আজকে ২০২১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশকে আমরা দেখছি, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ কিন্তু তেমন ছিলো না। তখন এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলা হয়েছিলো। দেশটিকে তলাবিহীন দেশ করার জন্য কিন্তু আমরা দায়ী ছিলাম না। টাইম মেশিনের মাধ্যমে আমরা যদি পেছনে ফিরে যাই, তাহলে দেখবো বৃটিশরা কিভাবে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো। আর কিভাবে বাংলা থেকে তারা কোটি কোটি টাকা লুট করেছিলো, যার উপরে ভর করেই ইংল্যান্ড একটি শক্তিশালী দেশ নির্মাণ করতে সক্ষম হয় এবং তাদের শিল্পবিপ্লবকে বাস্তবায়ন করে। ‘বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ একটা কোম্পানি হয়ে কিভাবে একটা দেশ দখল করে শাসন করলো তার ইতিহাস আমাদেরকে জানতেই হবে। শুধু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বাংলার হেরে যাওয়ার জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে দায়ী করে বসে থাকলে চলবে না। তাহলে সেখানে পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যাবে না।
সেজন্য, এখন সময় এসেছে, আর তাই আমরা বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ে কাজ করছি।
ঐতিহাসিক ব্রুক অ্যাডামস ১৮৯৬ সালে লিখেছিলেন যে, এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ইউরোপের ভাগ্য বাংলা বিজয়ের উপর নির্ভর ছিলো। জনগণ আজকে যে দরিদ্র বাংলাদেশকে দেখছে, তা সে সময় কল্পনাতেও ছিলো না। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ছিলো এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাংলা তখন বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা থেকে উত্তর ভারতের বেনারস পর্যন্ত বিস্তৃত এক এলাকা। এই স্বাধীন দেশের জনসংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন, যা সেই সময়ের ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় চারগুণ বেশি। বাংলার গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে তখন প্রচুর চাল, মাছ এবং পাট উৎপাদিত হতো। প্রদেশটি ছিল উৎপাদন কার্যক্রমে সর্বদা কর্মচঞ্চল। তখন ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। ইউরোপে তা চড়া দামে বিক্রি হতো। এছাড়া আফ্রিকার তানজানিয়া থেকে আমদানি করা লোহার আকরিক ব্যবহার করে বাংলা সেরা ইস্পাত তৈরি করতো, যা ছিল বৃটিশদের কাছে আরো লোভনীয় পণ্য। তাই সস্তা ও উন্নত কাঁচামালের জন্য ইউরোপীয়রাও সমৃদ্ধ বাংলায় একের পর এক বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে ছুটে এসেছে। পর্তুগীজ, ডাচ, ওলন্দাজ, ফরাসি, জার্মানি ও ইংরেজ বণিকরা এদেশে এসেছিলেন। এমনকি আমেরিকান বণিকরাও বাদ যায়নি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পুরো ইউরোপের ভাগ্য বদলে যায় বাংলায় আসার ফলে। আর এই বাংলা বিজয়ের উপরেই আজকের লন্ডন গড়ে উঠেছে। অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, বৃটিশদের দখলের দশ বছরের মধ্যেই এশিয়ার এককালের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ বাংলা একবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। এটি কিভাবে ঘটেছিলো তা বোঝার জন্য আমাদেরকে ১৮ শতকের গোড়ার দিকে কিছু রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে ফিরে যেতে হবে।
১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের অদম্য শক্তি যেনো বার্ধক্যে পরিণত হলো। প্রিন্স মুয়াজ্জাম কাবুল থেকে দ্রুত দিল্লী এসে বাহাদুর শাহের উপাধি নিয়ে ভারতের লাল দুর্গের সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তিনিও ষাট বছরের একজন বৃদ্ধ সম্রাট, ফলে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সেই শক্তি ও ক্ষমতা আর দেখাতে পারেন নি। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের ভেতর বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। এই সময় আবার মারাঠারা দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭০৮ সালে গুরু গোবিন্দ সিং-এর মৃত্যুর পর মুঘল ও শিখদের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর আবার বান্দা সিং-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবেও শিখদের বিদ্রোহ শুরু হয়। মুঘল সেনাবাহিনী প্রধান শহরগুলো পুনরায় দখল করলেও শিখরা উত্তর পাঞ্জাবের পাহাড় থেকে মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছিলো। একের পর এক যুদ্ধ-সংঘর্ষে ক্লান্ত হয়ে বাহাদুর শাহ ১৭১২ সালে মারা যান। এর পরপরই মুঘলদের কাছ থেকে অনেক রাজ্যই প্রায় স্বাধীন হয়ে যায়।
দিল্লীর দরবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে উত্তরাধিকারী আজিম-উস-শান ও তার দুই ভাইয়ের মধ্যে। সেনাবাহিনীর জেনারেল জুলফিকার খানের প্ররোচনায় আজিম-উস-শান তার দুই ভাইকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু তার পরিবর্তে জাহান্দার শাহ নতুন রাজা হলেন, যে কিনা সবসময় লাল কুনওয়ার বাঈজীর ঘরেই বেশি সময় কাটাতেন।
এই সময় আজিম-উস-শানের বড় ছেলে ফরুখশিয়ার (১৭১৩-১৭১৯) পিতা হত্যার বদলা নিতে বাংলায় সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং হাসান আলি ও হুসেন আলি নামে দুই সাইয়িদ ভাইকে সাহায্য করতে দিল্লী যাত্রা করেন। সেই সংঘর্ষে জাহান্দার শাহ ও জুলফিকার খান দুজনেই নিহত হয়েছিলেন। দুই সাইয়িদ ভাই দিল্লী দরবারে বিপুল ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। হুসেন আলি পুরস্কার হিসাবে দাক্ষিণাত্যের রাজত্ব পেয়েছিলেন। তবে হাসান আলির সাথে সম্রাটের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিলো। পরে সাইয়িদ ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ফরুখশিয়ারকে অন্ধ করে দিয়েছিলো এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে কারাবন্দি করে রেখেছিলো। তারপর মুহম্মদ শাহের নাতনি রওশন আক্তার নতুন সম্রাট হন এবং তিনি আফগান ও ইরানি অভিজাতদের সাথে জোট বেঁধে সাইয়িদ আলি ভাইদের কঠোরভাবে দমন করেন।
আফগান নেতা চিন কিলিচ খানকে ‘নিজাম-উল-মুলক’ উপাধি দিয়ে দিওয়ান করা হয়েছিলো। তিনি সাম্রাজ্যের পতনকে ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন, তবে সেটা অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিলো। পরে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি ১৭২৩ সালে দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং সেখানে তিনি হায়দ্রাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত হায়দ্রাবাদ রাজ্য ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। একইভাবে, বাংলা ও আউধ ১৭২২ সালে মুঘল শাসন থেকে ভেঙে পড়ে। এই প্রদেশগুলিই ছিলো মুঘলদের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয়ের এলাকা। যদিও স্থানীয় শাসকরা মুঘল সম্রাটকে নামমাত্র অধিপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতো, তবে তারা সকলেই স্বাধীনভাবে শাসন চালাতো।
ইতোমধ্যে, মারাঠারা মধ্য ভারতে তাদের শাসন কায়েম করে। ১৭৩২ সালে তারা গুজরাট প্রদেশ দখল করে নিয়েছিলো এবং সুরাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রটি তাদের হাতে চলে যায়। আরো উত্তরে অগ্রসর হয়ে বাজি রাওয়ের বাহিনী ১৭৩২ সালে দিল্লীর উপকন্ঠে চলে আসে। মুঘল সম্রাট হায়দ্রাবাদের নিজামকে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠালেও কোনো সাড়া পান নি। বাজি রাওয়ের কারণে যেমন এই সময়ে ভারতে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ইউরোপীয়ানদের বারবার হামলাতেও পুরো শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্থ হয়ে যায়।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মুসলমানরা ধরাশায়ী হতে থাকে। ইরানের সাফাভিদ বংশ, তুরস্কের অটোমানদের নাজুক অবস্থা মুসলিমদের পতনের ডাক দিচ্ছিলো। ১৭২২ সালে সাফাভিদ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন ঘটে এবং আফগানরা এর রাজধানী দখল করে রাশিয়ান ও অটোমানদের হস্তক্ষেপ দেখে যায়। কিন্তু পারস্যের সাফাভিদ সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল নাদির কুলির আক্রমনে রাশিয়ানদের তাড়িয়ে দেয় এবং অটোম্যানদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে আনে। সাফাভিদ শাহ তাহমাসকে নাদির শাহ অযোগ্য বলে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নিজেকে পারস্যের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। এই নাদির শাহই আবার ভারত আক্রমন করে বসেন।
আমরা যদি আরেকটু পেছনে যাই, তাহলে দেখবো পূর্ব দিকে কান্দাহারের দিক থেকে আফগানরা পারস্য আক্রমণ শুরু করলে নাদির শাহ মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের কাছে আবেদন করেছিলেন, যেনো তিনি আফগান বিদ্রোহীদের কাবুলে পালাতে বাধা দেন। কিন্তু মুঘলরা কোন সাহায্য না করলে নাদির শাহ খুবই রেগে যান। পরবর্তীতে আফগানদের দমন করে কান্দাহার দখল করেন ১৭৩৭ সালে এবং খাইবার পাড়ি দিয়ে পেশোয়ার হয়ে ১৭৩৮ সালে কাবুল দখল করেন। ১৭৩৮ সালের শীতকালে তিনি মুঘলদের দিকে অগ্রসর হয়ে ১৭৩৯ সালে লাহোর দখল করেন এবং প্রচুর লুটপাট চালান। আগ্রাসী নাদির শাহ দিল্লীতে এক বার্তা পাঠান, যেখানে তিনি বলেন যে, দরবারের যারা তাকে অসম্মান করেছে, তাদেরকে শাস্তি দিতেই তিনি ভারতে এসেছেন।
মুঘল সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের কর্নালের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো নাদির শাহের বাহিনীকে মোকাবেলা করতে। পার্সিয়ানরা মূল ভারতীয় বাহিনীকে এড়িয়ে আক্রমণ করার পরিবর্তে, তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মুঘল জেনারেলদের বাহিনীগুলোকে আক্রমণ করে এবং একে একে তাদেরকে হত্যা করে। তারপর কামানের গোলা-বারুদ দিয়ে ভারতীয় পদাতিক এবং হাতি বাহিনীকে হামলা চালিয়ে এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি করে। এই সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক খান-ই-দুরান নিহত হন এবং আউধের গভর্নর বুরহান-উল-মুলক বন্দী হন। অবশেষে, মুঘল সম্রাট শান্তির প্রস্তাব করেন।
এবার বন্দী অবস্থায় বিশ্বাসঘাতক বুরহান-উল-মুলক তার নিজের সম্রাটের বিরুদ্ধে গিয়ে পারস্য রাজতন্ত্রকে মুঘলদের কাছ থেকে বিশ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ দাবি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্য নাদির শাহের কাছে তিনি নিরস্ত্র মুঘল সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফের পদের আবেদনও করেছিলেন। মুহাম্মদ শাহ নিজাম-উল-মুলকের পরিবর্তে বুরহান-উল-মুলককে চাকরিটি দিয়েছিলেন। আর সেই প্রতারক বুরহান-উল-মুলকই পারস্য বাহিনীকে পূর্বের দিকে দিল্লী অভিমুখে যাত্রার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
বিজয়ী নাদির শাহ মুঘল সম্রাটের ‘অতিথি’ হিসেবে রাজধানীতে পৌঁছান। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে ও শান্তি আলোচনা চলাকালীন সময়ে নাদিরকে হত্যা করা হয়েছে বলে একটি গুজব ছড়িয়ে যায়। দিল্লীর নাগরিকরা তাণ্ডব চালিয়ে কয়েকশ পারসিক সৈন্যকে হত্যা করেছিলো। এতে ভীষন ক্ষুব্ধ হয়ে নাদির শাহ দিল্লীর সকলকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তৈমুরের আক্রমণের পর দিল্লির মানুষ এমন ধ্বংস আর দেখে নি। প্রায় এক লক্ষাধিক নাগরিককে খুন করেছিলো নাদির শাহের বাহিনী। অবশেষে, মুহম্মদ শাহ নাদির শাহের ছেলের সাথে মুঘল মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পরে যুদ্ধ থামে।
এই সময়েই শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন এবং মুঘলদের কোষাগারের সোনা, হীরে, রুবির পুরো সংগ্রহ লুট করে নাদির শাহ নিয়ে গিয়েছিলেন। নাদিরের সৈন্যরা বিপুল পরিমাণের জমা সম্পত্তি লুট করে অভিজাতদের নির্যাতন করেছিলো। সেইসব সোনা ও মূল্যবান পাথর বোঝাই করতে ৭০টি উটের প্রয়োজন হয়েছিলো। ইরানে ফিরে নাদির শাহ তার বিশাল সাম্রাজ্যে তিন বছরের জন্য কর মাফ করে দিয়েছিলেন। নাদির শাহ তার সাম্রাজ্যকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছিলেন, বর্তমান পাকিস্থানের বেশিরভাগ এলাকায় তার রাজত্বের অংশ ছিলো।
নাদির শাহ চলে যাবার পর দিল্লীর রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে মারাঠারা মধ্য ভারত থেকে দিল্লীতে প্রবেশ করে। শিখরাও পুনরায় তাদের সেনাদের একত্রিত করে পাঞ্জাবে। অন্যদিকে বাংলা, আউধ এবং হায়দ্রাবাদ কার্যত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। এই বিস্তৃত প্রদেশগুলোর রাজস্ব বঞ্চিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। এখান থেকেও বোঝা যায় যে, মুঘলদের শক্তি, সম্পদ, বীরত্ব সব ক্ষয় হয়ে গেছে ততোদিনে। এভাবেই বিরাট অখন্ড মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। তখন শুধুমাত্র দিল্লীর লাল কেল্লার কয়েক বর্গমাইলের মধ্যেই তাদের ক্ষমতার কিছুটা ছায়া বাকি ছিলো।
নবাব মুর্শিদ কুলি খান এবং তারপর নবাব আলীবর্দী খান বৃহত্তর বাংলা প্রদেশের নবাব হয়ে শাসন করেছিলেন ১৭২২ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত । ১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। এতে মীরজাফর বেশ হতাশ হন। তিনি ছিলেন সম্পর্কে আলীবর্দী খান এর বোনের স্বামী। মনে মনে তিনি পরবর্তী নবাব হওয়ার আশা করেছিলেন। যার জন্য তিনি কাছে পেয়েছিলেন জগৎশেঠ, রায় বল্লভ ও আরো অনেককে। ঠিক এইরকম এক মোক্ষম সময়ে এসে হাজির হলেন ইংরেজ রবার্ট ক্লাইভ। কারণ সেই সময় নবাবের সাথে ফরাসিদের বেশ ভালো সম্পর্ক আর ইংরেজদের সাথে খারাপ সম্পর্ক চলছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোলকাতাযর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে আরো শক্তিশালী করে এবং বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে বিভিন্ন অনৈতিক পদক্ষেপ নেয়, যে কারণে বাংলার নবাব সিরাজের বাহিনী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নিয়েছিলো। তাঁর নির্দেশে, ১৫৫ জন ইংরেজকে একটি ছোট্ট কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিলো। এই ঘটনাকে পরে ক্লাইভ বৃটিশদের কাছে “কোলকাতার ব্ল্যাক হোল (মৃত্যুপুরী)” বলে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালায়, যাতে সে বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি পায়। এর ফলে ব্রিটেনের রাণী তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলো।
১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের আগেই বৃটিশরা সমুদ্রের রাজত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে তারা ডাচদের উচ্ছেদ করেছিলো এবং ফরাসিদেরকেও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলো। একইভাবে তারা আমেরিকা, কানাডা, পশ্চিম আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ তৈরি করেছিলো। এশিয়া ও আফ্রিকার মাধ্যমে একচেটিয়া দাস বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে ইংল্যান্ড এক সমৃদ্ধ শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। ততোদিনে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোলকাতা, বোম্বাই এবং মাদ্রাজের বন্দর রাজনৈতিক কৌশলগতভাবে দখল করে নিয়েছিলো। এসবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একজন সুচতুর বুদ্ধিমান ও দক্ষ প্রশাসক রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ তাঁর এজেন্টদের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদে মীরজাফরের সাথে একটি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি করেন। সিরাজের বিরুদ্ধে উত্তরোত্তর সমর্থনের বিনিময়ে ক্লাইভ তাকে বাংলার নবাব পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্রে বাংলার জমিদার এবং ব্যাংকাররাও ক্লাইভের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথমে ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নৌ-সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি খুব সহজেই কোলকাতা পুনর্দখল করে এবং সিরাজউদ্দৌলাকে ‘আলীনগর চুক্তি’ নামক এক শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য করে। ‘আলীনগর’ কোলকাতার পুরাতন নাম। রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয়ের মাধ্যমে রবার্ট ক্লাইভ এর গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। তারপর তিনি মীরজাফর সহ অন্যান্য জমিদার ও জগৎ শেঠদের মতো বড় বড় ব্যাংকারদের সাথে ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের মাধ্যমে বাংলা দখলের এক বিরাট নীল নকশা তৈরি করেন।
ভারতের ভাগ্য নির্ধারণকারী পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের সেনাবাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য ছিলো, অন্যদিকে ইংরেজ সেনা ছিলো মাত্র ৩ হাজার। প্রকৃতপক্ষে, মীরজাফরের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হেরে যায়। নবাব সিরাজকে হারিয়ে ক্লাইভ মীরজাফরের আগেই মুর্শিদাবাদ পৌঁছান এবং নবাবের খাজাঞ্চিখানার সমুদয় ধন-দৌলত লুট করেন। ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী মীরজাফরকে চাপ দিয়ে অতিরিক্ত আরো টাকা আদায় ও অন্যবিধ লুটতরাজে ক্লাইভ ও তার বাহিনী বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারপরেই বাংলা থেকে বিপুল ধন-সম্পদ লন্ডনে হস্তান্তর করে তাদের শিল্প-বিপ্লবকে সম্ভব করেছিলো। ক্লাইভ নিজেই এক মিলিয়ন পাউন্ড সোনা এবং মূল্যবান পাথর পেয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য কর মাফ করা হয়েছিলো।
পরবর্তীতে যখন মীরজাফর আর অতিরিক্ত ধন-সম্পদ দিতে পারছিলো না, তখন ক্লাইভ তাঁর স্থলাভিষিক্ত নবাব করলেন মীর কাসিমকে। আসলে বাংলার কোষাগার তখন শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। মুঘল শাসনকালে বাংলার সম্পদের যে স্বাদ-জৌলুস ছিলো, তা আর নেই। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরাতো ততোদিনে বাংলার সম্পদের মোহে পুরো আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কোম্পানীর সীমাহীন লোভকে তুষ্ট করতে না পেরে মীর কাসিম বৃটিশদের বহিষ্কারের জন্য আউধের নবাবের কাছে সাহায্য চায় এবং দিল্লীর মুঘল দরবারের কাছেও সহায়তা চেয়েছিলো। কিন্তু আর্থিক সংস্থানের অভাবে মুঘলরাও তেমন জোরালোভাবে তাদের সেনাবাহিনী টিকিয়ে রাখতে পারে নি, সে জন্য বাংলাকে কোনো সাহায্যও করতে পারে নি। নাদির শাহের হামলার পর থেকে পলাশী পর্যন্ত ১৮ বছরের মধ্যে মুঘলরা ছিলো নামমাত্র ভারতের শাসক। তারপরেও তারা সম্রাট আউধের নবাবকে সাহায্য করতে বলেন এবং একটি ছোট সেনাদল পাঠিয়েছিলেন। ফলে মীর কাসিম বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদিকে বৃটিশরা তাদের সেনাসংখ্যা ১০,০০০ এরও বেশি বৃদ্ধি করে ফেলেছে। তাছাড়া তাদের ছিলো উন্নত বন্দুক, রাইফেল, কামান ও গোলাবারুদ, যার সামনে ভারতীয় সেনারা আর দাঁড়াতে পারে নি। বক্সারের যুদ্ধে ভারতীয়দের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে বাংলা, বিহার এবং বেশিরভাগ সংযুক্ত প্রদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা বৃটিশদের দখলে আসে এবং একটি স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে বৃটিশ শাসন আইনী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রবার্ট ক্লাইভ যা শুরু করেছিলেন, তার উত্তরসূরি ওয়ারেন হেস্টিংস তা সম্পূর্ণ করেছিলেন। হেস্টিংস ছিলেন একজন ঠান্ডা ও নির্মম চাঁদাবাজ প্রবৃত্তির মানুষ। তিনি প্রশাসনিক কৌশল ব্যবহার করে হিন্দু ও মুসলমানদের কাছ থেকে সোনার শেষ আউন্স পর্যন্ত আদায় করেছিলেন এবং তা তার নিজের পকেটেই ভরেছিলেন। তিনি ল্যাঙ্কাশায়ারে সস্তা তুলাপণ্য ভারতের বাজারে দেয়ার পরিবর্তে ভারতীয় উৎপাদনকারীদের উপর প্রচুর কর আরোপ করেছিলেন। এমনকি বন্যার সময়ো জোর করে কর আদায় অব্যাহত রাখেন। তিনি আউধের বেগমদের ও রাজকন্যাদের অনাহারে থাকতে বাধ্য করেছিলেন এবং অপর দেশদ্রোহী আসিফ-উদ-দৌলাকে তার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে, তাদের দাস-দাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি রত্নভান্ডার লুট করেছিলেন। এরপর দশ বছরের ব্যবধানে বাংলা একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায়, যেটা ছিলো একসময় এশিয়ার সবচেয়ে ধনী প্রদেশ।
বাংলা থেকে বিপুল ধন-সম্পদ লুট করেই ইউরোপের শিল্প-বিপ্লব সফল হয়েছিলো। এটি উল্লেখযোগ্য যে ইতিহাসবিদরা পলাশী যুদ্ধের পরের বছর ১৭৫৮ সাল থেকে শিল্প-বিপ্লবের তারিখ শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে, সেটাই ঘটেছিলো। কারণ অর্থের মূলধনই হলো মূল চালিকাশক্তি, যা নতুন নতুন আবিষ্কারকে গতি দেয়। মূলধন ব্যতীত আবিষ্কার মৃত পাথরের মতো। বাংলা থেকে প্রচুর তরল অর্থের যোগানই ইংল্যান্ডকে নতুন শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গড়তে সাহায্য করে এবং তারপরেই পুঁজির বদৌলতে তারা নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো হাজির করতে সক্ষম হয়। পলাশীর যুদ্ধের আগে ইংল্যান্ডের লোহা ও ইস্পাত শিল্পটি বাংলার চেয়ে বেশি উন্নত ছিলো না। পলাশীর পরের এক প্রজন্মের মধ্যেই ইউরোপ প্রযুক্তিতে এশিয়াকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিলো। একটু খেয়াল করলেই এর প্রমাণ মেলে, উড়ন্ত শাটলটি ১৭৬০ সালে, স্পিনিং জেনিটি ১৭৬৪ সালে, স্টীম ইঞ্জিনটি ১৭৬৮ সালে এবং স্পিনিং খচ্চর ১৭৭৯ সালে আবিষ্কার হয়েছিলো।
কিছু পণ্ডিত নেপোলিয়নের ১৭৯৯ সালের মিশর জয়কে ইসলামী বিশ্ব এবং ইউরোপের মধ্যে সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটা সঠিক নয়। নেপোলিয়ন মিশরে আক্রমণ করার চল্লিশ বছর আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইসলামিক বিশ্বের ভাগ্যের চাকাগুলি পাল্টে গিয়েছিলো। আর ইউরোপে এক প্রজন্মেরও বেশি সময় ধরে পুরোদমে শিল্প বিপ্লব চলেছে। মিশরে তুর্কিদের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের বিজয় এশিয়া জুড়ে ইউরোপের প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণমাত্র। আসল ঐতিহাসিক দখলটি ছিলো ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ।
বাংলা থেকে লুটপাট করে ইংল্যান্ড পুঁজিবাদী সমাজের সূচনা করেছিলো। অবৈধ মূলধনের প্রবাহ তাদের শিল্পায়নকে সুসংহত করেছিলো। বাংলার ধন-সম্পদ নিয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে এবং সফলভাবে মহীশূর (১৭৭০-১৭৯৯) এর টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভারতকে পরাধীন করেছিলো এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ পাকাপোক্ত করেছিলো।
সুতরাং আমরা বলতেই পারি, ভারত উপহাদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করেই তৈরি হলো উন্নত ইউরোপ।