ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ‘ক্রিসমাস কেরল’ এর লেখক চার্লস ডিকেন্সের বেদনা বিধুর অভিজ্ঞতার গল্প চার্লস ডিকেন্সের বংশধর কেন কলকাতার সাউথ পার্কের কবরস্থানে???

চার্লস ডিকেন্সের লেখা ডেভিড কপারফিল্ড পড়েনি, বাংলাদেশে এমন মানুষ খুব কমই আছে। আমরা যখন চার্লস ডিকেন্সের লেখা পড়ি বা পড়াই তখন আমাদের চোখের সামনে ভিক্টোরিয়ান পোষাক পরা মহিলা, ঘোড়ার গাড়ীতে চড়া পুরুষ, লন্ডনের পথ, ইত্যাদি ছবি ভেসে ওঠে। ভিক্টোরিয়ান যুগের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স। ইংল্যান্ডের হ্যামসায়ারে জন্ম নেয়া এই দুর্দান্ত প্রতিভার সাথে বাংলারও যে একটা যোগাযোগ আছে তা কজন মানুষ জানেন। এই বিদেশীর ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে রয়েছে একটি আত্মার সম্পর্ক, রয়েছে একটি চিঠির সম্পর্ক। আমাদের এসআইএস ক্রিয়েটিভ রাইটিং টিম সেই অজানা ইতিহাস তুলে ধরেছে এই গল্পে। চার্লস ডিকেন্সের পুত্র ছিলেন ওয়াল্টার সেভেজ লান্ডার ডিকেন্স, যে ছোটবেলা থেকেই বাবার মত লেখার দিকে আগ্রহী ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বাবা ছেলের লেখক হবার উচ্চাকাঙ্খার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কারণ, সেইসময় ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের আয় ছিল খুবই কম। অন্যদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ছিল লোভনীয় বিষয়। বেতনও ছিল অনেক বেশি। তিনি লক্ষীকে বেছে নিয়েছিলেন স্বরসতীর উপর। তাই তাড়াহুড়ো করেই তিনি তাঁর ১৬ বছরের কিশোর ছেলেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর চাকরিতে পাঠান অজানা ভারতবর্ষের দিকে । ইংল্যান্ডে তার আত্মীয় স্বজন খুশী হয়েছিল। দুর্ভাগ্য ছেলের, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁর শরীর ও মন দুইই ভেঙে গেল। সে ফিরে যেতে চাইলো তার নিজের দেশ ইংল্যান্ডে। তারপর ১৮৫৭ সালের রক্তক্ষয়ী সিপাহী বিদ্রোহের কবলে তিনি আরো হতাশ হয়ে যান। এতো রক্তপাত তার কবি মনকে ব্যাধিত করে। কিশোর ডিকেন্সের লেখক হবার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। তার কাছে সেনাবাহিনীর জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ ছিল না। এভাবে কাজ করতে করতে ২২ বছর বয়সে খুব অসুস্থ হয়ে গেলে তার বাড়ি যাওয়ার ছুটি মনজুর হয়। এখন শুধু অপেক্ষা, কবে সে তার প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!! তাই বাড়ী ফেরার কিছু দিন আগেই এক মরণব্যাধি রোগে একেবারে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। সাদামাটাভাবেই ভবানীপুরে ইংরেজ সৈনিকদের সিমেট্রিতে কবর দেয়া হয় তাকে এবং চিরদিনের জন্য থেকে যান ভারতবর্ষের এই বাংলার মাটিতে। আত্বীয়-পরিজন কেউই থাকতে পারেনি তার পাশে। তার মৃত্যু এসেছিল নিঃশব্দে, নিভৃতে, বিদেশ বিভুইয়ে। ট্র্যাজেডি এখানেই শেষ হয়নি। ওয়াল্টার মারা গেলেন ১৮৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এই খবর ইংল্যান্ডে তাঁর বাবা-মা পায় দীর্ঘ দিন পরে ১৮৬৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারিতে। যখন মহা ধুমধামে পালন হচ্ছে বাবা চার্লস ডিকেন্সের ৫২তম জন্মদিন। সেই জন্মদিনে তার হাতে আসে এক চিঠি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে। চিঠি পরে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কি ছিল সেই চিঠিতে? কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পাঠানো চিঠিতে ছিল- তার আদরের ছেলের মৃত্যু সংবাদ। যার সাথে তাদের বিগত ৬ বছরে একটিবারও দেখা হয়নি, কথা হয়নি; আর দেখা হবেও না। বাবার বুক কতটা দুঃখ-শোকের বোঝা নিয়ে বেঁচে ছিল- তা সহজে অনুভব করা যায় না। যার জীবনে এমন দুঃখের অভিজ্ঞতা হয়, শুধুমাত্র সেই বুঝতে পারে। পরবর্তীতে তার কবর ভবানীপুর থেকে সাউথ পার্ক সিমেট্রি,কলকাতাতে স্থানান্তর করা হয়,যা একসময় অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। সাত সমুদ্র পাড়ে শায়িত রয়েছে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের আদরের সন্তান। এখনও তার সমাধিস্তম্ভ লিপি সেখানে আছে। যেখানে ফুল দিতে তার নিকট আত্বীয়-স্বজনকে পাড়ি দিতে হয় সাত সমুদ্র তের নদী।