দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া এই তিনটি দেশ নিয়ে গঠিত ছিল ইন্দোচীন অঞ্চল যেখানে ১৮৬০ সাল থেকে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল এবং এই অঞ্চলকে ফ্রান্স বলত ‘ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১ সালে জাপান ভিয়েতনাম আক্রমণ করে এর দখল নিলেও ফরাসী শাসন তখনও বিদ্যমান ছিল। এমতাবস্থায় ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চি মিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৪১ সালের মে মাসে ফ্রান্স ও জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য তৈরী করেন এক সংগঠন ‘ভিয়েত মিন’, যার অর্থ ‘ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংঘ’। ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে জাপানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ‘ভিয়েত মিন’, এর নেতৃত্বে ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপ। ১৯৪৫ সালের মার্চে জাপান ভিয়েতনামী ‘বাও দাই’কে রাজা বানিয়ে ভিয়েতনামকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ৬ই ও ৯ই আগস্ট হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের পর জাপানের আত্মসমর্পণ যখন আসন্ন, সে সময় আগস্টের ১৪ তারিখে ‘ভিয়েত মিন’ ভিয়েতনামের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করা শুরু করে। ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে পরিচিত এই বিপ্লবের মাধ্যমে ভিয়েত মিন ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর উত্তর ভিয়েতনামের ‘হ্যানয়’ শহরে স্বাধীন ভিয়েতনামের ঘোষণা দেয়। ভিয়েতনামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম’ (DRV)। বাও দাইকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয় হো চি মিনকে। গোটা ভিয়েতনামে ২০ দিন এই সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে ফরাসি বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন শহর থেকে এই নতুন সরকারকে উৎখাত করে। শুরু হয় ‘প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ’। উত্তর ভিয়েতনাম তখনও ভিয়েত মিনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গোটা ভিয়েতনামে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া ফ্রান্স ক্ষমতাচ্যুত রাজা বাও দাইকে প্রধান করে ১৯৪৯ সালের জুনে দক্ষিণ ভিয়েতনামে নতুন সরকার গঠন করে এবং ‘সায়গন’কে এর নতুন রাজধানী ঘোষণা করে।
ইতিমধ্যে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনে আসে কৃষক বিপ্লবের সোনালী সাফল্য। ১৯৪৯-১৯৫০ সালে চীন, সোভিয়েত ইউনয়ন সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দেশগুলো উত্তর ভিয়েতনামকেন্দ্রিক ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম (ডিআরভি)’কে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি স্বীকৃতি দেয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের বাও দাইয়ের সরকারকে। এদিকে ভিয়েত মিন বাহিনী ফরাসী সেনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৫৪ সালের ৭ই মে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় ফরাসীরা, জয় হয় ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের। ১৯৫৪ সালেরই ২১ জুলাই স্বাক্ষরিত জেনেভা চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয় প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সমগ্র ইন্দোচীন অঞ্চল ফরাসী শাসনমুক্ত হয় কিন্তু ভিয়েতনাম আনুষ্ঠানিকভাবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর ভিয়েতনামের দায়িত্বে থাকে হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, আর দক্ষিণ ভিয়েতনামে বাও দাই। বলা হয়, ‘সেভেনটিন্থ প্যারালাল’ নামক যে সীমারেখা দিয়ে উত্তর আর দক্ষিণ ভিয়েতনামকে ভাগ করা হয়েছিল, ১৯৫৬ সালে সেটি বিলুপ্ত করে দুই ভিয়েতনামকে এক করা হবে। গোটা ভিয়েত জাতির দ্বারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সাময়িক বিভাজনকে মুছে দুই ভিয়েতনাম আবার এক হবে। কিন্তু ভিয়েতনামের মানুষের সেই ঐক্যবদ্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়াল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত ‘ডোমিনো তত্ত্ব’ অনুযায়ী কোনো একটি দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা তার আশেপাশের সব দেশে সাম্যবাদের জোয়ার বয়ে আনবে। তাই তাদের ধারণা হয় ভিয়েতনামে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হলে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্যবাদ ছড়িয়ে পড়বে। ফলত জেনেভা চুক্তির বিরোধিতা করে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আবারও নতুন সরকার গঠন করে ভিয়েতনামের ঐক্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে এক ভুয়ো নির্বাচনের মাধ্যমে বাও দাইকে সরিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হন প্রচণ্ড কমিউনিস্টবিদ্বেষী ‘দিন দিয়েম নো’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ তখন তুঙ্গে। আর সোভিয়েতের সমর্থন ছিল উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের ওপর। তাই দক্ষিণ ভিয়েতনামের ‘দিন দিয়েম’ সরকারের সেনার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ ভিয়েতনামে যারা উত্তরের ভিয়েত মিন বাহিনীকে তথা ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামের দাবিকে সমর্থন করত, তখন তাদেরকে কমিউনিস্ট বলে ধরে এনে তাদের ওপর দিন দিয়েম নো শুরু করে নির্যাতন। প্রায় ১ লক্ষ ঐক্যপন্থী ভিয়েতনামীকে গ্রেফতার করে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়, অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
১৯৫৭ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জনগণ বিদেশী শক্তির মদতপুষ্ট সরকারের সেনার বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই শুরু করে। ওদিকে যুদ্ধ এড়িয়ে রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে জয়ের চেষ্টা বিফল হবার পর ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অত্যাচারী শাসকের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট মতাদর্শীদের সাথে অ-কমিউনিস্টরাও মিলিত হয়ে ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’ (NLF) নামের একটি সংগঠন তৈরী করে। স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন NLF এর বেশিরভাগ সদস্যই দক্ষিণ ভিয়েতনামী অ-কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও, মার্কিন প্রশাসন NLF-কে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন উত্তর ভিয়েতনামের অধীনস্থ সংস্থা হিসেবেই ধরে নিয়ে এর সদস্যদের ব্যঙ্গ করে ‘ভিয়েত কং’ বা ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৬১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ঐক্যপন্থীদের প্রতিহত করার জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিলেন। ওদিকে NLF-কে সহায়তা দিতে থাকে রাশিয়া ও চীন। ১৯৬৩ সালের ১লা নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিন দিয়েম নো সরকারের পতন ঘটে। ২রা নভেম্বর বিপ্লবীদের হাতে দিন দিয়েম নো নিহত হন। ১৯৬৪ সালে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপর উত্তর ভিয়েতনাম বোমাবর্ষণ করে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। শুরু হয় ‘দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য ভিয়েতনামে প্রেরণ করে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র আরও সৈন্য পাঠিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাহিনী গঠন করে। ১৯৬৮ সালে নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বেড়ে যায়। লুকিয়ে যুদ্ধ করা গেরিলা সেনাদের সহজে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন হারবিসাইড বোমা ও রাসায়নিক বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয় যার দ্বারা জঙ্গল ধ্বংস করে সবুজ ভিয়েতনামকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলা হয়। মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় আট কোটি লিটারেরও বেশি বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বর্ষণ করে যার ফলে ভিয়েতনামের পরিবেশ চরম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ বোমা সাড়া পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হয়েছিলো তার চারগুণের বেশি বোমা একটি দেশ ভিয়েতনামের বুকে বর্ষিত হয়েছিল। ডাই অক্সিন এজেন্ট নামের জৈব রাসায়নিক মারণাস্ত্র নিক্ষেপের ফলে আজও ভিয়েতনামে মানসিক ভারসাম্যহীন, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে নাপাম বোমা ব্যবহার করে এক নৃশংস গণহত্যা চালানো হয় যাতে প্রায় পাঁচশো লোক নিহত হয়। ভিয়েতনামও থেমে থাকেনি। আকাশপথে মার্কিনীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তাদের বিশেষ যুদ্ধকৌশল ছিল মাটির নীচে সুড়ঙ্গ বানিয়ে লুকিয়ে যুদ্ধ। তারা ভিয়েতনামের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে দিনে দুপুরে হামলা চালিয়ে মার্কিন সেনাদের ঘায়েল করছিল।
সংবাদকর্মীদের সাহায্যে যুদ্ধের ভয়াবহতার সংবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব অসন্তোষ বাড়তে থাকে। খোদ আমেরিকাতেই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তুমুল জনমত তৈরী হয়। উভয়সঙ্কটে পড়ে মার্কিন প্রশাসন আলোচনায় বসতে রাজী হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩শে জানুয়ারী প্যারিসে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত ছিলঃ যুদ্ধবিরতি, মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে নির্বাচন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও বোমা বর্ষণ চালাতে থাকে। ফলে উভয় পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং কোথাও কোথাও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হেনরি কিসিঞ্জার এবং ভিয়েতনামের পক্ষে লি ডাক থো প্যারিস চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পুনরায় স্বাক্ষর করেন। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৩০শে এপ্রিল দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়ে সরকারীভাবে ‘ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্বতন উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী ‘হ্যানয়’ শহরকেই সমগ্র ভিয়েতনামের রাজধানী নির্ধারণ করা হয়। আর পূর্বতন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী ‘সায়গন’-এর নামকরণ করা হয় ‘হো চি মিন সিটি’।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়ঃ প্যারালাল II Parallel