ড. শাহনাজ হুসনে জাহান ৮ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সভ্যতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই সভ্যতা ভিতরগড় দূর্গনগরী নামে পরিচিতি পায়। কুচবিহারের বংশ লতিকায় রাজা পৃথুর নাম উঠে আসে। ধারণা করা হয়, এই ভিতরগড় ছিল পৃথু রাজার রাজধানী। তবে ইতিহাসে পৃথু রাজা বা তার রাজ্য সম্পর্কে তেমন কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি বলে, লোককাহিনীগুলো থেকেই আমরা ইতিহাস জানার ক্ষুধা মিটাই। ১৩ শতকে পৃথু রাজার রাজত্ব শুরু হলেও মনে করা হয় যে এই এলাকায় বসতি শুরু হয় ৭ বা ৮ শতকের গুপ্ত যুগের সময় থেকে এবং তার প্রমানও পাওয়া গিয়েছে। লোককাহিনী মতে পৃথু রাজা কীচক নামে অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী দিয়ে আক্রান্ত হলে নিজের মর্যাদা রক্ষায় সপরিবারে আত্মহত্যা করেন মহারাজার দীঘিতে, যে দীঘিটি তারই খনন করা। সত্যিই পৃথু রাজা আছে কিনা তা আমরা জানিনা, তবে কে এই পৃথু রাজা তা কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

বিস্ময় জাগানো এই সভ্যতাটি করতোয়া ও তিস্তা নদীর মাঝখানে সমতল ভূমিতে অবস্থিত ছিল। এই দূর্গনগরীটি চারটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। ধারণা করা হয় বন্যা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এই বাঁধগুলো তৈরী করা হয়েছিল। এতো বছর আগেও এতো সুন্দর ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির ব্যবহার সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতন। চারটি আবেষ্টনীর ভিতরে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে অসংখ্য ধর্মীয় স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, দুটি প্রাচীন মন্দির এবং মূল্যবান প্রত্নবস্তু। শালমারা নদীর উপর পাথরঘাটা ও দোমনী নামের জায়গায় তৈরী করা হয়েছিল পাথরের দুটি বাঁধ। এর মাধ্যমে প্রাচীন কালে নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সারা বছর দূর্গনগরীর জন্য পানি সংরক্ষণ করা হতো।

প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড়ের অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভূটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার, পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। সম্ভবত নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে এতো বড় সভ্যতাটি ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো। এটি শুধু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূর্গনগরী নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দূর্গনগরীর একটি। এই দূর্গনগরে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আটটি স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো থেকে লাল ও ধূসর রঙের নকশা করা মাটির পাত্রের ভাঙা অংশ, লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। মাটির পাত্রের মধ্যে রয়েছে থালা, বাটি, রান্নার হাঁড়ি ও মাটির প্রদীপ।

আমাদের দেশের চারিদিকে গর্ব করা মতো অনেক কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আমাদের ও আমাদের সন্তানদেরকে তা অবশ্যই জানতে হবে।