সদ্য স্বামীহারা বিধবা রাণী আনখেসেনামেন। হঠাৎ করেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন মিশরের সবচেয়ে রহস্যময় ও কম বয়সী ফারাও তুতেনখামুন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মৃত তুতেনখামুন ছিলেন নিঃসন্তান। তাই কোনো উত্তরসূরিও তিনি রেখে যেতে পারেন নি। আনখেসেনামেনের গর্ভপাতের ফলাফল দুই শিশু কন্যার ভ্রূণের মমিও বাবার পাশেই সমাহিত। একদম একা হয়ে যাওয়া আনখেসেনামেনের অন্তরে বাসা বেঁধেছে ভয় ও আশঙ্কা। পরবর্তী ফারাও কে হবেন, তা নিয়ে চিন্তা তো আছেই, তার উপর যুক্ত হয়েছে তার নিজের আত্মসম্মানবোধ ও নিরাপত্তা, যা হিট্টাইট সম্রাটের কাছে তার লেখা চিঠি থেকেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু মিশরের রাণী হওয়া সত্ত্বেও কিসের এতো ভয় আনখেসেনামেনের? কেনোই বা তিনি এতো নিরুপায় হয়ে গেলেন যে মিশরের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিট্টাইটদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হলো তাকে? তবে কি তুতেনখামুনের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়? কি রহস্য লুকিয়ে আছে তুতেনখামুন ও আনখেসেনামেনের জীবনে?
আনখেসেনামেন ছিলেন তুতেনখামুনের সৎ বোন। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ফারাও আখেনাতেনের মৃত্যুর পর মিশরীয় রীতি অনুযায়ী রাজতন্ত্রের বিশুদ্ধ রক্তের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার জন্য আখেনাতেনের আট বছর বয়সী ছেলে তুতেনখামুন নয় বছর বয়সী আনখেসেনামেনকে বিয়ে করে মিশরের ফারাও হন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আট বছর বয়সী একটি বালকের পক্ষে ফারাও হিসেবে সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন এবং এতো অল্প বয়সে বাবার রেখে যাওয়া একেশ্বরবাদের চেতনাকেই তার আগলে ধরার কথা। কিন্তু তুতেনখামুন কিন্তু তা করেন নি। বরং ফারাও হবার পর আখেনাতেনের সমস্ত চিহ্ন তিনি খুব যত্ন করে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে কি তিনি এসব সিদ্ধান্ত কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিয়েছিলেন?

মিশরীয় রানী আনখেসেনামেন রাজা তুতানখামুনের সমাধির একটি দেয়াল চিত্র © Smithsonian Magazine
আখেনাতেনের একজন উজির এবং উপদেষ্টা ছিলেন। তার নাম আইয়ি এবং তিনি বয়স্ক ব্যক্তি। আখেনাতেনের মৃত্যুর পর এই উজির আইয়ি তুতেনখামুন ও তার স্ত্রী আনখেসেনামেনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। তবে কি আইয়ি-ই সেই ব্যক্তি, যার দ্বারা তুতেনখামুন প্রভাবিত হয়েছিলেন?
তুতেনখামুনের মৃত্যুর পর ভয়ার্ত আনখেসেনামেন হিট্টাইট সম্রাট হাতুসিলিকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন যে, সম্রাটের অনেকগুলো ছেলের মাঝে কোনো একজনকে যেনো মিশরে পাঠানো হয়, যেনো সেই রাজকুমারকে আনখেসেনামেন বিয়ে করে মিশরের ফারাও বানাতে পারেন। চিরশত্রু মিশরের কোনো রাণীর কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন হিট্টাইট সম্রাট। চিঠিতে আনখেসেনামেন আরও লিখেছিলেন যে, তিনি কোনো সাধারণ দাসকে বিয়ে করতে চান না এবং তিনি ভয় পাচ্ছেন। আনখেসেনামেনের এমন চিঠি হিট্টাইট সম্রাটকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিলো। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন তিনি কখনোই হন নি। তিনি আরও এক বার বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য দূত পাঠালেন আনখেসেনামেনের কাছে। এদিকে সম্রাটের ছেলের পরিবর্তে হিট্টাইট দূতকে দেখে রেগে গেলেন আনখেসেনামেন। তিনি জানালেন যে, তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন এবং হাতুসিলি তার সময় নষ্ট করছেন। রাণীর এমন উদ্বিগ্নতা দেখে হাতুসিলি নিজের এক ছেলে জান্নানজাকে পাঠালেন রাণীকে বিয়ে করবার জন্য। পাঁচ ছেলের মধ্যে জান্নানজাই ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মিশরে পৌঁছানোর আগেই মিশরীয় সীমান্তে খুন হন জান্নানজা।

জান্নানজা © owlcation.com
ছেলের হত্যার খবর শুনে ক্রোধ ও শোকে দিশেহারা হয়ে পড়েন হিট্টাইট সম্রাট হাতুসিলি। মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন হাতুসিলি। ছেলের হত্যার প্রতিশোধ তিনি নিয়েই ছাড়বেন। আনখেসেনামেন বার বার ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির জন্য হাতুসিলিকে চিঠি দিতে লাগলেন। কিন্তু হাতুসিলি এবার আর গললেন না, বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেবার জন্য অগ্রসর হলেন। তার শক্তিশালী সৈন্যদল তছনছ করে দিলো মিশরের কিছু অঞ্চল। বন্দি করে নিয়ে আসা হলো বহু মিশরীয়কে। তবে হিট্টাইটদের ভাগ্য সত্যিই খারাপ ছিলো। সে সময়ে বন্দি মিশরীয়দের সাথে আসলো ভয়ংকর এক সংক্রামক রোগ। একটু একটু করে তা আক্রান্ত করলো হিট্টাইটবাসীদের। মৃতের ভিড় লেগে গেলো। অর্ধেক রাজ্য জনশূন্য হয়ে পড়লো। সম্রাট হাতুসিলিকেও আক্রান্ত করলো ভয়াল সেই রোগ। মারা গেলেন হাতুসিলি। মিশর ও হিট্টাইটদের শত্রুতার সম্পর্কটি আরও দীর্ঘস্থায়ী হলো, যা খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালের কাদেশের যুদ্ধের পর পৃথিবীর প্রথম মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে নিঃশেষ হয়েছিলো।

আনখেসেনামেন এবং তুতেনখামুন কথা বলছেন © Smithsonian Magazine
আর আনখেসেনামেনের কি হয়েছিলো? ১৯৩০ এর দশকে মিশরতত্ত্ববিদ অধ্যাপক পার্সি এডওয়ার্ড নিউবেরি কায়রোর একটি পুরাকীর্তি কেনাবেচার দোকানে একটি প্রাচীন আংটি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই আংটিতে হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে দুটো নাম ছিলো- আনখেসেনামেন এবং আইয়ি, যার অর্থ দাঁড়ায়, আইয়ি আনখেসেনামেনকে বিয়ে করেছিলেন। তবে আইয়ি-ই কি রাজকীয় রক্তের বাইরে সেই সাধারণ ব্যক্তি, যাকে বিয়ে করতে আনখেসেনামেন ভয় পাচ্ছিলেন?
আরও একটি বিষয় আছে। যেহেতু তুতেনখামুন খুব অল্প বয়সে হঠাৎ করে মারা যান, সেহেতু পশ্চিম উপত্যকায় তার সমাধি তৈরীর কাজ তখনও শেষ হয় নি। তাকে সমাহিত করা হয় রাজাদের উপত্যকায়। আর পশ্চিম উপত্যকায় যেখানে তুতেনখামুনের সমাধি হবার কথা ছিলো, সেখানে পাওয়া গিয়েছে আইয়ির সমাধি। তবে কি আইয়ি তুতেনখামুনের স্ত্রী ও সমাধি দুটোই কৌশলে দখল করে নিয়েছিলেন?
তুতেনখামুনের সমাধিটি তাড়াহুরো করে মাত্র ৭০ দিনে তৈরী করা হয়েছিলো এবং সমাধিটির দেয়ালে বেশ কিছু চিত্র আঁকা হয়েছিলো। একটি চিত্রে দশ জন প্রাসাদ কর্মকর্তাকে তুতেনখামুনের মৃতদেহ বহনকারী স্লেজটিকে টেনে নিতে দেখা যায়। তবে এই দশ জনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আইয়ি ছিলেন না, যা এক অদ্ভূত বিষয়। আরেকটি চিত্রে দেখা যায়, তুতেনখামুনের মুখ খোলার অনুষ্ঠানে দেবতা ওসিরিসের মতো সাদা পোশাক পরিহিত পুনরুজ্জীবিত তুতেনখামুনের মুখ স্পর্শ করে তাকে মহাপুরোহিত হিসেবে জীবন দান করছেন আইয়ি, যেখানে আইয়ি মাথায় মিশরীয় মুকুট পরে আছেন। এ সব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়, তুতেনখামুনের পর আনখেসেনামেনকে বিয়ে করে আইয়ি-ই হয়েছিলেন মিশরের ফারাও। তবে কি সত্যিই এতো কম বয়সে সংঘটিত তুতেনখামুনের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলো না? তিনি কি আসলে খুন হয়েছিলেন? আর এ জন্য কি এই উজির আইয়ি দায়ী ছিলেন?

তুতেনখামুনের সমাধি © nilecruisers.com
যদি তুতেনখামুনের মৃত্যুর পেছনে সত্যিই আইয়ি জড়িত থাকেন, তবে তা হিট্টাইট রাজকুমার জান্নানজা এর হত্যাকান্ডকেও ব্যাখ্যা করে। কারণ মিশরীয় সীমান্তে সংঘটিত হত্যাকান্ডে নিশ্চয়ই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে অন্য কারো হাত থাকা সম্ভব নয়। আর হিট্টাইট রাজকুমার মিশরে পৌঁছাতে পারলে নিশ্চিতভাবেই আনখেসেনামেনকে বিয়ে করে তিনি মিশরের ফারাও হয়ে যেতেন। আখেনাতেনের সময় থেকে সরকারি সিদ্ধান্তগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বজায় রাখা আইয়ির যদি মনে ফারাও হবার আকাঙ্ক্ষা পুষতেন, তবে অন্য যে কারো ফারাও হবার পথে তিনি বাধা সৃষ্টি করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আনখেসেনামেনকে সম্ভবত আইয়ির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়েছিলো, কেননা তুতেনখামুনের পাশে তার স্ত্রীর সমাধি পাওয়া যায় নি। তবে আইয়ির উত্তরসূরি ফারাও হোরেমহেব আইয়ি এবং তার স্ত্রীর সমাধির সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়েছিলেন। তাই আনখেসেনামেনের সমাধির তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
রেফারেন্স:
- Ankhesenamun & Zannanza: A Marriage Alliance Hindered by Murder
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা