আমির খান অভিনীত ‘মঙ্গল পাণ্ডে-দ্যা রাইজিং’ সিনেমা দেখার পর আমরা অনেকেই একটু সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস জানতে পেরেছি। কিন্তু সেটাতো ভারতের কথা। আমাদের ঢাকার কথাতো সেখানে নেই। বাংলার চট্টগ্রাম ও ঢাকাতেও সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী লালবাগ কেল্লা ও বাহাদুর শাহ পার্ক রয়েছে। আমরা কজনই বা জানি সেই গল্প।
১৮৫৭ সালের ১০ মে ভারতে মিরাট শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। সেই সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ক্যানিং। মঙ্গল পান্ডের ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে, বৃটিশদের দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার সিপাহীদের আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে নানা সাহেব, আজিমুল্লাহ খাঁন, তাঁতিয়া টোপিরা জোড়ালো নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
লালবাগ কেল্লা
জানা যায়, এনফিল্ড রাইফেলের টোটাগুলো উপরের আবরণটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হতো। ইংরেজরা এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো শুরু করে, যাতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ধর্ম চলে যায়। যখন সিপাহীরা এটা জানতে পারে, তখন হিন্দু ও মুসলিম উভয় এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ক্রমে এই বিদ্রোহের আগুন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ জুন ১৮৫৭ সালে পলাশী ট্রাজেডির শততম বছরে ইংরেজ শাসনের পতন ঘটবে এই বিশ্বাস নিয়ে সিপাহীরা নতুন উদ্যমে আক্রমণ চালায়। তারপর ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী বিদ্রোহ শুরু করে জেলখানা থেকে সকল বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেয়। এরপর যত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ আছে সব দখল করে নিয়ে অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা ত্রিপুরার দিকে যাত্রা শুরু করে অন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। এই বিদ্রোহের কথা ঢাকাতেও পৌঁছেছিলো। হয়তো ঢাকাও জোরেশোরে অংশ নিতো এই বিপ্লবে।
সেইসময় ঢাকায় অবস্থিত ইংরেজ, ডাচ, আর্মেনিয়ানরা কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করলো। যেকোনো মুহূর্তে ঢাকায় বিদ্রোহ হতে পারে ভেবে, তারা ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং একশত নৌসেনা ঢাকায় আনে এবং জলপাইগুড়ি থেকে আরো সৈন্য এনে ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই সময় শহরে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে থাকলো। যেমন: ব্রাক্ষ্মণ রুটিয়ালাকে পেটানোর অপরাধে এক সিপাহীকে জরিমানা করা হয়েছিল। যখন ইংরেজ সৈন্য ঢাকায় আসে, সিপাহীর পোশাক পরা কিছু লোক কয়েকজন সৈন্যকে পেটায়। এতে করে শহরের পরিবেশ আরও থমথমে হয়ে ওঠে। সে কারণে তারা লালবাগ কেল্লার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সেখানকার সিপাহীদের নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া ঢাকার নওয়াব খাজা আবদুল গনি ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন। ফলে এই দুপক্ষ মিলে ঢাকার সিপাহীদের বিপ্লব খুব সহজেই দমন করে ফেলে। হয়তো মীরজাফরের মতো ঢাকার নওয়াব খাজা আবদুল গনি ইংরেজদের পক্ষ না নিলে আজকে ইতিহাস অন্যরকমভাবে লিখতে হতো। কোম্পানির সৈন্যরা লালবাগে নিয়োজিত ২৬০ জনের ভারতীয় সেনাদলকে আক্রমণ করলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহী নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়। ঘটনার শুরু ২২ নভেম্বর ভোরবেলা।
বাহাদুর শাহ পার্ক। আগে এটার নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক।
আগের নির্দেশ মতো কমিশনার ও জজ সাহেব কিছু সিভিলিয়ান স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ঢাকা কলেজের কাছে জড়ো হয়। লে. লুইস, লে. ডডওয়েল ও উইলিয়াম ম্যাকফার্সন লালবাগের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে, লে. রিন্ড, ফারবেশ আরও অনেকে রওনা হন কোষাগারের দিকে সিপাহীদের নিরস্ত্র করতে। সেই সময় ১৫ জন সিপাহী তোপখানার পাহারায় ছিল। সিপাহীদের যখন নিরস্ত্র করা হচ্ছিলো তখনি লালবাগ থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইংরেজ স্বেচ্ছাসেবকরা এই আওয়াজে ভয় পেয়ে যায়। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তোপখানার সিপাহীরা পালিয়ে যায়। নৌসেনারা যখন লালবাগ দুর্গে যায় সেখানে দেখে বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ততক্ষনে প্রস্তুত হয়েই ছিল। লালবাগের অস্ত্রাগারের চাবি ছিল সুবেদারের কাছে। সিপাহীদের অনুরোধের পরও যখন তিনি চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানান তখন সিপাহীরা তাকে হত্যা করে চাবি ছিনিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু ইংরেজরা ততক্ষনে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। পরীবিবির মাজারের সামনে বসানো কামান দিয়ে সিপাহীরা ইংরেজদের বাধা দিচ্ছিলো। অস্ত্রের অভাবে আত্মসমর্পণ করলে ইংরেজরা তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। কিছু সিপাহীর লাশ ফেলা হয় দুর্গের পশ্চিম দিকের পুকুরে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় অনেক সিপাহীকে। সংঘর্ষের সময় কিছু সিপাহী পালিয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া ২০ জন সিপাহীকে গ্রেফতার করা হয় যাদের মধ্যে ১১ জনকে ফাঁসি দেয়া হয় চকবাজার ও আন্টাঘর ময়দানে, যা বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত। ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সলিমুল্লাহ এতিমখানার দক্ষিণে কবর দেয়া হয়, এটি একসময় ‘গোরে শহীদ মহল্লা’ নামে পরিচিত ছিল। তৈফুর বলেছেন, লালবাগ দুর্গের যে পুকুরে সিপাহীদের লাশ ফেলা হয়েছিল, সেই জায়গায় এক ধরণের ভৌতিক পরিবেশ তৈরী হয়েছিল। পরবর্তীতে অনেকেই নাকি সেই জায়গা থেকে, ‘ভাই, পানি, পানি’, ‘ভাই, পানি, পানি’ বলে চিৎকার শুনতে পেতো। হয়তো তৃষ্ণার্ত মৃত সিপাহীর আত্মা সাধারণ মানুষের কাছে একটু পানি চেয়ে আকুতি জানাতো।
আবদুল গনি
সরকারি তথ্য মতে, লালবাগ এলাকায় ৪১ জন সিপাহী ও ৩ জন ইংরেজ নৌসেনা নিহত হন। ঢাকায় তখন শিখ এবং পাঠান মিলে মোট ২৬০ জন সিপাহী ছিল। আসলে কেন এই সংগ্রাম সফল হয়নি?, সে বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে তখন ইংরেজদের সাথে শুধু জমিদার বা ধনীরা নয়, মধ্যবিত্তদের কেউ কেউ হাত মিলিয়ে ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা ঢাকার নবাব ও তার সৈন্যরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইংরেজ সরকারকে সমর্থন করলে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। আমাদের এই লালবাগ কেল্লা শুধু মোঘল স্থাপনা নয়, পরি বিবির মাজার নয়, আমাদের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মাহুতি দেয়া বীর শহীদদের আত্মত্যাগের শহীদ মিনার। এই শহীদদেরও আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। চলুন এবার দেখে আসা যাক, যেখানে ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো! সেই বাহাদুর শাহ পার্ক। আগে এটার নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক।
A magnificently breathtaking church
জানা যায়, বাহাদুর শাহ পার্কের নামের পরিবর্তনটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ! ১৮ শতকের শেষদিকে এটা ছিল আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড খেলার ক্লাব। বিলিয়ার্ডের সাদা গোল বলগুলো ডিমের মতো দেখতে বলে, স্থানীয় বাঙ্গালীরা এই ক্লাবকে ‘আন্ডাঘর’ বলে ডাকতো। ধীরে ধীরে সেটা ‘আন্টাঘর’ নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীকালে ইংরেজরা ক্লাব ঘরটা ভেঙ্গে খোলা পার্ক বানায়। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানে সেই বিষয়ে একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকার কমিশনার। তারপর থেকে এর নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। আপনার সবাই জানেন বাহাদুর শাহ কে ছিলেন?
বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের শুরুর দিকে বিদ্রোহী সিপাহীরা দিল্লীর লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ভারত স্বাধীন করার শপথ নিয়েছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে বর্তমান বার্মার রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সম্মান জানাতে পরবর্তীতে এই ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম বদলে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়েছিলো।
তথ্যসূত্রঃ
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সিপাহী বিদ্রোহ এবং একটি ঐতিহাসিক অবিচার, ঢাকা, ২০১৭।
অলিউর রহমান, সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস, বাংলাদেশ, ২০১৭।
বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া।