ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথ

১৮৭৮ সাল, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে ১৭। কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ পড়ে মনে মনে তিনি নিজেকে নবকুমার ও নগেন্দ্র ভাবতে শুরু করেছেন। রোমান্সের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে একটু একটু। কিন্তু তার তখনো ভয় ঘুচেনি, আড়ষ্টতা কাটেনি। পরিবার তাই চিন্তিত। বিলেতে যেতে হবে, বিলেতি আদব-কায়দা রপ্ত করা দরকার। তাই লাজুক ও ঘরকুনো রবীন্দ্রনাথকে মাদ্রাজের-“তোরঘর” পরিবারে পাঠানো হলো। অসামান্য সুন্দরী- “আন্না”। যেমন গায়ের রং তেমনি তার দেহের গঠন। চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘চারমিং’। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন এই আন্নার স্মৃতিকে বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। তাকে “আপন মানুষের দ্যুতি” বলেছেন। আন্না তার হৃদয়ের অনেক অংশ জুড়ে ছিলেন ।

শুরু হলো কবির প্রবাস জীবন। বিলেতে কবির এই প্রবাস জীবনে একাধিক শেতাঙ্গী সুন্দরী নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতা এসব আধুনিক মেয়েদের সংস্পর্শে এসে কবি সব অর্থেই বিশ্বপ্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন। চরিত্রে যেটুকু জড়তা ছিল সব বুঝি এক লহমায় কোথায় উধাও হয়ে যায়। তবে এইসব নীলাক্ষি সুন্দরীদের মধ্যে একজনকে তিনি মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। তিনি হলেন লুসি স্কট।

কাদম্বরী দেবী

রবীন্দ্র জীবনে যে নারীর প্রভাব কবি কখনো অস্বীকার করতে পারেন নি, তিনি হলেন নতুন বৌঠান-” কাদম্বরী দেবী”। এই রহস্যময়ী নারী তাকে চেতন এবং অবচেতনে দারুন ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা সন্তান হওয়া সত্বেও কাদম্বরী ছিলেন সর্বগুণে গুনান্বিতা ও অনন্যা। কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে ছিল বৌদি, সে কারণে তাদের মধ্যে একটি মিষ্টি সূক্ষ্ম সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এসব আন্তরিক সম্পর্ক ঠাকুর বাড়ির পরিমণ্ডলের মধ্যে সাহিত্যপ্রেমি আবহ তৈরি করেছিল। যা কবির সাহিত্যগুনকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কাদম্বরীর আকস্মিক আত্মহনন রবীন্দ্রনাথকে শোকসন্তপ্ত করে তুলেছিল। সত্যি কথা বলতে জীবনের শেষ পর্যন্ত কবি তার প্রিয় নতুন বৌঠানকে ভুলতে পারেন নি। তাই চোখের জলে লিখেছেন একাধিক কাব্য ও কবিতা।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

কবির জীবনে এক বিদেশিনী হিসেবে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আবির্ভাব। অসুস্থ বৃদ্ধ কবি তখন চলেছেন পেরু দেশের উদ্দেশ্যে। মাঝে কিছু কালের যাত্রা বিরতিতে নামতে হল আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স শহরে। কবি কি আর জানতেন যে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষারত এক মধ্য বয়সি শিক্ষিত নারীর কথা! জীবনযুদ্ধে যাকে বার বার রক্তাত্ব এবং পরাজিতা হতে হয়েছে। কেউই তাকে কাক্ষিত শান্তি দিতে পারেনি। আত্মহননের চরমতম মুহূর্তে যিনি ব্যথার উপশম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, কবির লেখা ‘গীতাঞ্জলির’ অনবদ্য কবিতাগুলো।

অবশেষ, প্লাতা নদীর ধারে শুরু হল তাদের কাব্যময় জীবনযাপন। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও শুরু হলো নতুন নতুন কাব্যের সৃষ্টি। এই সম্পর্কগুলো ছিল স্বর্গীয়। কবির জীবন ম্যল্যায়ন করার অধিকার আমাদের নাই। তাঁর সাথে আমাদের পরিচয় তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। তাঁর সৃষ্টিগুলো আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার।