ঢাকার ওয়ারী এলাকা। ছোট্ট একটি বাক্স হাতে নিয়ে পায়চারি করছে শিবুরী। শিবুরীর বয়স আট বছর। সে ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। শিবুরী তার মা-বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। প্রতিদিন স্কুল শেষে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় সবসময় তার পছন্দের খাবারই রান্না হয়। পেট ভরে খেয়ে-দেয়ে শিবুরী কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর নিজের বই-খাতা খুলে পড়তে বসে সে। পড়া শেষ করা নিয়ে শিবুরীর মনে খুব তাড়া, কারণ পড়া শেষ করে সে তার পছন্দের কাজটি নিয়ে বসে। আর তার পছন্দের কাজ হলো সাজগোজ করা। শিবুরী তার মায়ের অসংখ্য মেকআপ সামগ্রী হাতে নিয়ে আলতো করে হাত বুলায় সেগুলোতে।
মেকআপ করতে তার ভীষণ ভালো লাগে। কি নেই তার মায়ের ড্রেসিং টেবিলে! ফাউন্ডেশন, কনসিলার, প্রাইমার, শ্যাডো, লিপস্টিক, নেইল পলিশ –কোনো কিছুরই অভাব নেই। এই মুহূর্তেও শিবুরী তার মায়ের একটি আইশ্যাডো প্যালেট হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখছে। কিছুক্ষণ আগেই পড়া শেষ করেছে সে। একটু পর মা আর বাবার সাথে শিবুরী একটি বিয়ের দাওয়াতে যাবে। শিবুরীর মা নিজের কাজ শেষ করে এসে তাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। শিবুরী মুগ্ধ হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলো। কতো সুন্দর লাগছে তাকে! মাকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে। শিবুরীর মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে। আজকের দিনটা তার ভীষণ ভালো কাটবে।
ঢাকা থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে ভারতের ঝাড়খন্ড। বিশাল এক গর্তের মুখে বসে আছে ঝাড়খন্ডের মেয়ে শিবুরী। শিবুরীর বয়স আট বছর। তার চিবুক বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। শিবুরী যে গর্তের মুখে বসে আছে, সেটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভ্র খনি। অভ্র এক ধরনের স্বচ্ছ ধাতব পদার্থ। এর আরেকটি নাম হলো মাইকা। টুথপেস্ট তৈরীতে কিংবা উজ্জ্বল কোনো রং তৈরীতে এই অভ্র ব্যবহার করা হয়। তবে অভ্র সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে মেকআপ সামগ্রী বানাতে। যতো বেশি উজ্জ্বল মেকআপ, ততো বেশি প্রয়োজন এই অভ্রকে। আর তাই ‘হাইলাইটার’ নামের মেকআপে অভ্রর ব্যবহার হয় অনেক বেশি পরিমাণে।
ঝাড়খন্ডের মেয়ে শিবুরী তার ভাই-বোনদের মাঝে সবচেয়ে ছোট। পাঁচ বছর বয়স থেকে সে তার ভাই-বোনদের সাথে অভ্র উত্তোলনের কাজ করে আসছে। অভ্রর খনিগুলো অনেক গভীর, ছোট আকৃতির এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়। শিবুরী এই তিন বছরে তার পাঁচজন বন্ধুকে এই অন্ধকার গর্তের ভেতর পড়ে গিয়ে মরে যেতে দেখেছে। প্রথমবার তার এক বন্ধু গর্তে পড়ে যাবার পর থেকে শিবুরী কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। তার এই ছোট্ট মনে অনেক প্রশ্ন, যার কোনো উত্তর সে খুঁজে পায় না। শিবুরী কখনো স্কুলে যায় নি। খেলাধুলা করারও সময় পায় না সে। কোনো উৎসবও ঝাড়খন্ডের এই অঞ্চলে কখনো উদযাপিত হতে দেখে নি সে। টানা আট থেকে নয় ঘন্টা কাজ করার পর ঘরে ফিরে ভীষণ ক্লান্ত লাগে তার। তবুও আট-নয় ঘন্টায় যে খুব অভ্র তোলা সম্ভব হয় তাও নয়, মাত্র এক কেজির কাছাকাছিই অভ্রর বালু তুলতে পারে তারা সারাদিনে। কাজ শেষ করার পর বিশ রুপি হাতে নিয়ে ঘরে ফেরে প্রত্যকে। কিন্তু বিশ রুপি দিয়ে তো আর পর্যাপ্ত খাবারের যোগান দেয়া যায় না। তাই প্রতিদিনই হয় না খেয়ে, আর নাহয় অল্প খেয়ে খিদে পেটে থাকতে হয় তাদেরকে। এই দুর্বল শরীর নিয়েও শিবুরীর কোনো ছুটি নেই। পরের দিন আবারও তাকে কাজে যেতে হবে। পেছনে ফিরে দেখবার কোনো উপায়ও নেই তার। বিশ-ত্রিশ রুপি যা-ই সে পায়, এটুকু আয় না করলে না খেয়ে মরতে হবে তার পরিবারের সবাইকে, সংসারটা চলেই তো তার আর তার ভাই-বোনদের আয়ে। শিবুরী তার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলো, অন্য প্রায় সব খনিজ পদার্থ উত্তোলনে নাকি উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়। শিবুরী ভেবে পায় না, এতো যন্ত্রপাতি থাকতে তাদেরকে কেনো অভ্র তোলার সম্পূর্ণ কাজটা হাতে করতে হয়। অভ্রর বালু তুলে আবার পরিষ্কারও করতে হয় এবং সেটাও হাত দিয়েই করতে হয়। অভ্রখনির গর্তের মুখে বসে এগুলোই ভাবছিলো শিবুরী। আজ তার শরীরটা ভালো না। গতকাল রাতে ঠিকমতো খেতেও পারে নি, ঘুমাতেও পারে নি সে। রাত থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তার। এখানে শিবুরীর সাথে কাজ করা বেশিরভাগ শিশুরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে কম-বেশি। তাই শিবুরী প্রথমে তেমন পাত্তা দেয় নি। কিন্তু এখন তার শরীর খুব বেশি খারাপ লাগছে। তাই গর্তের মুখে বসে পড়েছে সে। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না শিবুরী। এলাকার প্রভাবশালী লোকদের পাহারাদারদের একজন এসে কান মলে দিলো তার, কোনোভাবেই সময় নষ্ট করা যাবে না। শিবুরী উঠে দাঁড়ালো। তার পা টলমল করছে, মাথা ঘুরছে, তবুও অনেক কষ্টে গর্তের ভেতরের দিকে যেতে লাগলো সে। হঠাৎ পা পিছলে গেলো তার, তাল সামলাতে পারলো না শিবুরী। তার ছোট্ট শরীরটা অভ্রখনির অন্ধকার গর্ত দিয়ে পড়ে যেতে লাগলো।
দুপুরের রোদ খানিকটা পড়ে এসেছে। ঢাকার শিবুরী তার মা-বাবার সাথে রওয়ানা হয়েছে বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিক একই সময়ে ঝাড়খন্ডের এক অন্ধকার গর্ত থেকে তুলে আনা হচ্ছে একটি লাশ। লাশটি একটি আট বছরের ছোট্ট মেয়ের, নাম শিবুরী।