ডারউইন যখন অরিজিন অফ স্পিসিস লিখলেন মার্কস খুঁটিয়ে পড়লেন, উৎফুল্ল হলেন, বস্তুবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার বহু মালমশলা পেলেন সেখানে। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতির পক্ষে তা কাজে লাগবে। একজন বুর্জোয়া তাত্ত্বিকের কাছ থেকে গ্রহণ করতে তিনি দ্বিধান্বিত হননি। ‘ক্যাপিটাল’ প্রকাশের পর তার একটা কপি পাঠিয়েছিলেন ডারউইনকে। কিন্তু ইতিহাস বলছে ডারউইন সেটা নেড়েও দেখেননি।
এখানেই পার্থক্য একজন বুর্জোয়া তাত্ত্বিকের সাথে একজন প্রলেতারীয় তাত্ত্বিকের। হ্যাঁ, তাত্ত্বিকেরও শ্রেণী হয়, তত্ত্বেরও শ্রেণী হয়। এমনকি বিজ্ঞান, যা চরিত্রে বিশ্বজনীন হওয়ার কথা তারও শ্রেণী হয়, কেননা বিজ্ঞানীরা শ্রেণী পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট।
প্রত্যেক তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদই তার চিন্তার বিষয়টা দেখেন নিজের শ্রেণীগত অবস্থান থেকে। ডারউইন শ্রমিকশ্রেণী থেকে উঠে আসা মানুষ ছিলেন না, মার্কসও ছিলেন না। কিন্তু মার্কস পেরেছিলেন সবকিছুকেই উৎপাদক শ্রেণীর জায়গা থেকে দেখতে। পেরেছিলেন বললে কম বলা হবে, এভাবে দেখলেই যে এতদিনের না পাওয়া উত্তরগুলোর হিসেব মিলবে; বহু বিকৃত ব্যাখ্যা সহজতর হবে।
কোপার্নিকাসের আগে অবধি যতদিন জ্যোতির্বিদ্যা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চর্চা করা হয়েছে ততদিন বহু প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক পাওয়া যায়নি। কোপার্নিকাস যখন পৃথিবীকে ছেড়ে গ্রহদের চলাচলকে সূর্যের সাপেক্ষে দেখার চেষ্টা করলেন তখনই সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে। মার্কসের ক্ষেত্রেও তাই। এতদিন সমাজ, আইন, নীতি, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সবকিছু দেখা হয়েছিল শোষকের জায়গা থেকে, যারা উৎপাদন করেনা তাদের জায়গা থেকে; মার্কস কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এলেন শোষিতকে; যারা উৎপাদন করে; যা প্রাণের, সভ্যতার মূল উৎস।
কার্ল মার্কস আধুনিক যুগে চিন্তাশীলদের জগতে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করা মানুষ। তাঁর জীবদ্দশা থেকে আজ পর্যন্ত গোটা দুনিয়াজুড়ে তাঁর মতবাদ যত মানুষ অনুসরণ করে চলেছেন, সংখ্যার বিচারে কেউ আশেপাশে নেই। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ এখনো অবধি দুনিয়াজুড়ে সবচেয়ে বেশি পঠিত বই। রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনিই। সবচেয়ে বিতর্কিতও তিনি। তাঁকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা সারাক্ষণ থাকে বিরোধীদের।
মার্কস নির্ভুল, মার্কস সফল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা – এভাবে দেখার কিছু নেই। এমনকি একান্ত অনুগামীরাও ‘সবকিছুরই উত্তর মার্কস দিয়ে গেছেন’ বলে মনে করেন না। বরং মার্কসবাদকে কিছু ভবিষ্যৎবাণীর সমষ্টির বদলে একটা পদ্ধতিতন্ত্র হিসেবে দেখাটাই সঠিক। সেটাই করেছেন পরবর্তীকালের সফল মার্কসবাদীরা।
বহুক্ষেত্রেই মার্কসের অনুমান ভুল হয়েছে তাঁর জীবদ্দশাতেই; নিজের অবস্থান বদলেছেন বারবার। আয়ারল্যাণ্ডের আন্দোলন নিয়ে ধারণা ভুল, রাশিয়া সম্পর্কে অনুমান বেঠিক, ভারতচর্চা শোচনীয়ভাবে আংশিক। তাঁর বেশিরভাগ কাজই পশ্চিম ইউরোপকেন্দ্রিক; তাতে কী ই বা আসে যায়! তাঁর উদাহরণগুলো ইউরোসেন্ট্রিজমের দোষে দুষ্ট বটে, কিন্তু তার মানে তিনি ইউরোপের কীর্তিকলাপের সমর্থক – তা মোটেও নয়; বরং তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ২৭ বছর বয়স থেকে যতদিন বেঁচে ছিলেন লোকটার নিজের দেশ বলে কিছু ছিল না, কোনো দেশের নাগরিকত্ব ছিলনা। রাষ্ট্রহীন মানুষ, এক দেশের শাসকের তাড়া খেয়ে অন্য দেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
কোনো বিষয়েই তাঁর অনীহা ছিলনা। পড়েছেন বহু। বহু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য মতামত ব্যক্ত করেছেন, মৌলিক অবদান রেখেছেন। কিন্তু মার্কসবাদ বলতে আমরা দর্শন, অর্থনীতি আর রাজনীতির বিষয়ে তাঁর মৌলিক অবদানকেই ধরব। জার্মানীর ধ্রুপদী দর্শন, ইংল্যান্ডের অর্থনীতির চর্চা ও শ্রমিক আন্দোলন এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে বিতর্কের পরিবেশ তাঁর নতুন মতবাদের ভিত্তিভূমি।
হেগেল এবং নব্য হেগেলপন্থী, বিশেষত ল্যুদভিগ ফয়েরবাদের হাত ধরে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠা করা; আ্যডাম স্মিথ রবাট ওয়েনের অর্থনীতির তত্বের সমালোচক হিসেবে ‘বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব’, ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’র তত্ত্ব উদ্ভাবন করা; প্রুঁধো, বাকুনিনদের নৈরাজ্যবাদী তত্ত্বর সাথে ক্রমাগত পলেমিকের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদ এবং শ্রমিকরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রসারিত করা, উৎপাদকের মুক্তসংস্থা প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রণয়ন তার মৌলিক কাজ।
পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতি বিষয়টাকে দেখলে মনে হবে পুঁজিপতিরাই শ্রমিকদের কাজ দেয়, তাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, পুঁজিপতিদের দেওয়া ট্যাক্সেই দেশ চলে। আর শ্রমের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখতে পাবেন শ্রমিকরাই পুঁজিপতিদের খাওয়ায়। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব থেকে দেখবেন পুঁজিপতিদের মুনাফাটা আসলে পুরোটাই শ্রমিকের শ্রম চুরি করে করা হয়। ‘মজুরি শ্রম’-র আলোচনায় মার্কস দেখাচ্ছেন কীভাবে মালিকের কাছে একজন শ্রমিক তার শ্রমশক্তিকে আর বাকি পাঁচটা কাঁচামালের মত বিক্রী করে। ঐ শ্রমটাকে সে সম্মান করেনা, কারণ ঐ শ্রমের মধ্যে সে বেঁচে থাকেনা, সে বাঁচে বাকি সময়টা; আর বাকি সময়ের বেঁচে থাকার জন্য একজন শ্রমিক ঐ একঘেয়ে, বিরক্তিকর শ্রমপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে। এখান থেকেই বুঝতে হবে শ্রমিকের ‘বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব’। বুঝতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর ভেতর থেকে চেতনার উন্মেষ হওয়ার সম্ভাবনার সূত্রটা কেননা একারণেই মার্কসের কাছে শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবী শ্রেণী। সেই ক্ষমতা দখল করতে পারে, বদলে দিতে পারে ব্যবস্থাটা।
ব্যবস্থা বদল মানে পুঁজিবাদের সাইনবোর্ড খুলে সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ড লাগানো নয়। ব্যবস্থা বদল মানে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা কোনো ব্যক্তির অধীনে না রেখে তার সামাজিকীকরণ, শ্রমিকের সামাজিক উদ্যোগ বৃদ্ধি করা, মজুরী-শ্রমিক থেকে তাকে স্বাধীন উৎপাদকে রূপান্তর করা। মার্কসের পরবর্তীতে ফলিত সমাজতন্ত্রে এই জায়গাটাই যত্ন নিয়ে করা হয়নি। উৎপাদনের উপকরণের রাষ্ট্রীয় মালিকানা হয়েছে, সামাজিক মালিকানা হয়নি। শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা ডালভাত খাওয়া রোবট থেকে বিরিয়ানি খাওয়া রোবট হয়েছে বটে, কিন্তু সে স্বাধীন উৎপাদকে পরিণত হয়নি, শ্রমিকশ্রেণীর দোহাই দিয়ে বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্তদের ক্ষমতা কায়েম হয়েছে। এটা মার্কসবাদ সম্মত নয়, এর তীব্র সমালোচনা মার্কসবাদীরাই করেছে। মার্কসবাদের বিরোধীরাও সমালোচনা করেছে, অবশ্য তারা করেছে শ্রমিকরা ডালভাতের বদলে বিরিয়ানী কেন খেতে পাচ্ছে তার জন্য গায়ের জ্বালায়। স্বাভাবিক। যাইহোক, মার্কসবাদ সম্মত নয় বলেই সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ডের আড়ালে ফিরে এসেছে পুঁজিবাদ।
এর মধ্যে দিয়ে কি মার্কসবাদ ব্যর্থ হয়ে গেল? ভ্রান্ত বলে প্রমাণ হল? দুদশক আগে খুব আলোচনা হয়েছিল – শ্রেণীযুদ্ধ নাকি শেষ, আর অন্য কোনো বিকল্প নেই। গোটা দুনিয়াজুড়ে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সামনে হাজারটা প্রতিবন্ধকতা হাজির করে ভেবে নিয়েছিল ইতিহাসের বুঝি অবসান। কিন্তু কোথায় কী? আগের দুদশকের হতাশা কাটিয়ে এদশকে আবার লড়াই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পুঁজির সাথে শ্রমের, পুঁজির সাথে না-পুঁজির, কেন্দ্রের সাথে প্রান্তের। আর সেখানেই হাতিয়ার হয়ে উঠছে মার্কসের চিন্তা। বিশ্বব্যাপী মার্কসের বই পড়ার আগ্রহ বাড়ছে। সমীক্ষা বলছে আগ্রহ বাড়ছে কিশোরদের মধ্যে। শেষ তিন দশকেও যতবার বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে ততবারই ‘ক্যাপিটাল’-র বিক্রী বেড়ে গিয়েছে, শাসকও তার রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সমাধান খুঁজতে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর পাতা উল্টিয়েছে।
মার্কস পড়ুন।
লেখা – Arijit Chakraborty
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel