(প্রথম পর্ব)

১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় মুসলিম শাসনামলে এ দেশীয় হিন্দু সম্প্রদায় যাদের কেউবা উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ, কেউবা নিমবর্ণের শূদ্র-সবাই মুসলিম সুলতানদের সংস্পর্শে এসেছেন। এদের কেউবা উচ্চপদে রাজকার্যে নিয়ােজিত হয়েছেন কেউবা সেনাপতি পদে মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় সব সুলতানের দরবারেই উপযুক্ত হিন্দুরা প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। এসব মুসলিম শাসক তাদের জীবনাচরণে যে উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। ফলে দেখা যায় মুসলমানদের এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দরুন অনেক ব্রাহ্মণও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ রাজপৃষ্ঠপােষকতার জন্য মুসলমান হয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিজেদের শাস্ত্রগত কারণে অনেক ব্রাহ্মণ সমাজ স্পর্শদোষ, খাদ্যাদোষ অথবা দ্রাণদোষে পতিত হতাে বলে তারা মুসলমান হতাে। এ ছাড়া দক্ষিণ বঙ্গের একটা বড় অংশ মুসলমান হয়ে যায় সমুদ্রের কারণে। সমুদ্র ভ্রমণ, সমুদ্র বাণিজ্য, মৎস্য শিকার ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল বলে দক্ষিণ বঙ্গের ধীবর শ্রেণী, উপকূলীয় জনসাধারণ দলে দলে মুসলমান হয়ে যায়। সুলতানি আমল পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, নগরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক মুসলমানের বসবাস। নির্যাতিত অপমানিত জনসাধারণ সাধারণত গ্রামেই বাস করতেন। এ ক্ষেত্রে উদার প্রকৃতির সুফি সাধকদের ব্যাপক ভূমিকাও উল্লেখযােগ্য। এসব সাধক পুরুষ কেবল ধর্ম প্রচার করতেন না। বরং তারা রাস্তা তৈরি, সেতু নির্মাণ, চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখতেন। ফলে স্থানীয় জনসাধারণ তাদের (সুফিদের) ত্রাণকর্তা হিসেবে ভাবতেন। এ প্রসঙ্গে বাগেরহাটের খানজাহান আলীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলার হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্মান্তরের বিষয়ে সবিস্তারে আলােচনার মাধ্যমে এটুকু স্বীকার করে নেয়া যায় যে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন বাংলার সুফিরা।
May be an image of outdoors
 
(দ্বিতীয় পর্ব)
 
তবে এ ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দু-একটি বিষয়ে মারাত্মক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই এমনটা মনে করে থাকেন যে, বাংলায় একচ্ছত্রভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন বলেই বাংলাদেশ হয়ে ওঠে মুসলিম প্রধান অঞ্চল। নেহরু তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়াতে এমনটি বলেছেন, বাঙালি মুসলমানদের শতকরা ৯৮ ভাগ সমাজের নিমস্তরের হিন্দু থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এরা সবাই ছিল সংস্কৃতির দিক থেকে অনগ্রসর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে নিতান্ত দরিদ্র। কিন্তু এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি আজ আর মেনে নেয়ার কোনাে সঙ্গত কারণ নেই। ইতিহাসের রূঢ় বাস্তবতা এই যে, পুরাে দক্ষিণ এশিয়াতেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ এবং অন্য হিন্দুদের দ্বারা নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। ফলে যুক্তি অনুযায়ী পুরাে দক্ষিণ এশিয়াতেই হিন্দুদের সর্বত্র দলে দলে মুসলমান হয়ে যাওয়া সঙ্গত ছিল। কিন্তু কার্যত মােটেই তা ঘটেনি। ফলে কেবল নিম্নবর্ণের হিন্দুরা মুসলমান হওয়ার দরুন বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাধিক্য ঘটেছে এমনটা ভাবার কোনােই কারণ নেই। এ ক্ষেত্রে একটা স্পষ্ট উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন : ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম যথাযথভাবে আদমশুমারি হয়। তাতে দেখা যায়, ওই সময় হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মুসলমানদের চেয়ে ৫ লাখ বেশি। হিন্দু ১৮১ লাখ এবং মুসলমান ১৭৬ লাখ। ঠিক ১০ বছর পর ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারিতে দেখা গেল হিন্দু ১৮১ লাখ কিন্তু মুসলমান ১৮৪ লাখ। এরপর বাংলাদেশে (ব্রিটিশ বাংলায়) মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কিন্তু ওই পরিসংখ্যানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আসলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা (অন্তত যে সময়ের পরিসংখ্যান দেয়া হলাে সেই সময়ে) তেমনভাবে মুসলমান হয়নি। ওপরের পরিসংখ্যান তেমনটিই বলছে। (দেখুন ইসলামী শিল্পকলা, এবনে গােলাম সামাদ) রাজনৈতিকভাবে দেখতে পাই শাহ মাহমুদ গজনভির কাছে বিক্রমকেশরী সদলবলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে ওই রাজ্যে ব্যাপকসংখ্যক লােক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। শাহ সুলতান রুমির কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন কোচ রাজা। ওই সময় ওই রাজ্যের ব্যাপকসংখ্যক লােক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তেমনি সাধক শেখ নূর কুতুবুল আলম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন গণেশ এবং যদু জালালুদ্দিনকে। হজরত শাহজালাল র:-এর হাতে বাইয়াত হন সিলেটের বহু হিন্দু ও আদিবাসী। তেমনি শাহ ইসমাঈল গাজী উড়িষ্যা ও কামরূপের রাজাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। এসবই মুসলিম শাসনামলের প্রাথমিক যুগের ঘটনা।
(তৃতীয় পর্ব)
 
সুতরাং দেখা যাচ্ছে কেবল নিম্নবর্ণের লােকেরাই ইসলামে দীক্ষা নিয়েছেন এমনটা আজ আর স্বীকার করে নেয়া যায় না। এ কথা সত্য যে, ইখতিয়ার উদ্দিন মােহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ের পর বহু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন তেমনি এ কথাও সত্য যে, স্থানীয় ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি কখনোই কোনাে ব্যবস্থা নেননি, বরং তার দরবারে সেনাপতি ও মন্ত্রী ছিলেন ভিন্ন মতাবলম্বী। মুসলমানরা (সচরাচর ২-১টি ব্যতিক্রম ব্যতীত) কখনােই নিজেদের ধর্মমতকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেননি। এর বড় প্রমাণ এই যে, প্রায় ৭০০ বছর দিল্লি মুসলিম শাসকদের করায়ত্তেও থাকলেও আজো তা হিন্দুপ্রধান এলাকা। উদাহরণস্বরূপ আরাে বলা যায় বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আফগানিস্তানের প্রখ্যাত আলেম মৌলভী জালালুদ্দিন গজনভি লক্ষ্ণৌতে আগমন করেন এবং তিনি শাসকদের যার যার ধর্মীয় অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করে সমাজ শাসনের পরামর্শ দেন। মােহাম্মদ বিন কাসেম যিনি সর্বপ্রথম ভারতের দেবল নগরী (করাচি) জয় করেন। তিনি রাজা দাহিরের আমলের সকল রাজকর্মচারীদের পুনর্বহাল করেছিলেন। তিনি বলতেন যে বিজিত অপরিচিত দেশ শাসনে অভিজ্ঞজনের প্রয়ােজন। কেবল তা-ই নয়, ইতিহাস সাক্ষী, মােহাম্মদ বিন কাসেম স্থানীয় জনগণের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের জন্য কিছু অবাধ্য মুসলমান সহযাত্রীদের শাস্তি প্রদান করেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, জালালুদ্দিন, রুকন উদ্দিন বরবক শাহ, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এদের সবার রাজ দরবারে উচ্চপদে হিন্দু রাজকর্মচারী ছিল। একইভাবে প্রায় সব সুলতান, সুবাদার, নবাবদের সাথেও হিন্দু সেনাপতি, মন্ত্রী ছিল। এসব সুলতানের দরবারে সকল ভিন্ন মতাবলম্বী পূর্ণ সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ভােগ করেছেন। এ সময় শুদ্র বা নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও রাজপ্রাসাদে উচ্চ মর্যাদা নিয়েই বাস করত। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের উজির ছিলেন গুপিনাথ বসু, সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণব ভাতৃদ্বয় রূপ ও সনাতন যথাক্রমে রাজস্ব বিভাগের প্রধান ও একান্ত সচিব ছিলেন। ব্যক্তিগত চিকিৎসক মুকুন্দ দাস, দেহরক্ষী কেশবছত্রী, তার দুই সেনাপতি গৌড় মল্লিক ও রামচন্দ্র। জালালুদ্দিনের মন্ত্রী ছিলেন বৃহস্পতি মিশ্র। মুর্শীদ কুলী খাঁ এর দেওয়ানী বিভাগে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক হিন্দু চাকরি করতেন। অনেক ঐতিহাসিক তাে এমনটাও বলে থাকেন যে সুলতানি আমলে রাজপ্রাসাদকে ঘিরে একটা হিন্দু আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল।
 
( চতুর্থ পর্ব )
সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, সিরাজুদ্দৌলা প্রমুখের দরবারের হিন্দু রাজকর্মচারীদের কথা তাে কমবেশি সবাই অবগত। গৌড়ের প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ শিখাই সান্যাল নামক ব্রাহ্মণকে চলনবিলের দক্ষিণাংশ এবং সুবদ্ধি রায় ভাদুড়িকে চলনবিলের উত্তরাংশের জমিদারি দেন। রাজা গণেশ মুসলমান হয়েছেন সে কথা জেনেছি। সাথে এটুকুও বলে নেয়া যেতে পারে যে পরবর্তীকালে তার বংশধররাও মুসলমান হন। বাংলার মুসলমান বিজয়ের আগেই দেখা যায় রাজা লক্ষণ সেন বিখ্যাত মুসলমান সাধু শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজের শিষ্য হয়েছিলেন। এমনিভাবে এসব উদাহরণ আরাে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে দেখা যায় মঙ্গলরাজ চেঙ্গিস খান সমগ্র মধ্য এশিয়ার তুর্কী মুসলমানদের রাজ্য ও বােখারা সমরখন্দ প্রভৃতি ইসলামি সংস্কৃতির প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলাে ধ্বংস করেন। ফলে এসব অঞ্চল থেকে দলে দলে তুর্কি মুসলমান প্রথমে উত্তর ভারতে ও পরে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলার সুলতানগণ এসব জ্ঞানী-গুণী তুর্কি মুসলমানদের যথাযােগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। এদের বাহিত সংস্কৃতি এবং চিন্তাধারাই ছিল বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনের মূল বুনিয়াদ। আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্য যেমন : লায়লা-মজনু, ইউসুফ জোলায়খা, শিরি-ফরহাদ, হাতেম তাঈ, চাহার দরবেশ, গুলে বাকওয়ালী, যার প্রভাব পড়েছিল এ দেশের সর্বত্র। এসব কাহিনী সাহিত্য জন্ম নিয়েছিল প্রধানত বাগদাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিরাট ইসলামি সাম্রাজ্যের মধ্যে। এসব কাহিনী এ দেশে এসেছিল। বহিরাগত মুসলমানদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। পরে এগুলাে হয়ে উঠেছে এ দেশের লােককাহিনীর সমতুল্য। ফলে দেখা যায় একমাত্র খাস আরব ভূমি ব্যতীত আর সর্বত্রই বাইরে থেকে ইসলাম এসেছে। কিন্তু বাইরে থেকে এলেও ইসলাম তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য হয়ে উঠেছে এ দেশের মানুষের বিরাট অংশের এক অতি প্রিয় ধর্ম। ফলে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন পৃথিবীর সর্বত্রই মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে ও ধর্মান্তরণে একটা মূলগত ঐক্য দেখা যায়। বাংলাদেশেও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। (দেখুন বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ. ২৩১)। অধ্যাপক আহমদ শরীফ তার মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ গ্রন্থে বলেন, মুসলমানগণ ইরান, তুরান যে স্থান হতে আসুক না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণ বাঙালি হয়ে পড়লেন। তাহারা হিন্দু প্রজামণ্ডলী পরিব্যাপ্ত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। এরপর আর মুসলমান শাসক এবং সাধকদের উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে কোনাে সন্দেহ পােষণ করা যায় না।