ইতিহাসে যে কজন প্রাচীন পণ্ডিত অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন চাণক্য। এই উপমহাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বে তাকে অন্যতম বাস্তববাদী পণ্ডিত মনে করা হয়। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, লেখক, দার্শনিক, এবং কূটনীতিবিদ ছিলেন। আমরা সবাই তার জ্ঞান ও কর্ম সম্পর্কে কমবেশি জ্ঞাত ।তবে, হয়তো অনেকেই জানিনা কিভাবে এই মহামতির মৃত্যু হলো।
রাজ্য জুড়ে অপ্রতিরোধ্য খরার মুখে যেন ভেঙে পড়লেন চন্দ্রগুপ্ত। আচার্য চাণক্যের কাছে এসে চাইলেন ক্ষমতা থেকে বিদায়। চাণক্য বাধা দিলেন না। চব্বিশ বছরের প্রজাকল্যাণমুখী রাজশাসনের উপান্তে ছেলে বিন্দুসারকে রাজ্যপাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চললেন শ্রবণবেলগোলের পথে, নিজের স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অভীপ্সায়।
জৈনমতে উপবাসী হয়ে সেখানেই প্রয়াত হলেন চন্দ্রগুপ্ত। এত দিনের প্রিয় শিষ্যকে হারিয়ে গভীর এক শূন্যতায় ডুবে আছেন চাণক্য। জনজীবন থেকে ক্রমশই যেন দূরে সরে যাচ্ছিলেন তিনি। ভাবছিলেন বিন্দুসারকে বলে, সুযোগ্য শিষ্য রাধাগুপ্তকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে রাজকার্য থেকে এবার বিদায় নেবেন তিনিও। তার মধ্যেই একটা খবর যেন একেবারে দুর্বল করে দিল তাঁকে। রাধাগুপ্তের থেকে শুনলেন, বিন্দুসারের কান ভাঙিয়ে তাঁকে ভয়ংকর খেপিয়ে তুলেছেন ক্ষমতাপিয়াসী মন্ত্রী সুবন্ধু।
মন্ত্রী সুবন্ধুর কথায় বিন্দুসার নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন যে, চাণক্যই বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন তাঁর জন্ম কালে মৃত্যু হওয়া মা-কে। শুনে একেবারে যেন পাথর হয়ে গেলেন চাণক্য। রাধাগুপ্তকে বললেন, উপবাসের মাধ্যমে তাঁর স্বেচ্ছা-মৃত্যুর বেদী রচনা করতে। ওদিকে ক্রোধে, বিস্ময়ে আর সত্যের আশঙ্কায় কাঁপছেন বিন্দুসার। চাণক্যকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন তিনি। রাজপ্রহরীকে ফিরিয়ে দিলেন আচার্য চাণক্য। বললেন, তাঁর স্বেচ্ছা মৃত্যুর প্রহর আসন্ন, তিনি আর যাবেন না রাজদরবারে। ‘বিশ্বাসঘাতক’ চাণক্যের অপেক্ষায় অস্থির প্রহর গুনছেন বিন্দুসার, রাজসভায় ছুটে এলেন এক পরিচারিকা। বললেন, সত্যের সূত্র ধরিয়ে দিতে চান সম্রাট বিন্দুসারকে, না হলে ভয়ানক অবিচার হবে চাণক্যের প্রতি। বললেন, তিনিই সেই নারী, বিন্দুসারের জন্মের লগ্নে, রানির মৃত্যুর প্রহরে উপস্থিত ছিলেন যিনি। বিন্দুসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘পরিচারিকাদের সাক্ষ্য গ্রহণের সময় তাহলে কেন আপনি আসেননি সাক্ষ্য দিতে ?’’ মাথা নিচু করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উপদেষ্টা চাণক্য , শত্রু দ্বারা বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টার বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিষেধক তৈরী করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে তার অজান্তে অল্প মাত্রায় বিষ পান করাতেন শত্রুর সম্ভাব্য বিষের আক্রমণ থেকে তাঁর পিতাকে বাঁচাতে। চন্দ্রগুপ্তের শরীর এক সময় যে কোনও বিষের দংশন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পাবে – সেটাই ছিল চাণক্য এর উদ্দেশ্য। কিন্তু অভ্যাস ভেঙে নিজের খাবার যেদিন চন্দ্রগুপ্ত ভাগ করে খেতে গেলেন স্ত্রী দুর্ভারার সঙ্গে, সেদিন সেই সামান্য বিষই কেড়ে নিল গরলে অনভ্যস্ত তাঁর অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীর জীবন।আর সাতদিন পরই তার সন্তান প্রসবের কথা ছিলো।
দুর্ভারার বিষক্রিয়ার খবর পেয়ে ছুটে এলেন চাণক্য। বিষের তেজে এলিয়ে পড়েছেন দুর্ভারা। খাবারের থালা হাতে দুর্ভারার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে দেখে চমকে উঠলেন চাণক্য। চাইলেন একটা ছুরি। দুর্ভারার গর্ভ থেকে তারপর তুলে আনলেন এক শিশুপুত্রকে। চন্দ্রগুপ্তের কোল আলো করে এলেন বিন্দুসার আর মন কালো করে চলে গেলেন দুর্ভারা।বৃদ্ধা বললেন, চাণক্য নির্দোষ তাঁর মায়ের মৃত্যুর ঘটনায়। আরও বললেন, ‘‘মহারাজ, বিষের আক্রমণ থেকে বিদগ্ধ ক্ষিপ্রতায় আপনাকে বাঁচিয়ে সেদিন পৃথিবীর মুখ দেখান আচার্যই। তবু একবিন্দু বিষ মাতৃগর্ভে ছুঁয়ে ফেলে আপনার কপাল। তাই মহারাজের কপালে আজও একটি নীল টিকা, তাই মহারাজের নাম বিন্দুসার।’’ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ বিন্দুসার। মনে আত্মগ্লানি নিয়ে আচার্যের বাড়ির দিকে ছুটলেন বিন্দুসার। রাস্তায় শুনলেন নিজের পার্থিব ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে চলেছেন আচার্য চাণক্য।তাঁর প্রাঙ্গণে যখন পৌছলেন, তখন ধ্যানস্থ চাণক্য। ক্ষমা চাইলেন বিন্দুসার। মৃদু হাসলেন আচার্য। তার পরই হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তাঁর ধ্যানের বেদী। যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ দেখলেন, আগুন লাগিয়ে দূরে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছেন কুচক্রী সুবন্ধু। চাণক্যকে উদ্ধার করে আনা হল যখন, ততক্ষণে নিথর তাঁর শরীর।এভাবেই চির বিদায় নিলেন সর্ব কালের সেরা কূটনীতি ও রাষ্ট্র নীতিবিদ ,ভারত গর্ব মহামতি চানক্য।
এখানে উল্লেখ্য যে জৈন সাহিত্য বলে‚ সুবন্ধু ক্ষমা চাওয়ার ছলে গিয়ে চাণক্য যে জ্বালানির স্তূপে বসেছিলেন তাতে আগুন ধরিয়ে দেন । শাস্তিস্বরূপ সুবন্ধুকেও প্রাণদণ্ড দেন বিন্দুসার।
তথ্য সূত্র – 1. ‘The Arthashastra’, Kautilya, Tr. L.N. Rangarajan 2. ‘Chandragupta Maurya and His Times’, Radha Kumud Mookerji. 3.‘Chanakya: The Master of Statecraft’, Deepa Agarwal 4. ‘Chanakya: The Kingmaker and the Philosopher’, Ed. Anu Kum