যও। অটোমান সুলতান বায়েজিদ তৈমুরের আগ্রাসনের সামনে হার মানতে বাধ্য হন। আর অটোমান সাম্রাজ্য দখলের পর মিশরসহ আরও বহু রাষ্ট্র সহজেই তৈমুরের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর অধিপতিতে পরিণত হন তৈমুর লং।
তৈমুরের সবচেয়ে প্রিয় স্থান ছিলো সমরখন্দ নগরী। এই নগরীকে এক কালে চেঙ্গিস খান ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তৈমুর লং একে নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন অনন্য রূপ। সমরখন্দই ছিলো তৈমুরের রাজধানী ও তার শাসনের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
ইউরোপ দখল তৈমুরের জন্য ভীষণ সহজ হতো। কিন্তু ইউরোপকে দরিদ্র ভূখণ্ড হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন তৈমুর। তিনি ইউরোপ জয়ের তুলনায় ধনী রাষ্ট্র চীন দখল করাকে বেশি গৌরবের মনে করেছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে চীনের উদ্দেশ্যে রওনাও হয়েছিলেন তৈমুর।
১৪০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রারত তৈমুর লং কাজাখাস্তানের তীব্র শীতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার সমাধিক্ষেত্রের নাম ‘গুর-ই-আমীর’। প্রিয় রাজধানী সমরখন্দই হয় তৈমুরের শেষ আশ্রয়স্থল। তবে মৃত্যুও তৈমুরের নিষ্ঠুর সত্ত্বাকে ধ্বংস করতে পারে নি। তার সমাধিতে লেখা হয়েছে, “যে আমার কবর খনন করবে, সে আমার চেয়েও ভয়াবহ এক শাসককে জাগিয়ে তুলবে এবং আমি যে দিন ফের জেগে উঠবো, সে দিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে”। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তৈমুরের কবরও যেনো একটি অভিশাপ হয়েই জেগে আছে চিরকালের জন্য।
১৯৪১ সালে রাশিয়ান ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা জোসেফ ভিসারিওভিচ স্টালিন তৈমুর লং এর কঙ্কাল পরীক্ষার জন্য তার লাশটিকে কবর থেকে উত্তোলন করান। ঠিক যেনো সেই মুহূর্ত থেকেই তৈমুরের কবরের লেখাটি সত্যি হয়ে ওঠে। আরেক নিষ্ঠুর শাসক হিটলারের ‘অপারেশন বার্বারোসা’-য় নির্বিচারে মারা পড়তে থাকে লাখ লাখ রাশিয়ান।
১৯৪২ সালে আবারও অভিশপ্ত এই লাশটিকে কবরস্থ করা হলে হিটলারের সুদিন শেষ হয়ে যায়। হিটলারের বিরুদ্ধে জয় লাভ করতে থাকে সোভিয়েত রাশিয়া এবং সে দিন থেকে হিটলার আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন নি। পোল্যান্ডে রেড আর্মির বিপরীতে হিটলারের নাজি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় বরণ করে নিতে হয়।
পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ হত্যাকারী তৈমুর লং দিগ্বীজয়ের ইতিহাসে উপেক্ষা করবার মতো কোনো নাম নয়। ইতিহাস ইতিবাচক হোক, কিংবা নেতিবাচক, সত্যিকার বাস্তবতা থেকে সব সময়ই শিক্ষণীয় অনেক কিছুই থাকে। তাই উপেক্ষা নয়, ইতিহাসের সঠিক আলোচনার মাধ্যমে অতীত ঘটনাবলিকে উন্মোচন করাই আমাদের দায়িত্ব।
রেফারেন্সঃ