দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। তথাকথিত নিকৃষ্ট জাতির ওপর উৎকৃষ্ট জার্মান জাতির প্রভুত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার নেমেছেন এক মহান যুদ্ধে। পুরো ইউরোপকে জার্মানির হাতে পদানত করার স্বপ্নে বিভোর থাকা এই নেতা একে একে দখল করতে থাকলেন পশ্চিম ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকা। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই মহাযুদ্ধের পরবর্তী বছরই জার্মানি দখল করে ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের মত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ। ফ্রান্সের পরাজয়ের পর পশ্চিম ইউরোপের একমাত্র ক্ষয়িষ্ণু দেশ হিসেবে থেকে যায় ইংল্যান্ড। এবার জার্মানি নজর দেয় পূর্বে ইউরোপে। পূর্ব ইউরোপে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন হিটলার। বিশেষ এই অপারেশনের কোডনেম দেয়া হয় অপারেশন বারবারোসা। কিন্তু রাশিয়ায় এসে ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয় জার্মান সেনাবাহিনী।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তি
আগস্ট, ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানির মধ্যে ১০ বছর মেয়াদী অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে গোপনে পোল্যান্ড ভাগ করে নেয়ার ব্যাপারে দুই দেশ ঐকমত্যে আসে। কিন্তু দুপক্ষই মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল এই অনাক্রমণ চুক্তি খুব বেশিদিন টিকবে না। জার্মানির লক্ষ্য ছিল পোল্যান্ড আক্রমণের পর পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশও দখলে নিয়ে অতঃপর পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করে পুরো ইউরোপে জার্মান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। আর জার্মানির এই অশুভ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন যোসেফ স্ট্যালিনও। তাই তিনিও গোপনে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। দূরদর্শী স্ট্যালিন বুঝেছিলেন আজ হোক কাল হোক সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানির মোকাবেলা করতেই হবে। তাই তিনি ভেতরে ভেতরে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভূকৌশলগত দিক থেকে সুসংগঠিত করেছিলেন। এই কথিত অনাক্রমণ চুক্তি খুব দ্রুতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় জার্মানির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে ক্রমাগত সাফল্যের পর।
পোল্যান্ড আক্রমণের দুইদিন পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ৩, ১৯৩৯ সালে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। আটমাস পর জার্মানি যুদ্ধে ব্লিটজক্রেগ কৌশল প্রয়োগ করে। এই নীতিতে জার্মানি বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ করে যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে সাফল্য লাভ করতে থাকে। ১৯৪০ সালের মে মাসে শুরু হওয়া ব্লিটজক্রেগ নীতির মাধ্যমে মাত্র ৬ সপ্তাহে পশ্চিম ইউরোপের লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স দখল করে জার্মানি। ফলে পশ্চিম ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। একা হয়ে পড়ে ইংল্যান্ড। আর এই সুযোগে পূর্ব ইউরোপের স্লাভ জনগোষ্ঠীকে সভ্য বানানোর জন্য জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪০ সালের জুন মাসের ২২ তারিখ ৩০ লক্ষ জার্মান ও অক্ষশক্তি সমন্বয়ে এক বিশাল বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অপারেশন। এই অভিযানে জার্মান বাহিনীর ৮০ শতাংশ সৈন্য অংশগ্রহণ করে। যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী। জার্মানি ভেবেছিল পশ্চিম ইউরোপের মত ব্লিটজক্রেগ নীতির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাহিনী সংগঠিত হওয়ার আগেই তারা মস্কো পর্যন্ত চলে যেতে পারবে। যদিও সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল সম্ভ্যাব্য জার্মান আক্রমণের কথা কিন্তু সহসাই জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করবে এ কথা তিনি ভাবেননি। ফলে সোভিয়েতের রেড আর্মি প্রায় অপ্রস্তুত ছিল। আর এই সুযোগে উত্তরদিক হয়ে লেলিনগ্রাড, কেন্দ্রে মস্কো আর দক্ষিণে সামরিক অভিযান চালিয়ে জার্মান বাহিনী দ্রুত সাফল্য লাভ করে। জার্মান ট্যাংক ও বিমানবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। আগ্রাসনের প্রথম দিনেই শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের এক হাজার যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে জার্মান বিমানবাহিনী। স্থল আক্রমণের সময় ব্যাপক গণহত্যা চালায় জার্মানি। বিশেষ করে ইহুদিদের হত্যা করতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয় জার্মান সৈন্যদের। এছাড়া সোভিয়েত সামরিক অফিসারদের তৎক্ষনাৎ হত্যা করতে নির্দেশ দেয়া হয় যা ছিল যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রটোকলের স্পষ্ট লংঘন।
মস্কো আক্রমণ
স্থলযুদ্ধে জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু জার্মান বাহিনীর আত্মবিশ্বাস এই পর্যায়ে এসে কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। তারা সোভিয়েত বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের সামনে পড়ে। অনেক জার্মান সৈন্য এই পর্যায়ে এসে মারা পড়তে থাকে। আগস্টের শেষ নাগাদ জার্মান প্যানজার ডিভিশন (ট্যাংক) রাজধানী মস্কো থেকে ২২০ মাইল দূরত্বে এসে পড়ে। তখন হিটলার এক ভুল করে বসেন। মস্কো আক্রমণ বিলম্ব করে আপাতত ইউক্রেনের দিকে আক্রমণ শাণিত করার নির্দেশ দেন তিনি। জার্মান জেনারেলদের আপত্তি সত্ত্বেও মস্কো আক্রমণ স্থগিত করে ইউক্রেনের দিকে মনোযোগ দেয় জার্মান বাহিনী। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন হয়। উত্তরদিকে ফিনিশ মিত্রদের সাহায্যে জার্মান বাহিনী লেলিনগ্রাড শহরকে বাকি রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু লেলিনগ্রাডের মত শহরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার মত শক্তি ছিল না জার্মান বাহিনীর। শহরের রুশ গেরিলাদের আক্রমণে তটস্থ থাকতে হয় জার্মান বাহিনীকে। উপরন্তু লেলিনগ্রাডকে উপোস রাখতে ৮৭২ দিনের এক অবরোধ আরোপ করে জার্মানি যাতে লাভের লাভ তেমন কিছুই হয়না।
অক্টোবরের প্রথমদিকে হিটলার মস্কো আক্রমণের নির্দেশ দেন। মস্কো আক্রমণের বিশেষ এই অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন টাইফুন। কিন্তু ততোদিনে সোভিয়েত লাল ফৌজ তাদের সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করে ফেলেছে। বিলম্বের সুযোগ নিয়ে মস্কোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে তুলে সোভিয়েত বাহিনী। ১০০০ নতুন T-34 ট্যাংক আর ১ লক্ষ সৈন্যের এক দুর্ভেদ্য বাহিনী অপেক্ষা করতে থাকে জার্মানদের মোকাবেলা করার জন্য। ইতোমধ্যে শরৎকাল চলে আসলে রাশিয়ায় পথঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মস্কোর বাইরে থাকা জার্মান বাহিনীর অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে পড়ে। মধ্য নভেম্বরে জার্মান বাহিনী মস্কো শহরকে ঘিরে রাখার পরিকল্পনা করে এবং আক্রমণ শাণাতে থাকে। কিন্তু সার্ব মিত্রদের সহায়তায় সোভিয়েত লাল ফৌজ জার্মান বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখে। এরমধ্যে ডিসেম্বরে শুরু হয় রাশিয়ার কুখ্যাত শীতকাল। যেই শীতকাল শতাব্দীর পর শতাব্দী রাশিয়ার প্রতিরক্ষার ঢাল হিসেবে বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল। প্রচণ্ড শীত আর রসদ স্বল্পতায় জার্মানদের মস্কো দখলের স্বপ্ন ভেস্তে যায় এবং পুরো বাহিনী যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে। যুদ্ধে পালানোর লজ্জ্বা থেকে জার্মানি জুন, ১৯৪২ সালে ফের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে। সেসময় মূল যুদ্ধ সংঘটিত হয় রাশিয়ার কৌশলগত শহর স্ট্যালিনগ্রাডে। জার্মান দুর্ধর্ষ দল ষষ্ঠ পদাতিক ডিভিশন পাঠানো হয় স্ট্যালিনগ্রাড দখলে। প্রথমদিকে রাশিয়া বিমানবাহিনীর মাধ্যমে স্ট্যালিনগ্রাড শহর ধ্বংস করে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু একটা সময় স্ট্যালিনগ্রাডে রুশ গেরিলাদের ক্রমাগত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে জার্মান বাহিনী। নিজেদের অবরুদ্ধ করা শহরে নিজেরাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তারা। দিনে যে জায়গা দখল করত জার্মান বাহিনী রাতে তা বেহাত হয়ে যেত রুশ গেরিলাদের হাতে। এদিকে রসদ স্বল্পতা আর রেড আর্মির ঘিরে রাখার ফলে জার্মান বাহিনীর নাটকীয় পরাজয় ঘটে। প্রায় দেড় লক্ষ জার্মান নিহত ও লাখখানেক সৈনিক যুদ্ধবন্দী হয়। ১৯৪৩ এ চূড়ান্ত স্ট্যালিনগ্রাড যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির হাতে চলে যায়। পরাজিত হয় জার্মানি ও অক্ষশক্তি।
অপারেশন বারবারোসার ব্যর্থতার পেছনে এডলফ হিটলার প্রধানত রাশিয়ার তীব্র শীতকে দায়ী করেন। কিন্তু এটি আসলে ছিল একটু অজুহাত। পুরো আক্রমণ জুড়েই জার্মানি কৌশলগত সিদ্ধান্তে বড় ধরনের ভুল করতে করতে অগ্রসর হয়। এছাড়া অভিযান শুরু করার আগে সোভিয়েত বাহিনী সম্পর্কে জার্মান গোয়েন্দাদের বিভ্রান্তিকর তথ্য, ব্লিটজক্রেগ নীতির উপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এই পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা যোসেফ স্ট্যালিনের দৃঢ়চেতা মনোবল ও কঠোর নেতৃত্ব রেড আর্মিকে উজ্জীবিত করেছিল। প্রতিপক্ষের কাছে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ না করার জন্য তিনি মস্কো থেকে পালিয়ে না গিয়ে ক্রেমলিন থেকে Mother Russia রক্ষার জন্য সোভিয়েত সৈন্যকে আহ্বান জানান। জার্মান মিত্রদের পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহ না করা সর্বোপরি তীব্র শীতও জার্মানির প্রতিকূলে যায়। ফলে জার্মানির সোভিয়েত রাশিয়া দখলের স্বপ্ন ভেস্তে যায়।