১৮৫৫ সালে তখনকার জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী এই রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন।মুর্শিদাবাদের উত্তর প্রান্তে এক বিস্তৃর্ণ জমি কিনে নিমতিতায় তাঁদের জমিদারীর প্রচলন করেন। তখনকার সময় জমিদাররা ছিলেন অনেক টাকার মালিক, তাই তারা তাদের বাড়িগুলো বানাতেন বিভিন্ন ধরণের সুন্দর সুন্দর নকশা করে। ইতালিয়ান ধাচের এই বাড়িটিতে আছে পাঁচটি উঠোন এবং দেড়শো কামরা।
জমিদারি সুনাম অর্জন করেছিল তাঁদের হিন্দুস্তানী সঙ্গীত এবং নৃত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসার জন্য। একসময় সন্ধ্যে হলেই পুরা রাজবাড়ি সেজে উঠতো, দোলের সময় নাটক মঞ্চস্থ হত। সেই সময়ে এই রাজবাড়িতে কত সব বিখ্যাত মানুষরা আসতেন। নিমতিতা রাজবাড়ির সেই সময় গমগমে অবস্থা ছিল। উঠোনভরা লোকলস্কর, চাকর- বাকর, বাড়ি ভরা লোকজন।
আমন্ত্রিতদের তালিকায় থাকতো তখনকার সেরা নাট্যব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা ,রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা । এক সময় এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন কালাজ্বরের ঔষুধ আবিষ্কারক বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, মুর্শিদাবাদ জেলার তখনকার জেলাশাসক শিশু সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, সাহিত্যিক লীলা মজুমদার, কবি কাজি নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুর প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব । ক্ষীরোদা প্রসাদ, বিদ্যাবিনোদ, শিশির কুমার ভাদুরীর নাটক মঞ্চস্থ হত এই রাজবাড়িতে।
এই রাজবাড়িতেই নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক তরুণী অপর্ণা সেনকে নিয়ে ‘Monsoon in India’ নামে ফটো স্টোরির শুট করেছিলেন লাইফ ম্যগাজিনের জন্য।
সত্যজিৎ রায় ১৯৫৭ সালে ‘জলসাঘর’ ছবির শ্যুটিং করেছিলেন নিমতিতা রাজবাড়িতে। সে সময় তিনি জলসাঘর সিনেমা শুটিংয়ের জন্য বিভিন্ন রাজবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বহু রাজবাড়ি দেখেও মনের মতো লোকেশন পাচ্ছিলেন না । অনেক লোকেশন বাতিল করার পরে লালগোলার এক চায়ের দোকানে নিমতিতা জমিদার বাড়ির কথা শোনেন সত্যজিৎ রায়। নিমতিতা রাজবাড়িতে এসে তার পছন্দের শুটিং স্পট খুঁজে পান।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি জলসাঘরের চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন তাঁকে বলেছিলেন “ব্যানার্জি ,আমরা আমাদের শুটিং স্পট খুঁজে পেয়েছি সত্যজিৎ রায় এখানে শুধু ‘জলসাঘর’ই নয়, ১৯৫৯‘দেবী’ এবং ১৯৬০ সালে ‘সমাপ্তি’ ছবির শুটিংও করেছিলেন। সত্যজিতের রায়ের এই তিনটি সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে বেঁচে রয়েছে নিমতিতা রাজবাড়ির জৌলুস। আজও এই রাজ বাড়ির পাশে দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসাঘর’ ছবির শেষ দৃশ্য ছিল এরকম জমিদার বিশ্বম্ভর রায় ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর বাড়ির সামনে। অসুস্থ জমিদারের কীর্তি দেখে কাজের লোকজন ভয় পাচ্ছে কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছেন না, তিনি ছুটেই চলেছেন। হঠাৎ ঘোড়া লাফিয়ে উঠলো, টাল সামলাতে না পেরে তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না।
এখন সেই রকমই অবস্থা মুর্শিদাবাদের নিমতিতা রাজবাড়ির। চলতে চলতে এখন যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে, ভাঙতে ভাঙতে সে যেন এখন শেষের দিকেই এগিয়ে যেতে চাইছে। এখন নিমতিতার জমিদার বাড়ি তার যৌবন হারিয়ে আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছেচে। নষ্ট হয়েছে বাড়ির বিভিন্ন অংশের কারুকাজ, জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনরকমে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। কত ইতিহাসের সাক্ষী মুর্শিদাবাদের নিমতিতার এই রাজবাড়ি, যা আজ অবহেলিত ।
বাড়িটির বর্তমান অবস্থা এমনই জরাজীর্ণ যে কোনও সময় বাড়িটার সমস্ত কাঠামোই ভেঙে পড়তে পারে। মাথার উপরের ছাদ ভেঙে আকাশ উঁকি দিচ্ছে ঘরে। কড়িকাঠের বর্গাগুলো দখল নিয়েছে ঘুণপোকা। দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চুনসুরকি বালি। লতা ও আগাছা বংশ বিস্তার শুরু করে দিয়েছে ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে। রাজবাড়ির অন্তিম লগ্নটা যেন ‘জলসাঘর’ সিনেমার বিশ্বম্ভর রায়ের ভেঙে পড়ার মতোই।
#তথ্যসূত্র #Kolkata_24.com #আনন্দ_ বাজার_পত্রিকা