‘ক্যারাভানসরাই’ একটি ফারসি শব্দ। ক্যারাভান বলতে দীর্ঘ যাত্রার উদ্দেশ্যে বিশাল পথ পাড়িরত পথিকদেরকে বোঝায়। তারা বণিকও হতে পারেন, আবার তীর্থযাত্রীও হতে পারেন, কিংবা পর্যটকও হতে পারেন। আর এসব বণিক ও পথিকদের রাত্রিবাস ও বিশ্রামের জন্য মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রসারিত পথের ধারে তৈরী গ্রাম্য বসতি বা সরাইখানাকেই বলা হয় ক্যারাভানসরাই।

আমরা সবাই-ই জানি সিল্ক রোডের গল্প। প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফারসি রয়্যাল রোড সুসা শহরকে তুরস্কের আধুনিক ইজমির সাথে সংযুক্ত করেছিলো এবং এক জটিল বাণিজ্যিক যোগাযোগের পথ হিসেবে ধরা দিয়েছিলো। সিল্ক রোড ছিলো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সাথে চীন এবং সুদূর প্রাচ্যের সংযোগকারী বাণিজ্য পথের একটি নেটওয়ার্ক। পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে যোগাযোগ স্থাপনকারী এই রোড প্রতিষ্ঠিত হয় যখন চীনে হান রাজবংশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্য শুরু করে। সিল্ক রুটগুলো ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। যখন অটোমান সাম্রাজ্য চীনের সাথে বাণিজ্য বর্জন করে, তখন রুটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও সিল্ক রোডকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহারের প্রায় ৬০০ বছর হয়ে গেছে, তবু আজও বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে এই রোডের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিদ্যমান।

উত্তর সিরিয়া একটি ক্যারাভানসরাই

কালাত আল মাদিকের ক্যারাভানসরাই, উত্তর সিরিয়া, Photo credit: Wikipedia

মানুষ স্বভাবতই আত্মোন্নয়ন করার জন্য সদা সচেষ্ট এবং এ জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না সে। তাই অসংখ্য মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিতে শুরু করলেন। আর এ জন্য তাদেরকে হাজার-হাজার মাইল পাড়ি দিতে হতো। কিন্তু পরিবেশ ছিল সেখানে ভীষণ বিপদসঙ্কুল। চোর-ডাকাতের ভয় তো ছিলোই, সেই সাথে বৈরী আবহাওয়াও মোকাবেলা করতে হতো তাদেরকে। যখন রাত নামতো, বিপদের মাত্রা যেনো সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যেতো। এমন কঠিন পরিস্থিতি তৈরী হতো যে, সামনে আর অগ্রসর হওয়া যাবে কি না তা নিয়ে চিন্তায় পড়তে হতো তাদেরকে। এই সমস্ত প্রতিকূলতার কথা ভেবেই পথিকদের বিশ্রাম এবং নিরাপত্তার জন্য সরাইখানার ব্যবস্থা শুরু হয়।

এসব সরাইখানায় আশ্রয় নিয়ে কাফেলার মানুষগুলো দস্যু ও কঠোর আবহাওয়া থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। সিরিয়া, ঢাকার ছোট কাটরা, বড় কাটরা, ভারতের নূর মহল -এগুলো এ ধরনের সরাইখানারই উদাহরণ।

শাসকেরা জানতেন, যতো ব্যবসা, ততো বেশি কর আদায়। সে জন্য তারাও মনোযোগী ছিলেন এসব সরাইখানা তৈরীর ক্ষেত্রে। সম্রাট আকবরের সময়ে ক্যারাভানসরাই এর ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবে আকবর মূলত সরাইখানাগুলো তৈরী করতেন ব্যবসায়ীদেরকে নজরদারির মাঝে রাখবার জন্য। প্রত্যেক সরাইখানায় তার নিয়োগ করা একজন ‘আমিন-ই-কারওয়ানসরা’ থাকতেন, যেনো সন্দেহজনক কোনো কিছু চোখে পড়লে সম্রাটকে অবহিত করতে পারেন।

ইরানের একটি ক্যারাভানসরাই

ইজাদখাস্ত ক্যারাভানসরাই (১৭শ শতাব্দীর প্রথমদিকে), ফর্স প্রদেশ, ইরান, Photo credit: Wikipedia

অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিরাও এসব ক্যারাভানসরাই নির্মাণ করতেন। প্রথম দিকে সরাইখানায় আসা অতিথিদের খাবারের কাঁচামাল তাদের নিজেদেরকেই কিনে আনতে হতো। সরাইখানার কর্মচারীরা সেসব খাবার রান্না করে দিতেন। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটে।

মধ্যযুগের ব্যবসায়ীরা যেহেতু অত্যন্ত মূল্যবান পণ্য, অর্থ-কড়ি, দামী রত্ন, সিল্ক ইত্যাদি নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ব্যবসা করতে যেতেন, সেই কারণে এই সরাইখানাগুলোকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এর দেয়ালগুলো অনেক উঁচু করে তৈরী করা হতো। যে দরজার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে হতো, সেটিকেও সুরক্ষিত রাখার জন্য অস্ত্র হাতে প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকতেন। নিচতলায় যাত্রীদের বহন করা মালামাল বা যে সমস্ত প্রাণীদের সাহায্যে তারা চলাফেরা করতেন, তাদের রাখার ব্যবস্থা ছিলো।

বিশ্রাম নেবার জন্য তৈরী ঘরগুলো খুব যে সাজানো-গোছানো থাকতো, তা নয়। তবে কোনো কোনো সরাইখানায় প্রার্থনা কক্ষ ছিলো, স্নানাগার ছিলো। অনেক ক্ষেত্রে বণিকেরা সরাইখানার ভেতরে বসেই তাদের পণ্য বিক্রির কাজ শেষ করে ফেলতেন। সিল্ক রোডের সরাইখানাগুলোতে চীন, সৌদি, ভারত, কখনো আবার মিশর থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক এসে একসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। আর এভাবেই এই সরাইখানাগুলো একটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্রও হয়ে উঠেছিলো। এখানে পূর্ব ও পশ্চিমের লোকদের দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের ধর্ম, দর্শন ইত্যাদির মধ্যে বিনিময় ঘটতো।

অরবেলিয়ানর ক্যারাভানসরাইয়ের ভিতরে

আর্মেনিয়ার অরবেলিয়ান ক্যারাভানসরাইয়ের অভ্যন্তরভাগ, Photo credit: Wikipedia

সিল্ক রোডের মাধ্যমেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষ থেকে চীনে গিয়েছিলো। ইসলাম ধর্ম সারা পৃথিবীতে এই রোডের পথ ধরেই ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ধর্মের বিস্তারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ধর্ম, সংস্কৃতি, দর্শন, খাদ্যাভ্যাস, শিষ্টাচার, জ্ঞান -সমস্ত কিছুর বিনিময়ের কেন্দ্র ছিলো এই সরাইখানা বা ক্যারাভানসরাইগুলো। এভাবেই রোমের অলিভ অয়েল বা জলপাই তেলের ব্যবহার এই ভারতীয় উপমহাদেশে এসে স্থান করে নিয়েছিলো। আবার রোমের শুরাকেও ভারতীয় উপমহাদেশের বিলাস পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

 

রেফারেন্স:

Caravanserai- National Geographic

Caravanserais: cross-roads of commerce and culture along the Silk Roads