অন্দরমহল থেকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ইতিবৃত্ত তার্কিশ ড্রামা সিরিজ সুলতান সুলেমানের মাধ্যমে অনেকেই রাজকীয় হারেম শব্দটার সাথে পরিচিত। রাজ মহিলাদের বিশেষ করে রাজ মাতা, রাজার স্ত্রী, কন্যা, দাসী এবং খোজাদের নিয়ে গঠিত হতো হারেম। ভারতীয় উপমহাদেশে যেটি ছিল জেনানা, অটোমান সালতানাতে ছিল হারেম আর পারস্যে ছিল আন্দারুন।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পত্তনের আগে রাজা বা সুলতান শাসিত মুসলিম সাম্রাজ্যে হারেম ছিল একইসাথে কৌতুহলোদ্দীপক এবং রহস্যময় একটি জায়গা। সাধারণ মানুষজন খুব কম তথ্যই পেতো হারেম সম্পর্কে। ইরানের কাজার রাজবংশের চতুর্থ শাসক নাসির আল দ্বীন শাহ কাজারের আমলে সর্বপ্রথম হারেমের ভেতরের ছবি তুলা হয়। তিন হাজার বছরের শাহ রাজবংশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত মানুষ হারেমের ভেতরের দৃশ্য অবলোকন করতে পারে।
কাজার রাজবংশের ফাত আলী শাহ ও নাসের আল দ্বীন শাহের হারেম ছিল সবচেয়ে বড়। ফাত আলী শাহের স্ত্রী ও উপপত্নীদের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজারখানেক। বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন ধর্মের এসব স্ত্রীরা হারেমে ছিল বেশ প্রভাবশালী। তার স্ত্রীদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ মহিলা এবং খোজা পালন করত। হারেমে কর্মচারী হিসেবে খোজাদের আবেদন এতো বেশি ছিল যে এই খোজারা মাঝে মাঝে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হয়ে উঠত। এমনকি কাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আগা মোহাম্মদ খান কাজার ছিলেন একজন খোজা।
অনেক স্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের জন্য আলাদা কক্ষ ও ব্যক্তিগত আস্তাবল ছিল। এদের খরচ মেটানোর জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হতো। কর্মচারীদের সংখ্যা নির্ভর করত কোন স্ত্রী কতোটা প্রভাবশালী তার উপর। যদিও হারেম গঠিত হতো হাজার হাজার নারীদের নিয়ে কিন্তু এর প্রশাসনিক বিন্যাস ছিল সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। হারেমের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন শাহের মাতা। তাকে বলা হতো মাহেদ-ই-ওলিয়া। তিনি বেশকিছু বিশেষ অধিকার ভোগ করতেন। হারেমের সম্পদ দেখভাল করা ছিল তার মধ্যে একটি। তার দায়িত্ব পালনের জন্য ব্যক্তিগত সহকারী রাখতেন। হারেমে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেয়ার জন্য হারেমের নারীদের প্রতিযোগিতায় নামতে হতো। শাহের স্ত্রীরা হারেম থেকেই নিজের ও নিজেদের সন্তানের আধিপত্য তৈরির জন্য কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতেন। এই হারেম থেকেই কে হবেন শাহ রাজবংশের পরবর্তী উত্তরাধিকার এই প্রশ্নে ব্যাপক রাজনীতি চলত। স্ত্রীরা শাহের পেছনে হেরেম থেকে কলকাঠি নাড়তেন। নিজেদের সন্তানকে উত্তরাধিকার বানানোর জন্য প্রকারান্তরে এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেই লিপ্ত হতেন শাহের স্ত্রীরা।
হারেমের নারীরা ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে নিজেদের ব্যস্ত রাখত। কেউ চালাত রাজকীয় কফিহাউস, কেউ রাজার রাতের বিশ্রামে থাকা নারী পাহারাদারদের দেখভাল করত। আরেক শ্রেণী নারী ছিল যাদের বলা হতো ওস্তাদ। এরা রাজকীয় নারীদের বিনোদনের জন্য আসা নৃত্যকর্মী ও সংগীতশিল্পীদের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকত। এদের থাকার জন্য হারেম থেকে দূরে আলাদা একটা কম্পাউন্ড ছিল। পারফর্মারদের মধ্য থেকে কেউ কেউ রাজকীয় কর্মকর্তাদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে হারেমে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। নাচগান ছিল হারেমের জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। শাহের স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ গান পারতেন। কেউ কবিতা আবৃত্তি ও গল্প বলায় পারদর্শী ছিলেন। হারেম কম্পাউন্ডের মধ্যমণি হিসেবে নারীরা থাকলেও প্রাসাদের অন্য অংশে খোজারা ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যেমন, রাজকীয় রান্নাঘরের দায়িত্বে মহিলারা থাকলেও খাবার পরিবেশনের কাজ করত খোজারা। খোজারা ছাড়াও হারেমের মহিলাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেতো দর্জি, চিকিৎসক এবং মহিলাদের পুরুষ আত্মীয়রা। ফলে বাইরের জগতের সাথে হারেমের এক অসাধারণ মেলবন্ধন তৈরি হতো। এছাড়া বিবাহ, আক্বদ ও গ্রীষ্মকালীন পিকনিকে পুরুষ ও মহিলরা একসাথে হওয়ার সুযোগ পেতো। হারেম অনেকসময় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
নাসির আল দ্বীন শাহের রাজ্যোরাহণ ঘটেছিল হারেমের প্রভাবেই। রাণী মাতা জাহান খানম মাহেদ-ই ওলিয়া নেতৃত্বাধীন এক জোটের পরোক্ষ অবদানে কাজার রাজবংশে তার অভিষেক হয়। রাণী মাতার ইচ্ছায় কাজার প্রধানমন্ত্রী তাকি খান আমির কবিরকে পদচ্যুত ও পরে হত্যা করা হয়। এছাড়া তারও পরে নাসির আল দ্বীন শাহের প্রভাবশালী স্ত্রী আনিস-আল দাওলা তার ইচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী মির্জা হুসাইন খানকে পদচ্যুত করেন। এভাবে হারেম রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি রাজ্যের নীতিনির্ধারক ও বিদেশি কূটনীতিকরা হারেমের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করতেন। হারেমের নারীরা এই গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ না থেকে কেউ কেউ শিল্প ও সাহিত্যে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। তারা কবিতা ও ক্যালিফ্রাফি শিখতেন।
এমনকি অনেক কাজার নারীদের জন্য বিদেশী শিক্ষকও ছিল। কাজার রাজবংশের চতুর্থ শাসক নাসির শাহ কাজারের কন্যা তাজ ছিলেন প্রথম ইরানী নারী যিনি পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। নাসির আল দ্বীন শাহ কাজারের আমলে হারেমে তুলা ছবিতে ইরানী নারী সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। শাহ নাসিরের আমলে নারীদের যেসব ছবি তুলা হয়েছিল তাতে দেখা যায়, নারীদের গোঁফ ও ঘন ভ্রূ রয়েছে। সে যুগে নারীদের গোঁফ রাখাকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরে নেয়া হতো। মেক আপের মাধ্যমে তারা গোঁফ ও ভ্রূকে আরো ঘন ও কালো করতেন।
নারীরা দেখতে শারীরিকভাবে স্থূল প্রকৃতির ছিল। ধারণা করা হয়, সে যুগে নারীদের স্থূলতা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। স্থূল শারীরিক গড়ন আর গোঁফ সমেত শাহ নাসিরের কন্যা ইতিহাসে যিনি Princess Qazar নামে পরিচিত তিনি বিখ্যাত ছিলেন তার সৌন্দর্যের জন্য। তার সৌন্দর্যে বাদেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন আরো অনেক কারণে। তিনি ছিলেন একজন নারীবাদী, একজন লেখক, চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবী। তার প্রকৃত নাম ছিল জাহরা খানম বা তাজ আল-সালতানাহ। তার হাত ধরেই কাজার রাজবংশের ইতিহাস লেখা হয়।
তিনিই প্রথম নারী ছিলেন যিনি প্রথাগত ইসলামি পোশাক বাদ দিয়ে পশ্চিমা পোশাক পরিধান করেছিলেন। ১৩ বছর বয়সে হারেমেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার স্বামীকে পরে ডিভোর্স দেন। কাজার রাজবংশ তথা পারস্য ইতিহাসে হারেমের কোন নারীর জন্য এটি ছিল এক বিরল ঘটনা। যদিও এই ইতিহাস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা হয়। হারেমে আধুনিকতার সাথে পারস্যের ইসলামি ঐতিহ্যের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে প্রিন্সেস কাজার তার লেখায় উল্লেখ করেন। তিনি তার পিতা ও ভাইয়ের শাসনের প্রকাশ্য সমালোচক ছিলেন। তৎকালীন ইরানের সামাজিক অবস্থা, অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়েও তিনি মতামত প্রকাশ করতেন। কাজার রাজবংশের হারেমের প্রভাবশালী এই মহিলার জন্য ১৩ পুরুষের আত্মহত্যার গল্প প্রচলিত আছে। তবে ইতিহাস এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।