সংস্কৃতিগত কারণে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার নারীদের জীবন অন্যান্য সভ্যতার নারীদের মতো সহজ কোনো মাপকাঠির আওতায় আনা যায় না। মেসোপটেমিয়ার নারীদের কিছু উল্লেখযোগ্য অধিকার ছিলো। তারা ব্যবসার মালিক হতে পারতো, জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারতো, স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারতো, নিজের ইচ্ছায় বিবাহ-বিচ্ছেদে যেতে পারতো। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরুষদের কাছে তারা গৌণই ছিলো। এতো কিছুর পরও তারা নিজেদের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছিলো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীর সর্বাধিক স্বাধীনতা ছিলো। এই সময়টি ছিলো মূলত উরুক যুগ থেকে আক্কাদের সারগনের উত্থানের আগে প্রারম্ভিক রাজবংশীয় যুগ পর্যন্ত। যদিও এটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, সারগন একজন নারী দেবতা (ইনান্না বা ইশতার)-কে তার রক্ষক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, নিজের মেয়ে এনহেডুয়ানাকে উরের মহাযাজক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এই রেকর্ডগুলো ধারণা দেয় যে, সারগনের সময়েও নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক কিছু ছিলো আগের মতোই।

ব্যাবিলনের ষষ্ঠ রাজা হাম্মুরাবি সম্পর্কেও একই দাবি করে থাকে অনেকেই, যদিও সত্যিটা হলো, তার রাজত্বকালে নারী দেবীর পূজা এবং নারীর অধিকার দুটোই হ্রাস পেয়েছে। তবু নারীর স্বায়ত্তশাসন কিছুটা হলেও তখনও বহাল ছিলো এবং এটি অব্যাহত ছিলো অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য ও আকেমেনিড সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত। পিতৃতন্ত্র এই সব যুগেই নারীদের অধিকার ও ব্যক্তিগত পছন্দগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলো ঠিকই; তবুও নারীরা জমির মালিক, ব্যবসার মালিক, প্রশাসক, আমলা, ডাক্তার, লেখক, পাদ্রী এবং এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শাসকের দায়িত্বও পালন করেছে।

দেবীমূর্তিটি  ইশতারের

মেসোপটেমিয় সমাজও অন্য যে কোনো সমাজের মতোই শ্রেণীবদ্ধ ছিলো এবং পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল –অভিজাত শ্রেণী, যাজক শ্রেণী, উঁচু শ্রেণী, নিম্ন শ্রেণী এবং ক্রীতদাসী। কখনও কখনও এদেরকে তিনটি উপাধি দিয়েও শ্রেণীভুক্ত করা হয় -স্বাধীন, নির্ভরশীল এবং দাসী হিসেবে। এদের মধ্যে আধা-মুক্ত নারীদেরও একটি শ্রেণী ছিলো। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনও ছিলো না, আবার দাসও ছিলো না। তাই তাদের ক্ষেত্রে ‘নির্ভরশীল’ শব্দটি সবচেয়ে উপযুক্ত। এসব নারীরা সাধারণত কোনো উপাসনালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতো।

৬৫১ সালে মুসলিম আরবদের কাছে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত নারীদের অধিকারগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বজায় থাকে। পরবর্তীতে সারগন বা হাম্মুরাবির অধীনে যে কোনো পতনের চেয়েও নারীর অধিকার অনেক বেশি নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। কিছু পণ্ডিত পুরুষ দেবতাদের উত্থানের সাথে নারীর মর্যাদার পতনকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন এবং পিতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ব্যবস্থার উপর অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। সর্বোপরি ৬৫১ সালের পরে এই অঞ্চলে নারীর অধিকারের একটি স্পষ্ট পতন লক্ষ করা যায়।

নারীর শ্রেণীবিন্যাস

নারীদেরকে তাদের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নিম্নরূপে শ্রেণিভুক্ত করা হয়-

  • অভিজাত বা উঁচু শ্রেণীর স্বাধীন নারী (আক্কাদীয় ভাষায় ‘আবিলাতুম’)
  • পাদ্রী বা যাজকদের মুক্তকৃত স্বাধীন নারী (ব্যবিলনীয় ভাষায় ‘নাদিতু’)
  • নারী প্রশাসক (নব্য অ্যাসিরীয় যুগের ‘সাকিন্তু’)
  • নিচু শ্রেণীর স্বাধীন নারী (একাধিক নামে পরিচিত)
  • পতিতা বা পরিবারবিহীন নারী (আক্কাদীয় ভাষায় ‘হারিমতু’)
  • পুরুষবিহীন পরিবারের নির্ভরশীল নারী (ব্যবিলনীয় ভাষায় ‘সির্কুস’)
  • নারী ক্রীতদাসী (ব্যবিলনীয় ভাষায় ‘আমতু’)

 

সময় ও প্রভাবশালী সংস্কৃতিগুলোরর সাথে এই শ্রেণীবিভাগের নাম পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু মূল ধারণা একই রয়ে গেছে। নারীরা প্রথমে তাদের বাবা, তারপর স্বামী (ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে পাদ্রী বা কোনো ধনী অভিজাত পুরুষ) এবং এর পর তাদের ছেলে সন্তানদের অধীনস্থ ছিলো। যদিও স্বতন্ত্র নারীরা তাদের নিজস্ব পথ অনুসরণ করতে পারতো, তবে এটি বিরল ছিলো এবং বেশিরভাগ নারীই পিতৃতন্ত্রের ঐতিহ্য, নিয়ম ও প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবনযাপন করেছিলো।

বিয়ে এবং নারী

মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস জুড়ে একজন নারীর কাছ থেকে এটাই আশা করা হতো যে, তার বিয়ে হবে, সন্তান জন্ম দেবে, সন্তান লালন-পালন ও বাড়ির দেখাশোনা করবে। এর ব্যতিক্রম ছিলো সিপ্পার শহরের নাদিতু নারীরা। তারা পুরুষ দেবতাদের জন্য নিবেদিত পুরোহিত ছিলেন। সন্তান ধারণ সম্ভব না হলেও নারীরা অবশ্যই বিয়ে করবে বলে প্রত্যাশা রাখা হতো। তাদের স্বামীরা অপর স্ত্রী বা উপপত্নী গ্রহণে স্বাধীন ছিলো। নাদিতু নারীরা মন্দিরের পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলো, দেবতার উপাসনার সাথে সম্পর্কিত দায়িত্ব পালন করেছিলো এবং ব্যবসায়িক কার্যকলাপেও নিযুক্ত ছিলো।

বিবাহযোগ্য বয়সের অবিবাহিত নারীকে বোঝাতে ব্যবহৃত একমাত্র শব্দটি ছিলো ‘হারিমতু’, যার অর্থ পতিতা কিংবা অবিবাহিত নারী। এই শব্দটির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এখনও বিতর্কিত। তবে সাধারণভাবে এটাই বোঝায় যে, হারিমতু নারী নিজের মতো করে জীবনযাপন করার জন্য যথেষ্ট ধনী কিংবা মন্দিরের সাথে যুক্ত কোনো নির্ভরশীল শ্রেণীর সদস্য, যে স্বাধীনও নয়, আবার দাসও নয়। ক্রিস্টিন ক্লেবারের মতে, এই নারীরা খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর নব্য ব্যবিলনীয় সম্প্রদায়গুলোতে সির্কুস নামে পরিচিত ছিলো। কালবার্টসনের মতে, “সির্কুস নারীকে মন্দিরের দাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ধারণা করা হয়, তাদের ভাগ্য অন্যান্য দাসদের তুলনায় ভালো ছিলো, কারণ মন্দিরের দেবতারা তো আর মালিক হিসাবে সরাসরি অধিকার প্রয়োগ করে না। আসলে সির্কুস নারীরা দাস ছিলো না। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নির্ভরশীলতা ছিলো, অর্থাৎ ব্যবিলনের মুক্ত নাগরিকদের তুলনায় তারা সীমিতভাবে স্বাধীন ছিলো।“

নারী উপাসক মূর্তি, মেসোপটেমিয়া

নাদিতু এবং সির্কুস শ্রেণী বাদে একজন ধনী বিধবা নারী আবার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। তবে অবশ্যই নিয়মের অন্যান্য ব্যতিক্রমও ছিলো। কিন্তু সাধারণত একজন যুবতী বিবাহযোগ্য বয়সে উপনীত হলেই তার বাবা উপযুক্ত বরের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন এবং এই বিয়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষই উপকৃত হতো। বিয়ের এই চুক্তিটি একটি আইনি ও ব্যবসায়িক চুক্তি ছিলো, যেখানে বিবাহিতদের নিজেদের ইচ্ছা বা স্বার্থের কোনো মূল্য ছিলো না। জাঁ বোটেরো বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, “একজন পুরুষের জন্য বিয়ে ছিলো একজন স্ত্রীর দখল নেয়া, যেমনভাবে কোনো অঞ্চল বা পণ্যের দখল নেয়া হয়। বরের পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি শুরু হতো। কনেকে বেছে নেয়ার পরে তার পরিবারকে একটি ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো। সংক্ষেপে, এটি ছিলো একটি লেনদেন, যার মাধ্যমে একজন নারীকে ক্রয় করা হতো। এভাবে কিনে নেয়া মেয়েটিকে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য তার পরিবার থেকে আলাদা করে দেয়া হতো এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে স্বামীর বাড়িতেই থাকতে হতো।”

বিয়ের প্রক্রিয়াটির পাঁচটি ধাপ ছিলো, যার সবকটিই ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পালন করতে হতো। স্বামী-স্ত্রীর মিলনকে আইনি ও বাধ্যতামূলক হিসাবে স্বীকৃত করার জন্য এই পাঁচটি ধাপ সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতেই হবেঃ

– বাগদান বা বিবাহ চুক্তি

– কনের বাবাকে কনের দাম প্রদান এবং বরের বাবাকে যৌতুক প্রদান

– অনুষ্ঠান এবং বিয়ের ভোজ আয়োজন

– কনের শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া

– কনেকে গর্ভবতী করবার আশায় বিয়ের রাতে সঙ্গম করা

স্ত্রীকে তার স্বামীর সম্পত্তি বিবেচনা করা হতো। প্রত্যাশা ছিলো, স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে স্বামীর আনুগত্য করবে এবং স্বামী চাইলেই স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে। কিন্তু একজন নারীর পক্ষে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মামলা করা অত্যন্ত কঠিন ছিলো। মেসোপটেমিয়ায় নারীদের জীবনের অন্যান্য দিকগুলোর মতো এই বিষয়গুলোও ছিলো খুবই সাধারণ। কতোজন মহিলা নিজেকে জাহির করতে এবং স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হতো, সেই আলোচনায় বোটেরো বলেন, “সমস্ত প্রথাগত বা আইনি বাধা সত্ত্বেও মেসোপটেমিয়ার নারীদেরও তথাকথিত ‘শক্তিশালী’ পুরুষ লিঙ্গের কোনো প্রতিনিধির পক্ষে দাঁড়াবার জন্য, এমনকি তার উপর আধিপত্য বিস্তার করবার জন্য দুটি নির্ভরযোগ্য ট্রাম্প কার্ড ছিলো- প্রথমটি, তার নারীত্ব এবং তারপরে, তার ব্যক্তিত্ব, আত্মা ও চরিত্র। সমসাময়িক মানসিকতার বিরুদ্ধে এগুলোকে সে কিভাবে ব্যবহার করবে তা তার উপরই নির্ভর করতো।”

এটি মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসের প্রতিটি যুগেরই ঘটনা বলে মনে হয়। তবে এর মাঝেও কোনো কোনো যুগে প্রচন্ডভাবে লিঙ্গীয় সমতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

উরুক যুগ থেকে আদি সাম্রাজ্যের যুগ

উরুক যুগ থেকে আদি সাম্রাজীয় যুগে নারী-পুরুষের সমতার প্রমাণ মিলেছে। উরুক যুগে সিলিন্ডার-সীলগুলোর অধিকাংশই ছিলো নারীদের, যা প্রমাণ করে যে, সে সময় নারীদের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এবং ব্যবসায়িক চুক্তিতে প্রবেশের আইনত অনুমোদন ছিলো। উরুক যুগে নগরায়নের উত্থান ও লেখালেখির বিকাশ পরিলক্ষিত হয় এবং প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সে সময় নারী দেবী, যেমন, গুলা, ইনান্না, নিনহুরসাগ, নিসাবা এবং নিনকাসিকে পুরুষ দেবতাদের তুলনায় ব্যাপকভাবে পূজা করা হতো।

আদি সাম্রাজ্যের প্রথম যুগে পরিবারগুলোর দেবীর উপাসনার প্রতি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। উচ্চবিত্ত নারীদের তুলনায় নিম্নবিত্ত নারীদের অধিকার কিছুটা খর্ব হয়েছিলো। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রেও এমনটা প্রযোজ্য ছিলো। এতে বোঝা যায় যে, লিঙ্গীয় বৈষম্য ছিলো না। আদি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় যুগে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে বিভাজনে বৈচিত্র্য আসে। শ্রমিক, কারিগর, মিলার, বেকার, মদ প্রস্তুতকারী এবং তাঁতি হিসেবে নারীর সামনে আরও সুযোগ উন্মুক্ত হয়। টেক্সটাইল এই সময়েই বিশেষত নারীদের পেশা হিসেবে যুক্ত হয়েছিলো এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

ইন্নানা ও দুমুজির বিয়ে

আদি সাম্রাজ্যের তৃতীয় যুগেও নারীর অবস্থা একই রকম ছিলো, বরং অনেক ক্ষেত্রে বলা যায়, খানিকটা উন্নত ছিলো। এই যুগে দুই জন নারী নিজেদের অধিকারে শাসন করেছেন বলে জানা যায়। উরের রাণী পুয়াবি (উরের রাজকীয় কবরস্থানের সমাধি থেকে পরিচিত) এবং কিশ এর কুবাবা -সুমেরীয় রাজাদের তালিকায় রাণী হিসেবে আবির্ভূত মাত্র দুটি নারী নাম। পুয়াবির সিলিন্ডার সীল এবং রাজার তালিকায় কুবাবার নামের উপর ভিত্তি করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, উভয় নারীই পুরুষ সঙ্গীর সহায়তা ছাড়া প্রধান শাসক হিসেবে নিজেদের শাসন চালিয়েছেন। একই সময়ে উম্মার রাণী বারাগ-ইরনুন ও তার স্বামী গিসা-কিদু একত্রে শাসন করেছিলেন। উম্মাতে দেবতা সারার মন্দিরে উৎসর্গীকৃত ফলকে বারাগ-ইরনুনের নাম অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কতোটা সম্মানিত ছিলেন।

সামাজিক গতিশীলতা হয়তো বিরল ছিলো, কিন্তু অসম্ভব ছিলো না। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ কুবাবা, যিনি একজন প্রাক্তন সরাই রক্ষক ছিলেন। সামাজিক সিঁড়িতে নারীর আরোহণের খুব কম রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, বাড়ির বাইরেও তারা অনেক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শাসক, লেখক, পুরোহিত ও ডাক্তার তো ছিলোই; এছাড়াও অন্যান্য পেশার মধ্যে নারীর অন্তর্ভুক্তি ছিলো শিল্পী, কারিগর, বেকার, ঝুড়ি প্রস্তুতকারক, মদ প্রস্তুতকারক, পানপাত্রী, নর্তকী, এস্টেট ম্যানেজার, কৃষক, স্বর্ণকার, গয়না প্রস্তুতকারক, বণিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সুগন্ধি প্রস্তুতকারক, কুমোর, পতিতা, সরাই মালিক এবং তাঁতি হিসেবে।

আক্কাদীয় যুগ এবং উরের তৃতীয় সাম্রাজ্যের যুগ বা নব্য সুমেরীয় যুগ

পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন যে, সারগন দ্য গ্রেটের সময়ে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যে নারী-পুরুষের সমতার এই মডেলটি পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ সে সময় যুদ্ধক্ষেত্রের পারদর্শিতাকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হতো। সামরিক শক্তি ও যুদ্ধে বিজয় লাভের উপর প্রাধান্য দেবার কারণে তখন নারীদেরকে ‘দুর্বল লিঙ্গ’ বিবেচনা করা শুরু হয়। সারগন ও তার উত্তরসূরিরা একটি স্থায়ী সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নিয়মিতভাবে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। এই সেনাবাহিনী একটি পৌর পুলিশ বাহিনী হিসেবেও কাজ করতো। পল ক্রিউয়াশেক মন্তব্য করেছেন, “এটি অবশ্যই একটি উচ্চ সামরিক সমাজ ছিলো, যেখানে সশস্ত্র যোদ্ধাদের প্রায়ই রাস্তায় টহল দিতে দেখা যেতো। বিশেষ করে প্রাদেশিক শহরগুলোতে, যেখানে বিদ্রোহের তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে। সারগন লিখেছেন যে, প্রতিদিন ৫৪০০ জন পুরুষ আক্কাদে তার সামনে খাবার গ্রহণ করতো, সম্ভবত এটি সেই টহলরত সেনাবাহিনীরই সংখ্যা।”

এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত নারীর রেকর্ড নগণ্য। তবে এটাও সত্যি যে, নারীদের অধিকার দমনে সারগনের কোনো আগ্রহ ছিলো কি না, সে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তার জীবন বাঁচাবার ও তাকে সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করবার জন্য তিনি সব সময় তার মাকে কৃতিত্ব দিয়েছেন, দেবী ইনান্না বা ইশতারকে তিনি তার ব্যক্তিগত ঐশ্বরিক রক্ষক মেনে উপাসনা করতেন। এ ছাড়াও নিজের কন্যা এনহেডুয়ানাকে মহাযাজক হিসেবে নিযুক্ত করেন সারগন। ক্রিউয়াশেক এর মতে, উরের নারী পুরোহিতদেরকে তাদের মৃত্যুর দীর্ঘ দিন পরও পূজা করা হতো।

আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য

বোটেরো এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে, আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্যের সেমিটিক প্রকৃতিতে নারীর মর্যাদা হ্রাসের কারণ হলো, নারীর তুলনায় পুরুষকে সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ মনে করার প্রবণতা। তবে এই দৃষ্টান্তটি প্রাচীন চীন, জাপান, ভারত, গ্রীস, রোম এবং এর বাইরে সেমিটিক সম্প্রদায় ছাড়াও লক্ষ করা যায়।

নিপপুরে পাওয়া সারগনের বিখ্যাত শিলালিপিতে দেখা যায়, তিনি পুরুষ দেবতা আনু ও এনলিলের আগে ইনান্নার কথা উদ্ধৃত করেন এবং আক্কাদিয়ান যুগে ইনান্নাকে পূজা করা অব্যাহত ছিলো। সম্ভবত যুদ্ধে পুরুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি খুবই প্রাধান্যসহকারে দেখা হতো বলেই নারীর মর্যাদা হ্রাস পেয়েছিলো। অথচ দেবী ইনান্নাকে সে সময় প্রেম ও যৌনতার দেবী হিসেবে নয়, বরং যুদ্ধের দেবী হিসেবে পূজা করা হতো।

ব্যবিলন এবং অ্যাসিরিয়া

ব্যাবিলনীয়দের ক্ষেত্রে পুরুষ দেবতাদের (বিশেষ করে মারদুক) প্রতি ভক্তি বৃদ্ধির প্রবণতার কারণে নারী দেবীর প্রতিপত্তি ও নারী সম্প্রদায়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলো। হাম্মুরাবির সময়েও পুরুষ দেবতাদের প্রভাবের কারণে নারী দেবীর মর্যাদা কমে গিয়েছিলো। যেমন, দেবী নিসাবাকে দেবতা নাবু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিলো। হাম্মুরাবির কোড কঠোরভাবে নারীদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো এবং শুধুমাত্র স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর ভূমিকার উপর জোর আরোপ করেছিলো। স্টিফেন বার্টম্যান মন্তব্য করেছেন, “বিয়ের মূল ধারণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যবিলনীয় হাম্মুরাবির কোডে প্রকাশ করা হয়েছে। এর ২৮২টি বিধির মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশই পারিবারিক আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।”

হাম্মুরাবির আইন অনুসারে, স্ত্রী যদি পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে অবিশ্বস্ততার আচরণ করে বা অন্য পুরুষের জন্য স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় এবং বিশেষ করে যদি স্ত্রীকে তার প্রেমিকের সাথে পাওয়া যায়, তবে তাদের দুজনকে একত্রে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হতো। নদীতে ডুবে মারা যাওয়ার পর এটিকে বিয়ে এবং পরিবারের মূল্যবোধ লঙ্ঘনের জন্য দেবতার ন্যায়বিচার মানা হতো। অপরদিকে, একজন স্বামী তার সামর্থ্য অনুযায়ী যতো ইচ্ছা ততো স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতো এবং কোনো প্রকার ঝুঁকি ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দিতে পারতো।

শুধুমাত্র স্ত্রী এবং মা হিসেবে একজন নারীর ভূমিকার ধারণাটি নতুন কিছু ছিলো না। তবে হাম্মুরাবির সময়ে নারী দেবীদের গুরুত্ব আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে এই ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট ও জোরদার হয়ে ওঠে। ফলে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কোনো সম্প্রদায় বা সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নির্দিষ্ট লিঙ্গের দেবতার প্রতি ভক্তি এবং সমাজে নারীর অবস্থার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তবে হাম্মুরাবির কোড থেকে এটাও স্পষ্ট যে, কিছু নারী তখনও চাকরিজীবী ছিলো এবং তারা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই সুযোগের সন্ধানে সচেষ্ট ছিলো।

হাম্মুরাবির কোড

এই একই মডেল পরিলক্ষিত হয় অ্যাসিরীয় ও নব্য-অ্যাসিরীয় যুগে, যে সময়ে দেবতা আশুর এমন প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছিলেন যে তার উপাসনা একেশ্বরবাদে পৌঁছে গিয়েছিলো। তবুও আশুরের মূল মন্দিরটি যে শহরে অবস্থিত ছিলো, তার সাথে বন্দর নগরী কারুম কানেশের নিয়মিত ব্যবসা চলছিলো এবং এই বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় প্রশাসক ও সুবিধাদাতা ছিলেন নারীরা। নারী প্রশাসক (সাকিনতু) আশুর ও কারুম কানেশের মধ্যে বস্ত্র তৈরী ও চালানের তত্ত্বাবধান করতেন এবং দুই শহরের মধ্যে পণ্য বহনকারী পুরুষদের পাশাপাশি বিক্রয় পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ করতেন।

মহান অ্যাসিরীয় রাণী সাম্মু-রামাত এই সময়কালেই বেঁচে ছিলেন এবং তার রাজত্ব ছিলো ভীষণ চিত্তাকর্ষক। রাণী সেমিরামিসের তার ব্যক্তিত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাণীমাতা জাকুতু হলেন নব্য-অ্যাসিরীয় যুগের আরেক জন বিখ্যাত নারী, যিনি সেনাকেরিব এর উপপত্নীর পদ থেকে তার উত্তরসূরি এসারহাডন এর রাণীমাতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন আশুরবানিপালের দাদী এবং নাতির সিংহাসনে অধিষ্ঠানকে নিশ্চিত করার জন্য বিখ্যাত।

পারস্যের নারী

অন্তত আকেমেনিড যুগ থেকে কিংবা সম্ভবত আরও আগে থেকে পারস্যে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলো। প্রাচীন পারস্যের নারীরা তাদের কাজের জন্য সমান বেতন পেতেন, যা অন্য কোথাও ছিলো না, এমনকি সুমেরেও নয়। তারা নিজেরাই ভ্রমণ করতে পারতো, জমি ও ব্যবসার মালিক হতে পারতো, বাণিজ্যে নিযুক্ত হতে পারতো এবং জটিলতা ছাড়াই বিবাহবিচ্ছেদে যেতে পারতো। আকেমেনিড যুগে পারস্য সাম্রাজ্যের নারীরা শুধু পুরুষদের পাশাপাশিই কাজ করতো না, প্রায়ই তারা সুপারভাইজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতো, যারা বৃহত্তর দায়িত্ব পরিচালনার জন্য পুরুষদের চেয়েও বেশি বেতন পেতো। গর্ভবতী নারীরা উচ্চ মজুরি পেতো এবং নতুন মায়েরাও সন্তানের জন্মের পর প্রথম মাসে অধিক বেতন পেতো।

আকেমেনিড, পার্থিয়া এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের নারীদের সামরিক বাহিনীতে কাজ করার, পুরুষদের সমান ব্যবসা পরিচালনা করার, এমনকি যুদ্ধে পুরুষদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুমতি ছিলো। সাসানীয় যুগে নারী নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী এবং গল্পকাররা আধুনিক যুগের সেলিব্রেটিদের মর্যাদা লাভ করেছিলো। ধারণা করা হয়, প্রথম শাপুর এর স্ত্রী সাসানীয় রাণী আজাদোখত শাহবানু মহান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিক্ষাদান কেন্দ্র, হাসপাতাল ও গ্রন্থাগার ‘গুন্দেশাপুর’ প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল শক্তি ছিলেন।

৬৫১ সালে মুসলিম আরবদের হাতে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় নারীদের মর্যাদা তীব্রভাবে হ্রাস পায়। কিছুটা পরাজিতদের মূল্যবোধকে দমন করবার উদ্দেশ্যে এটি একটি কার্যকরী প্রচেষ্টা ছিলো। তবে এই অঞ্চলের মূল্যবোধের দমন বিজেতাদের ধর্মের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলো। পার্সিয়ান দেবী আনাহিতা কোনো দেবতা হিসেবে নয়, বরং জরাথ্রুস্টবাদের সর্বোচ্চ দেবতা আহুরা মাজদার অবতার হিসেবে বিবেচিত হতেন। তা সত্ত্বেও পারস্যের যে কোনো বিজয়ের সময় এই দেবী ব্যাপকভাবে পূজিত হতেন এবং শতাব্দী জুড়ে এক ঐশ্বরিক প্রতিচ্ছবি হিসেবে নারীদের একটি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।

পারস্যের নারী

মুসলিম আরব বিজয় আনাহিতা এবং অন্যান্য ঐশ্বরিক নারীসুলভ ব্যক্তিত্ব (যেমন, সাইবেল) এর পতন ঘটায়। এনাটোলিয়ার মাতৃদেবীর ধারণাটি মূলত রাণী কুবাবা অথবা সেমিরামিস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো, যারা তখন ইসলামের সর্বোচ্চ পুরুষ দেবতা আল্লাহ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো। এই একই প্যাটার্ন অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। ক্র্যামার ও স্পেন্সারের সাথে মতে, যখন পুরুষতান্ত্রিক একেশ্বরবাদী বিশ্বাস ব্যবস্থাগুলো আগের নারীবাদের নীতি ধারণকারী বহুদেবতাবাদী বিশ্বাসগুলোকে প্রতিস্থাপন করে, তখন সমাজে নারীর মর্যাদা অনিবার্যভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সমতা হারিয়ে যায়।