সুন্দরবন বাংলাদেশকে যেভাবে ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করছে, তা অকল্পনীয়। ঠিক একই ভাবে সুন্দরবনের মানুষদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছেন বনবিবি। সুপারম্যান, হারকিউলিস কিংবা রবিন হুডের মতোই বাংলার সুপারওম্যান বনবিবি তার কাল্পনিক উপস্থিতির মাধ্যমে শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছেন ঐ অঞ্চলের মানুষের মনে।
কাঁচা কাষ্ঠ, ফাটা হাঁড়ি,
ক্যামনে ভাত রাঁধবো আমি?
বনবিবি মা, আমায় উপায় বলো না
এমনই করে গান গেয়ে গেয়ে সুন্দরবন এলাকার সাধারণ মানুষ বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। হিন্দুদের কাছে তো তিনি পরম পূজনীয় দেবী, এমনকি মুসলমানদের কাছেও তিনি শক্তিশালী বনের দেবী।
বনবিবিকে সুন্দরবন রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল ও জেলে সম্প্রদায়ের সবার কাছেই তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের দুই অংশ- বাংলাদেশ ও ভারত উভয় অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় এই বনবিবি।
ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ বইটি থেকে জানা যায়, ১৫ শতকের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে বনবিবি আরবের এক দরবেশ পরিবারে জন্ম নেন। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, আর মায়ের নাম গুলানবিবি। ইব্রাহীমের প্রথম বউ ছিলেন ফুলবিবি। কিন্তু তার গর্ভে কোনো সন্তান না হওয়ায় ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে এর বিনিময়ে ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি ইচ্ছা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হয় ইব্রাহীমকে।
গুলানবিবি যখন গর্ভবতী হন, তখন ফুলবিবির অন্তরে বাসা বাঁধে ঈর্ষা। তখন পূর্ব শর্ত মতে, ফুলবিবির ইচ্ছানুযায়ী গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসিত করতে বাধ্য হন ইব্রাহীম। সেই জঙ্গলেই জন্ম নেন গুলানবিবির দুই সন্তান -বনবিবি ও শাহজঙ্গুলি। শোনা যায়, তাদের দেখাশোনার জন্য স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার জন সেবককে।
সুন্দরবনের জঙ্গলে বনবিবি বড় হতে থাকেন এক হরিণীর সান্নিধ্যে। সাত বছর পর এক দিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবি ও দুই শিশু সন্তানকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় বনবিবি। সুন্দরবনের প্রকৃতি ও প্রাণীদের সাথে তার এমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো যে, তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া বনবিবির পক্ষে অসম্ভব ছিলো। আর বোনের ভালোবাসায় বনবিবির সাথে জঙ্গলে রয়ে যান ভাই শাহজঙ্গুলিও।
অবশ্য অন্য একটি গল্পে বলা হয় ভিন্ন কাহিনী। ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি এবং বাবা-মা দুজনের উপস্থিতিতেই এখানে জন্ম হয় দুই ভাই-বোন বনবিবি ও শাহজঙ্গুলীর। এর পর থেকে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ইব্রাহীম পরিবার।
‘বনবিবির কেরামতি’ বা ‘বনবিবির জহুরনামা’ নামের গ্রন্থগুলোতে বনবিবিকে নিয়ে এমনি আরও অসংখ্য গল্পের উল্লেখ আছে। এমনও বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে বনবিবি ও শাহজঙ্গুলি দুটি জাদুর টুপি খুঁজে পান। এই জাদুর টুপি মাথায় দিয়ে তারা ঘুরে বেড়ান হিন্দুস্তানের আঠারো ভাঁটির দেশে। বনবিবি ও শাহজঙ্গুলি যখন সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাঁটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিলো নিষ্ঠুর দক্ষিণ রায়। হিন্দুস্তান ঘুরতে এসে শাহজঙ্গুলির দেয়া আযানের ধ্বনি দক্ষিণ রায়ের কানে পৌঁছে। খোঁজখবর নিতে দক্ষিণ রায় পাঠান বন্ধু সনাতন রায়কে। সনাতন রায় ফিরে এসে এই দুই ভাইবোনের কথা জানান দক্ষিণ রায়কে। এতে দক্ষিণ রায় তাদেরকে নিজ সাম্রাজ্য থেকে উৎখাত করতে উদ্যত হন।
দক্ষিণ রায় নিজে আক্রমণ করতে চান বনবিবি ও শাহজঙ্গুলিকে। তবে বাধা দেন তার মা নারায়ণী। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে যেহেতু বনবিবি আর শাহাজঙ্গুলির ছিলো অলৌকিক ক্ষমতা, কাজেই দীর্ঘ যুদ্ধের পর হার মানতে বাধ্য হন নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে বনবিবির দয়া হয়। তিনি তার সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে দেন নারায়ণী ও তার ছেলেকে। এই ঘটনার পর নারায়ণীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বনবিবির। সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার বনবিবি নিজের হাতে তুলে নেন, আর দক্ষিণ রায় রাজত্ব করেন জঙ্গলের গহীন কোণে।
বনবিবিকে নিয়ে শুরুর দিকে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে বায়ানুদ্দিন এবং মোহাম্মদ খাতের বেশ জনপ্রিয়। তাদের দুজনের লেখায় বেশ মিলও পাওয়া গিয়েছে। ‘বনবিবির কেরামতি’ এবং ‘বনবিবির জহুরানামা’-তে দুটি প্রধান কাহিনী উঠে এসেছে- রাজা দক্ষিণ রায়ের সাথে বনবিবির যুদ্ধ এবং দুখের সাথে তার দেখা হওয়ার ঘটনা। ২০০৪ সালে অমিতাভ ঘোষ তার পরিবেশবাদী উপন্যাস ‘দ্য হাংগ্রি টাইড’-এ এই ঘটনা দুটিকে ‘দুখে’স রিডাম্পশন’ বা ‘দুখের মুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দুখের গল্প অনুসারে, বাজিরহাটি নামের এক গ্রামে বাস করতেন দুই মৌয়াল ভাই -ধোনা আর মোনা। ধোনা একবার পরিকল্পনা করেন, সাতটি নৌকা নিয়ে আঠারো ভাঁটির দেশে যাবেন মধু সংগ্রহ করতে। তবে তার ভাই মোনা এই প্রস্তাবে রাজি হন না। কাজেই ধোনা একাই নিজের পিতৃহীন গরীব ভাতিজা রাখাল ছেলে দুখেকে সাথে নিয়ে যাবেন বলে মনস্থির করেন। জঙ্গলে পাঠানোর আগে দুখের মা তাকে বলেন, “বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছে, কোনো বিপদে পড়লে তাকে স্মরণ করবি”।
সে সময় দক্ষিণ রায় যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাঁটির দেশের রাজা ছিলেন। তার সঙ্গে ইতিপূর্বে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়েছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে বনবিবির সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। দক্ষিণ রায়ের পরাজয় মানেই হিংস্র মানুষখেকো বাঘ বা অপশক্তির পরাজয়। তাই সন্ধি সত্ত্বেও দক্ষিণ রায় সব সময় বনবিবিকে শায়েস্তা করে প্রতিশোধ নেবার জন্য সুযোগ খুঁজতেন।
এদিকে ধোনা ভাঁটির দেশে মধু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসলেও রাজাকে উপহার দিতে তিনি বেমালুম ভুলে যান। কাজেই নিয়ম অনুযায়ী, তাদেরকে পরবর্তী তিনদিন মধু সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। তৃতীয় রাতে ধোনার স্বপ্নে হঠাৎ দেখা দেন দক্ষিণ রায়, তার ভুলের মাশুল হিসেবে নরবলি দেয়ার আদেশ দেন তিনি ধোনাকে। বেশ বাকবিতণ্ডার পর ধোনা শেষ পর্যন্ত সহজ-সরল দুখের প্রাণের বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে মধু সংগ্রহের অনুমতি আদায় করেন।
চতুর্থ দিনে পর্যাপ্ত মধু আর মোম সংগ্রহ করে পরিকল্পনা মতো দুখেকে একা রেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যান ধোনা। রাজা দক্ষিণ রায় বাঘের রূপে যখন দুখেকে মেরে ফেলতে উদ্যত হন, তখনই দুখের মনে পড়ে যায় তার মায়ের কথা। মনে মনে দুখে সাহায্য প্রার্থনা করেন বনবিবির কাছে।
দুখের ডাক শুনে ভাই শাহজঙ্গুলিকে সাথে নিয়ে ছুটে চলে আসেন বনবিবি। সম্মুখ যুদ্ধে বাঘবেশী দক্ষিণ রায়কে হারিয়ে দেন শাহজঙ্গুলি। পরাজিত দক্ষিণ রায় আশ্রয় নেন গাজী পীরের কাছে। গাজী পীরের অনুরোধে দক্ষিণ রায়কে ছেড়ে দেন বনবিবি। তবে বিনিময়ে দুখেকে সাত নৌকাভর্তি মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দিতে হয় গাজী পীরকে।
বনবিবির পোষা কুমিরের পিঠে চড়ে নিজ গ্রামে ফিরে যান দুখে এবং সেখানে গিয়ে তিনি বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। এই ঘটনায় অভিভূত হয়ে সেই গ্রামসহ আশেপাশের সব গ্রামেই শুরু হয় বনবিবির উপাসনা। এদিকে ধোনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের বিয়ে দেন এবং দুখেকে গ্রামের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মধ্যযুগের মতো আজও সুন্দরবনের মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের সৌন্দর্য যেমন প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি, তেমনই এই সুন্দরের মধ্যেও রয়েছে নানা বিভীষিকা। বাঘ, সাপ, কুমির ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার মানুষ নানা দেব-দেবীর সহায় হয়েছেন। লৌকিক দেব-দেবী, পির-পিরানীদের পূজো, হাজোতের রেওয়াজ ইত্যাদি প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে।
বনে প্রবেশ করার আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলে ও মৌয়ালদের নিরাপত্তার স্বার্থে মন্ত্রগুণী ও পূজারী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার রীতি এখনও প্রচলিত আছে। অনেক গ্রামে এমন রীতিও দেখা যায় যে, স্বামী যতো দিন জঙ্গলে থাকেন; ততো দিন বাড়িতে তাদের স্ত্রীদের চুলে চিরুনি দেয়া ও গায়ে সাবান দেয়া মানা, এমনকি মাছও খাওয়া যাবে না। এই নিয়মে কিছু ভুল হয়ে গেলে নাকি বনবিবির নাম স্মরণ করে মাফও চাইতে হয়।
সুন্দরবনজীবীদের কাছে পূজিত এক নারীশক্তি বনবিবি, যিনি জেলে, বাওয়ালি আর মৌয়ালদের সুরক্ষার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত। এই সুরক্ষা হলো বনের বাঘ বা বাঘরূপী অপশক্তি দক্ষিণ রায় এর হাত থেকে। যেমনটি আমরা দেখেছি সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র দুখের গল্পে।
ঐতিহ্যগতভাবে প্রতি বছর বাংলা পহেলা মাঘ সুন্দরবনের ভেতরে আর বনসংলগ্ন লোকালয়ে ‘মা বনবিবি’-র পূজা হয়ে থাকে। এই পূজা দক্ষিণ বাংলার আবহমান লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। বনের ভেতর দুই হাজারেরও বেশি জায়গায় বনবিবির পূজা হয়। ঢাংমারীসহ শুধু পশুর নদের পশ্চিম পাড়ে ভদ্রা নদী পর্যন্ত এলাকায়ই বনবিবির তিন শতাধিক পূজা হয়। সেখানকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই বনবিবির উপাসনায় নিযুক্ত হয়ে থাকেন।
আসলে বনবিবির অস্তিত্বের সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ে না গিয়ে আমরা এটা বলতে পারি যে, মানুষ যখন কোনো কিছুর সামনে অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়ে, তখন তারা সেই অসহায়ত্বকে মোকাবেলা করবার জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছু একটার উপর নির্ভরশীল হয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে চায়। বনবিবির উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসও হয়তো এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস ও ভক্তি হ্রাস না পেয়ে বরং আরও বেশি দৃঢ় হয়েছে। হয়তো এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই তারা সাহসের সাথে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ও অবলম্বন খুঁজে পায়।