খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে বাংলাদেশে মৌর্যরা আসার পর থেকে আর্যভাষা এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং এরপর প্রায় এক হাজার বছর পরে  প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়। চর্যাপদ বা চর্যাগীতি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। সাধারন মানুষের ভাষার সাথে আর্যদের ভাষা মিলে-মিশে বাংলা স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তারই একমাত্র নমুনা হিসেবে চর্যাগীতিকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই ভাষার কাঠামো চর্যাগীতির আদলে প্রকাশ পেয়েছিল খ্রিষ্টীয় ৫০০-৬০০ অব্দের দিকে। চর্যাগীতিতে ব্যবহার করা উপমাগুলি তখনকার বাংলার সমাজজীবন, পরিবার জীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগ্রহ করা। চর্যাপদ খ্রিস্টীয় দশ থেকে বারো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে রচিত হয়েছিল। চর্যার শীর্ষ কবিরা ছিলেন—লুইপা,কাহ্নপা, ভুসুকুপা, শবরপা, পদগুলির পদকর্তা ব্যক্তিরা ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে পরিচিত। ব্যঞ্জনাময় শব্দ-ব্যবহার, উপমা, অলঙ্করন, প্রাকৃতিক বর্ণনা, সমাজচিত্র ইত্যাদি বিবেচনায় পদগুলির সাহিত্যিক ও ভাষাগত মূল্য অপরিসীম।

১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে পাওয়া সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিভিন্ন বৌদ্ধপুথির একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকাটির নাম ছিল- Sanskrit Buddhist Literature in Nepal। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (২৬.৭.১৮৯১) মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যা অঞ্চলের পুথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) চর্যার একটি ছেঁড়া পুঁথি উদ্ধার করেন। এই চর্যাপদগুলির লেখা হয়েছে আনুমানিক খ্রিস্টীয় সাত থেকে বারো শতক পর্যন্ত। এতে বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব ও সাধন-ভজনমূলক ৪৭টি পদ আছে এবং সেগুলি তাল, রাগ, ও সুর গীতের মতো। বিভিন্ন গবেষকেরা এই পুথির পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। সুকুমার সেন বলেন, ‘’বাঙ্গালা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য-চৌদ্দ শতাব্দ (৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামের বইটির প্রথম গ্রন্থ “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” অংশে সঙ্কলিত চর্যাগীতিগুলি আদি ধরনের অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গলার নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইলেও এগুলির ভাষা খাঁটি আদি স্তরের বাঙ্গলী নহে। (ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪।)

ডক্টর মুহম্মদ শহীদউল্লাহ বলেন, ‘’আমি বাঙ্গলা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গলা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যা’ (বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮। পরে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টাপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন।তিনি বলেন, খ্রিস্টিয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত “চর্যাপদ’নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই। ১৭৬১-১৮৬০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এই সময় মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে মিলন ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এই সময়ের একজন কবি ও সাহিত্যিক। প্রথমদিকে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লেখেন কিন্তু পরে ইংরেজদের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের প্রসাংসা করেছেন।

চর্যাপদের পরে প্রবাদ, বচন, ছড়া, ডাক ও খনার বচন ইত্যাদি কিছু কিছু কাব্যনিদর্শন থাকলেও চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো রচনা পাওয়া যায় না। তাই এ সময়টাকে (১২০১-১৩৫০) কেউ কেউ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেন। মুসলিম শাসকদের অন্যরকম রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থার  মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তখন এক নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। সে সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা সবে শুরু হচ্ছে, এমন অবস্থায় চর্যায় বাংলার -বৈশিষ্ট্যময় অপভ্রংশ ভাষা আরও বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ যুগের পাওয়া নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৩শ-১৪শ শতকের রামাই পন্ডিতের গাঁথাজাতীয় রচনা শূন্যপুরান।এতে বৌদ্ধদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনায় ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ নামের একটি কবিতা আছে। এছাড়া আছে অপভ্রংশ ভাষায় লেখা ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ নামের একটি গীতিকবিতার সংকলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা।

হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেখশুভোদয়া’ নামের সংস্কৃত বইয়ে একটি বাংলা গান পাওয়া গেছে। এরকম পীরমাহাত্ম্যসূচক ছড়া, প্রেমসঙ্গীত এবং খনার বচন ধরনের দু-একটি বাংলা শ্লোকই এ সময়কার প্রধান রচনা। আদি-মধ্যযুগ খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে ধরা হয়। এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, বড়ু চন্ডিদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেম নিয়ে নাট্যগীতি কাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই ফুটিয়ে তোলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে যে পুথিটি প্রকাশিত হয়, তার ভণিতায় বড়ু চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত ইনিই আদি চন্ডীদাস, যাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা যায়। 

মালাধার বসু সংস্কৃতে কৃষ্ণলীলা উপাখ্যান ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে।এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয় পাঁচালী আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত।এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। এরপর রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত  অনুবাদ কাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন  শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর কাব্য  ‘ইউসূফ- জুলেখা’, সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত বলে মনে করা হয়। শেখ চাঁদের রসুলবিজয়কে ইসলামি পুরান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর একটিমাত্র কাব্য পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো লাইলী- মজনু, রচনাকাল ১৫৬০-৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। এটি ফারসি কবি জামীর ‘লাইলী-মজনু’ কাব্যের অনুবাদ, তবে রচনা ও কাব্যরসে স্বচ্ছন্দতা আছে।

এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যধারা হচ্ছে পদাবলি। এর শুরু চৈতন্যপূর্বযুগেই।এতে শ্রীকৃষ্ণ আত্মার আত্মীয়রূপে কল্পিত, তাঁর ও ভক্তের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। পরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এবং চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করে মধ্যযুগের পদাবলি বা গীতিকাব্যের ধারা। রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক এ সাহিত্য ভাব, ভাষা ও ছন্দে অতুলনীয়। অনেকের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জাগরণ হয় এই পদাবলি রচনার মধ্য দিয়েই। বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে আলাওল সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুরের ১৬০০-১৬৬০ আশ্রয়ে থেকে কাব্যচর্চা শুরু করেন। তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে পদ্মাবতী। তাঁর অন্য চারটি কাব্যও অনুবাদ করা এবং সেগুলি হলো হপ্তপয়কর, তোহফা, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল ও সিকান্দরনামা। এগুলি ছাড়া আলাওল কিছু পদাবলি ও গানও রচনা করেন। তাঁর কাব্যে মানবপ্রেম ও অধ্যাত্মপ্রেম দুয়েরই মিলন ঘটেছে।

১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার পর থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকানি রাজারা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রভাবিত ছিলেন। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। আরাকানে বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের শেষপর্বে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী স্বাধীন রাজাদের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়। আরাকান রাজসভাতেই বাংলা ভাষায় প্রথম প্রণয়কাব্য লেখা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাই আরাকান রাজসভার নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ বলা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলতে সাহিত্যের যে অংশগুলো বুঝানো হয়ে থাকে সেগুলোর সাথে কয়েক যুগ আগের সাহিত্য চর্চার বিষয়ের পার্থক্য রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের এই ধারা প্রভাবিত হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের কিছু সাহিত্যিকদের মাধ্যমে। আধুনিক যুগে লেখা হয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ।বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে পদ্য ও ছড়া , তবে আধুনিক কবিতার প্রবর্তন হয়েছে কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে।

#তথ্যসূত্র

#উইকিপিডিয়া

#বাংলাপিডিয়া