সময়টা ৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ।
কনস্টান্টিনোপলের আলো-ছায়ায় ভরা শহরে এক ধূলোমাখা গলিতে জন্ম নিলেন এক কন্যা, নাম তার থিওডোরা। ছোট্ট এই শিশু জন্মের পর বোধ হবার শুরু থেকেই বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধ করে এগোতে হবে ভাগ্যের প্রতিটি কঠিন বাঁকে। বাবা আকাসিয়াস ছিলেন হিপোড্রোমের এক সাধারণ ভাল্লুকরক্ষক, আর মা-ও ছিলেন মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। থিওডোরা বড় হয়ে মায়ের পথই অনুসরণ করলেন। নৃত্য, কসরত আর অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে জায়গা করে নিলেন তিনি। সে যুগে “অভিনেত্রী” শব্দের মানেই ছিল দেহপ্রদর্শন, উদ্দাম নৃত্য। এ কারণে অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে সমাজে কখনোই সম্মানের চোখে দেখা হত না। বরং মানুষ তাদেরকে মোটামুটি ঘৃণার বা অবজ্ঞার চোখেই দেখতো। থিওডোরা কিন্তু ভয় পেলেন না। এই পেশাকে অবলম্বন করেই জীবন চলতে থাকল তার। তারপর হঠাৎ একদিন হিপোড্রোমের ধুলো ঝেড়ে তিনি পাড়ি জমান উত্তর আফ্রিকায়। সেখানে এক সরকারি কর্মকর্তার উপপত্নী হিসেবে বসবাস করলেন কিছুদিন, কিন্তু এটি তার জীবনের এক অস্থায়ী অধ্যায় ছিল। কারণ ধীরে ধীরে জীবন তাকে ডেকে নিল নতুন এক অধ্যায়ে—এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সিংহাসন কক্ষে।

থিওডোরার একটি মোজাইক চিত্রকর্ম; © Wikipedia
তিনি প্রেমে পড়লেন জাস্টিনিয়ানের। জাস্টিনিয়ানও তাকে ভালোবেসে ফেলল। জাস্টিনিয়ান তখনো সম্রাট হয়ে উঠেনি। আর অনেকের কাছে এই প্রেম ছিল এক রূপকথার মতো। অবাক হয়ে সবাই ভাবল, এমন ঘৃণিত এক অভিনেত্রীকেই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিলেন ভবিষ্যতের সম্রাট? তবে জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকে বেছে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও হল প্রবল। সম্রাজ্ঞী ইউফেমিয়া যেন যুদ্ধই ঘোষণা করে বসলেন এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে। ইতিহাস বলে, ইউফেমিয়ার অকাল মৃত্যু না হলে এই বিয়ে কখনই সম্ভব হতো না। জাস্টিনিয়ানকে কোনো বাঁধাই আটকাতে পারল না। তিনি আইনও ভাঙলেন, পরিবর্তন করলেন। তখনকার নিয়মে সিনেটররা অভিনেত্রীদের কিছুতেই বিয়ে করতে পারতেন না। জাস্টিনিয়ান কিন্তু একজন সিনেটরই ছিলেন। তিনি নিজেই সেই আইন পরিবর্তন করলেন। আর তাতে সব বাধা দূর হয়ে গেল। জাস্টিনিয়ান থিওডোরাকে শুধু বিয়েই করলেন না, থিওডোরার প্রথম জীবনের কন্যাসন্তানকেও তিনি বৈধ মর্যাদা দিলেন।

সভাসদদের সঙ্গে থিওডোরার চিত্রকর্ম; © Wikipedia
অবশেষে একদিন ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে
হায়া সোফিয়ার সোনালি গম্বুজের তলায়, হাজারো প্রদীপের আলোর ঝলমলে অভিষেকের মুহূর্তে থিওডোরা সম্রাজ্ঞীর আসনে বসলেন। সেই মুহূর্তে পুরো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য যেন নতুন করে জেগে উঠল। জাস্টিনিয়ান সেই দিনই নিশ্চিত করলেন, থিওডোরা কেবল তাঁর সহধর্মিণীই নয়, তাঁর সমকক্ষ সম্রাজ্ঞীও হবেন। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি অবস্থান করে মাথায় মুকুট তুললেন তারা।
থিওডোরার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল অসীম। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল ৫৩২ খ্রিস্টাব্দের নিকা বিদ্রোহের সময়। সম্রাট যখন পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচাতে চাচ্ছিলেন, থিওডোরা তার তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন—রাজমুকুট পরে পালানো মানেই লজ্জার জীবনকে বেছে নেওয়া। আমি মরতে চাই, পালাতে চাই না। তার চরিত্রের এই দৃঢ়তার কারণে জাস্টিনিয়ান বিদ্রোহ দমন করলেন এবং ক্রমান্বয়ে সিংহাসনও রক্ষা করলেন।
গৃহযুদ্ধের শেষে তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাজার, দালান, বাড়ি—সবকিছু। থিওডোরা দেখলেন, ধ্বংসের মধ্যেই নতুন সূচনা সম্ভব। তার এই উৎসাহে সম্রাটও উদ্যমী হয়ে উঠলেন। থিওডোরা আর জাস্টিনিয়ান মিলে কনস্টান্টিনোপল শহরকে নতুন রূপে সাজাতে শুরু করলেন। তাদের শহর সে যুগের সবচাইতে মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যশৈলীর কেন্দ্র হয়ে উঠল। বিখ্যাত ‘হায়া সোফিয়া’ প্রাসাদ আবার বিশাল আকারে নতুন করে নির্মিত হল। থিওডোরার কাজের দক্ষতা আর সাহসের গল্প তখন শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

জাস্টিনিয়ান ও থিওডোরার মোজাইক চিত্রকর্ম; © Wikipedia
মারাত্মক এক দাঙ্গা দমন করে শহরকে বাঁচানোর জন্য সবার কাছেই তিনি প্রিয় হয়ে উঠলেন। সম্রাট তাকে নিজের পাশে এনে সাম্রাজ্যের নানা কাজকর্মে সহযোগী করে তুললেন। এরপর আর কোনো বড় সিদ্ধান্ত জাস্টিনিয়ান একা না নিয়ে থিওডোরার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজগুলো সম্পাদন করলেন। সেই সময়ে নারীর এমন ক্ষমতা অত্যন্ত বিরল। আর এই ক্ষমতাবলে থিওডোরা তার বুদ্ধি এবং কৌশল দিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে এক উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে দিলেন, যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে তার দূরদর্শী চিন্তা আজও সকলকে চমৎকৃত করে। জনদরদী থিওডোরা নারী-পুরুষের সমঅধিকার ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন। নারীদের বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে সাহায্য করার জন্য আইন করিয়েছিলেন। বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় নারীদের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। আর যদি কেউ জোর করে নারীদের অভিনয় শিল্পে বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে তবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়ারও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
বোঝাই যাচ্ছে, বাইজেন্টাইন নারীরা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি সমঅধিকার ও সম্মান পেয়েছিলেন থিওডোরার কারণে। ধর্মক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হলেও দুজনের মধ্যে সেটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। থিওডোরা তার ধর্মের অনুসারীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে গেছেন, আর জাস্টিনিয়ান সেক্ষেত্রে তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। এমন ধর্মীয় সহনশীলতার নজিরও ছিল বিরল।
তবে সব সুখের শেষ আছে। এই রূপকথার গল্পেরও এক দুঃখজনক পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়। থিওডোরা ৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একান্ন কিংবা বায়ান্ন বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর এই অকাল মৃত্যু সম্রাট জাস্টিনিয়ানের জীবনে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। জাস্টিনিয়ানের যদিও কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না, তার পরেও তিনি আর কোনো দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
থিওডোরার প্রথম জীবনের একটি কন্যাসন্তান ছিল, জাস্টিনিয়ান সেই কন্যার ঘরে জন্ম নেওয়া তিন ছেলেকে পরবর্তীতে বাইজেন্টাইন দরবারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। স্ত্রীকে হারিয়ে জাস্টিনিয়ান দীর্ঘ শোকে ডুবে গিয়েছিলেন; কিন্তু তার পরেও আরও সতেরো বছর তিনি দেশকে শাসন করেছিলেন। মানুষ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিল—থিওডোরার জীবদ্দশায় যে উজ্জ্বলতা ও মনোযোগ তার মধ্যে ছিল, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে সেটা আর তেমনভাবে ঝলমল করে উঠেনি।
ইতালির রাভেন্না নগরের সান ভিতালে গির্জার দেয়ালে তৈরি ঝকঝকে মোজাইকে আজও তিনি দৃশ্যমান। দুটি আলাদা প্যানেলে একদিকে সম্রাট জাস্টিনিয়ান ও রাভেন্না আর্চবিশপ ম্যাক্সিমিয়ানকে দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে রাজকীয় আভায় উজ্জ্বল সম্রাজ্ঞী থিওডোরা। চিত্রে তিনি মহিমান্বিত রূপে দেখা দেন। তার মাথার চারপাশে আলোকবৃত্ত। রঙিন গয়নায় সজ্জিত নেকলেস, দুল, রত্নখচিত মুকুট একে আরও অভাবনীয় সুন্দর করে তুলেছে। তার দেহে ঝলমল করছে সিরিয়ান বেগুনি রঙের রাজকীয় পোশাক। হাতে সোনার পাত্র ধরে আছেন। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে দরবারের অভিজাত নারীরা এবং নিকটস্থ কর্মকর্তারা।

আয়া সোফিয়ার বর্তমান রূপ; © Wikipedia
ঐ মোজাইক শুধু তার সৌন্দর্য নয়, বরং তার শক্তি, মর্যাদা ও বাইজেন্টাইন সমাজের ঐশ্বর্যের প্রতীক। শত শত বছর পরেও রাভেন্নার সেই চিত্র মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—থিওডোরা কেবল সম্রাট জাস্টিনিয়ানের স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্যিকারের বন্ধু, সম্রাটের শক্তির উৎস।