পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে পা দিতেই দেখি সবাই ব্যস্ত! বাড়ি লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। বাড়ির লোকজনের পাশাপাশি নায়েব- গোমস্তা, চাকর- বাকর দিয়ে এলাহি কারবার,জমিদার বাড়ি বলে কথা!
বিশাল লাল বাড়িটায় ঢুকতেই হাতের ডানদিকে নাট্যমঞ্চ, সেখানে একটা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, রবী ঠাকুরের সুরেলা চিকন গলায় নাটকের সংলাপ শোনা যাচ্ছে! পরিবারের মানুষরাই নাট্যশিল্পী এবং দর্শক, বাইরের কেউ নাই।
আমার বর ধাক্কা দিয়ে বললো, ওদিকে কি দেখছো,ভিতরে যাবেনা? নিজের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলাম।
‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে’
ঠাকুর বাড়িতে আমার মনটা কিছুক্ষন সেই সময়ে পরিভ্রমণ করে ফিরে এলো।
বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে লাল বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু দর্শনার্থীদের দেখা যাচ্ছে, তারা ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখছে, ছবি তুলছে, তবে ভেতরে ছবি তোলা বারন।
কবির পরিপাটি শয়নঘরের আলমারিতে ঝুলছে লম্বা আলখাল্লা, মনে হচ্ছে কবি এখনি এসে সেটি গায়ে চাপাবেন!
পড়ার ঘরে কবির ব্যাবহৃত জিনিষপত্রগুলি সাজানো গুছানো।
বারান্দায় যেখানে তাঁর অপারেশন হয়েছিলো, সেই জায়গাটিকে ঘিরে রাখা হয়েছে।
কবির শিল্পকর্মগুলি রয়েছে আলাদা একটি ঘরে।
কবির একটি সত্তা আছে, আর সেটা হচ্ছে শিল্পী বা ‘চিত্রকর’। এই পরিচয়টা জনসম্মুখে খুব কমই আসে, এটা আড়ালেই থেকে যায়।
এটা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—-
‘রবীন্দ্র চিত্রকলা জগতের অভিনব সৃষ্টি- অনন্য সাধারণ। তাঁর চিত্রকলা একান্তরূপে তাঁর নিজস্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়াও অসম্ভব। কোনো কলা সমালোচক যে একে কোনো বিশিষ্ট কলারীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখাবেন কিংবা তাঁর নিজস্ব কোনো ধরাবাধা তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবেন তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।’
রান্নাঘরে উঁকি দিলাম, মৃণালিনী দেবী রান্না করছেন আর দোরের কাছে মোড়ায় বসে কবি তাঁর স্ত্রীকে কিছু রান্নার রেসিপি বলছেন!
নাহ্, এখানেও কেউ নাই। রান্নাঘরটাও এখন নিরব, দ্রষ্টব্য।
তিনতলা বন্ধ করে রাখা হয়েছে, শুনলাম সেটা ছিলো রবির নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর।
তিনতলাটা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো, দুজন সমবয়সী বন্ধু -বৌঠান আর ঠাকুরপো’র কত সুন্দর মুহুর্ত কেটেছে সেখানে। আবৃত্তি, গানে সন্ধ্যাগুলি থাকতো মুখরিত।
রবির বিয়ের পরে তাদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে, দুজনের মাঝে চলে আসে যোজন যোজন দুরত্ব । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন কেনা পানির জাহাজে রবির নতুন বউসহ পরিবারের সবাই গেল উৎসব করতে, সেখানে কাদম্বরীকে নেয়ার কথা কারো মনেই এলোনা! এমনকি তার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও না। তাইতো প্রবল অভিমানে তিনি আত্মঘাতী হবার মতো সিদ্ধান্ত নিলেন।
তার আত্মা কি এখনও গুমরে কাঁদে তার প্রিয় ঠাকুরপো’র জন্য!
সব দেখে বেরিয়ে আসছি, গ্যারেজে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাড়িটা, সেই গাড়ির মালিক আর কোনদিনই এই গাড়িতে চড়বেনা এখন সেটা শুধুই একটি দর্শনীয় জিনিষ।
সবশেষে কবির উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলি
তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম’।