প্রেসিডেন্ট কেনেডির জন্মদিন উপলক্ষে সাজো সাজো রব নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে, জন্মদিনের দশদিন আগে ১৯শে মে প্রেসিডেন্টের জন্মদিনের খাতিরে এই সান্ধ্যকালীন পার্টি একরকম উৎসবের চেহারা নিয়েছে। অতিথির তালিকাও নেহাত ছোট নয়। কে নেই সেই তালিকায়? বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে হলিউডের উজ্জ্বল তারকারাও। মারিয়া কালাস, ফ্র্যাঙ্ক সিনেত্রা, এলা ফিটজেরান্ড-এর মত ডাকসাইটে শিল্পীরা গাইবেন এই কনসার্টে। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই নিমন্ত্রিত অতিথির সমাগমে গমগম করছে ম্যাডিসন স্কোয়ারের কনসার্ট হল। গণ্যমান্য অতিথিবর্গ এগিয়ে এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে। পানপাত্র ছলকে পড়ছে উষ্ণ পানীয়ে, পরিবৃত ঝিলমিল রাত পার্টিতে সুন্দরী নারী পুরুষরা সবাই নিজের মতো মশগুল। এ এক মায়াবী রাত।
এক সময় মঞ্চে উঠলেন সুন্দরী লাস্যময়ী স্বর্ণকেশী মেরিলিন মনরো, হীরক দ্যুতি ছড়ানো সাদা ক্রিস্টালের গ্রাউনে স্পষ্ট তাঁর মোহময় শরীরী বিভাজিকা। এক নিমেষে সমস্ত অতিথির আকর্ষণকে টেনে নিলেন নিজের দিকে, মঞ্চের উজ্জ্বল আলোকবৃত্তের মাঝে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে অল্প সময়ের জন্য থামলেন। তারপর বিলোল কটাক্ষে দুষ্টু হাসিতে মোহময় কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট কেনেডির দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলেন হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…
যেকোনো নৈশ পার্টিতে বয়সে নবীন, স্বভাবে ফ্লামবয়েন্ট কেনেডি থাকা মানেই তাঁকে ঘিরে রতি রাত। কনসার্ট শেষে কেনেডির থেকে অদূরে স্বপ্নসুন্দরী মনরোকে ঘিরে এক দঙ্গল পুরুষ যাঁদের মধ্যে কেনেডির ভাই রবার্টও আছেন। কিন্তু স্বপ্নসুন্দরীর চোখ কেনেডির দিকে, কেনেডির চোখেও কামনার আগুন। একসময় সমস্ত গুণমুগ্ধ পুরুষকে এড়িয়ে মনরো এসে বসলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির পাশে। কেনেডির তখন তর সইছে না, মনরোর চোখেও সম্মতির আভাস, মনরোর শরীরের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই বাঁক-উপবাঁক কেনেডিকে অস্থির করে তুলেছে। তাঁর অবাধ্য হাতের আঙ্গুল মনরোর খোলা পিঠে বেয়ে ধীরে ধীরে কোমরের দিকে এগিয়ে গেল।
এভাবেই শুরু হয়েছিল মনরো-কেনেডির উত্তাল প্রেমপর্ব, ততদিনে তৃতীয় স্বামী আর্থার মিলারের সাথে সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মনরোর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের এই প্রেমপর্ব আমেরিকার জনমানসে তুমুল আলোচিত বিষয় ছিল। মনরোর রহস্যজনক মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস আগে এটাই ছিল মনরোর জনসমক্ষে শেষ উপস্থিতি। শোনা যায় মৃত্যুর আগে শেষ ফোনটি মনরো করেছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকেই।
মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে আজও মেরিলিন মনরোর রহস্যমৃত্যুর যেমন কোনো কিনারা হয়নি, তেমনি এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী লাস্যময়ী তারকা ও অভিনেত্রীর যৌন আবেদনের মুগ্ধতার রেশ এখনো স্তিমিত হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে মনরোর ব্যাপারে দর্শকের আগ্রহ কমেনি বিন্দুমাত্র। একাধারে অভিনেত্রী-গায়িকা, পিনআপ মডেল, হলিউডের বিউটি কুইন মনরো ছিলেন সৌন্দর্য এবং যৌন আবেদনের মূর্ত প্রতিমূর্তি। তাঁর ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য, অলঙ্ঘনীয় যৌন আবেদন আর দুষ্টু হাসি অগণিত তরুণের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল; কেড়ে নিয়েছিল রাতের ঘুম। কিংবদন্তী এই শিল্পী মৃত্যুর এত বছর পরেও পপ কালচার এর একজন কাল্ট ফিগার ও জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবে দর্শকের কাছে আকাঙ্ক্ষিত, স্মরণীয় এবং দর্শক এখনো মোহাবিষ্ট।
যে সময়টায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন মনরো অর্থাৎ ৫ ও ৬ এর দশকের প্রথম দিকের সেই সময়টা ছিল সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের সময়। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হচ্ছে একগুচ্ছ দেশ, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে গণ-আন্দোলন। ওদিকে ডি এইচ লরেন্স এর ‘লেডি শার্লিস লাভার’ ৩২ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর মুক্তি পাচ্ছে ইংল্যান্ডে, হিউ হেফনার প্লে-বয় পত্রিকা ও প্লেবয় ক্লাব খুলছেন শিকাগোতে, গর্ভনিরোধক জনপ্রিয় হচ্ছে মহিলামহলে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা শুধু নয়, যৌন স্বাধীনতার উদযাপনও ছিল এই সময়ের দাবি। এমনই সময়ের এক কিংবদন্তি চরিত্র মেরিলিন মনরো।
মেরিলিন মনরোর জীবনটা ছিল রূপকথার দুঃখী রাজকন্যার মত। খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি- একসময় সবই পরাজিত সৈনিকের মতো নতজানু হয়ে ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁর ভুবনমোহিনী হাসির আড়ালে লুকিয়েছিল অস্ফুট কান্নার শব্দ। ১৯২৬ সালের ১লা জুন লস অ্যাঞ্জেলসের কাউন্টি হাসপাতালে গ্ল্যাটিস পার্ল বেকারের কোলে জন্ম নেন নর্মা জেন, গ্লাটিসের তৃতীয় সন্তান ছিলেন নর্মা। অত্যাচারী প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর গ্ল্যাটিস জনৈক মার্টিন এডওয়ার্ড মার্টেনসেনকে বিয়ে করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। নর্মার জন্মের সময় মার্টিন নিশ্চিত ছিলেন না এই সন্তান তাঁর কিনা, গ্ল্যাটিসও আশাব্যঞ্জক উত্তর দিতে পারেননি। ফলে নর্মার পিতৃপরিচয় ছিল না। সন্তানকে মানুষ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি বা মানসিক স্থিরতা কোনটাই ছিল না গ্ল্যাটিসের। আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুণ মানসিক চাপে গ্ল্যাটিস বহুবার ছোট্ট নর্মাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিলেন। গ্ল্যাটিসের মানসিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, আর ছোট্ট নর্মার জায়গা হয় অনাথ আশ্রমে। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত নর্মা প্রায় ডজনখানেক অনাথ আশ্রম ও পালক পরিবারে বড় হয়। এমনই এক পালক পরিবারের পালকপিতার কাছে যৌন নিগ্রহের শিকারও হয় নর্মা।
১২ বছর বয়সে মায়ের এক বান্ধবীর পরিবার তাঁকে পালনের দায়িত্ব পায়। এই পরিবার আর্থিক সমস্যার জন্য পুনরায় অনাথ আশ্রমে পাঠানোর কথা চিন্তা করলে শুধুমাত্র অনাথ আশ্রমে ফিরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ১৯৪২ সালের ১৯শে জুন ১৬ বছর বয়সে প্রতিবেশী যুবক জেমস ডগার্থিকে বিয়ে করেন নর্মা। জেমস একটি এয়ার ক্র্যাফট প্লান্টে চাকরী করতেন। দু’বছর পর নর্মা জেমসের কোম্পানিতে কাজে যুক্ত হন। শীঘ্রই তাঁর মোহনীয় রূপের জন্য কোম্পানির শো-গার্ল হিসেবে মডেলিংয়ের সুযোগ আসে। এই সময় ফাস্ট মোশন পিকচারর্স এর এক আলোকচিত্রী ডেভিড কোনভার সাথে পরিচয় হয়। ডেভিডের মাধ্যমে বেশ কিছু পত্রিকার মডেল হিসেবে কাজ করেন। ব্লু বুক মডেল এজেন্সির সাথে যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ে প্রায় ৩৩টি পত্রিকার কভার গার্ল ও পিনআপ মডেল হিসেবে নর্মাকে দেখা যায়। যার মধ্যে পিজেন্ট, ইউ এস ক্যামেরা, লাভ এন্ড পিক অন্যতম। মডেলিংয়ের ঝোঁক গ্ল্যামার জগতের হাতছানির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বামী জেমস। নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নর্মা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

Monroe with her first husband, James Dougherty, c. 1943–44. They married when she was 16 years old. Source: Wikipedia
১৯৪৭ সালের ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিও’-র সাথে কাজের সুযোগ আসে ‘ডেঞ্জারাস ইয়ার’ ও ‘স্কুডা হো স্কুডা হে’ নামক ছবিদুটিতে ছোট্ট রোলে অভিনয় করেন। ইতিমধ্যে নর্মা নিজের নাম পাল্টে ফেলেন, এখন থেকে তিনি মেরিলিন মনরো। পরে স্টুডিওর তরফে কোন কাজ না পাওয়ায় মনরো আবারও মডেলিং-এ ফিরে যান। অবশ্য মনরো মনেপ্রাণে অভিনেত্রী হতে চাইতেন। তাই এক্টরস্ ল্যাবটারী থিয়েটার নামের অভিনয় স্কুল থেকে অভিনয়ের পাঠ নিতে শুরু করেন। ‘ফক্স’-এর এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার জোসেফ এম স্কীনকের সাথে মনরোর পরিচিতি এবং নিছক বন্ধুত্বের বাইরের ক্যাজুয়াল যৌন সম্পর্কের জন্য স্কীনকের সাহায্যে স্কীনকের বন্ধু ‘কলম্বিয়া পিকচার্স’-এর হ্যারি কোহনের সাথে মনরোর পরিচয় হয় এবং কলম্বিয়া পিকচার্স মনরোকে পরবর্তী ছবির জন্য চুক্তি করে। খুব অল্প বাজেটের একটি ছবি ‘লেডিস অফ দ্য কোরাস’ ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে নাতাশা লাইটেস নামের এক অভিনয় শিক্ষিকার সাথে পরিচয় হয় মনরোর। কলম্বিয়া পিকচার্সের ওই জার্মান প্রশিক্ষকের সাথে মনরো ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর কাজ করেছেন। শেষের দিকে প্রায় দু’বছর মনরো ও নাতাশা লাইটেস সমকামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ‘লেডিস অফ দ্য কোরাস’ খুব ভালো চলল না। ১৯৫০-এ ‘লাভ হ্যাপি’ নামের আরো একটি ছবিতে অভিনয় করেন। এটারও সেই একই দশা। এদিকে গ্ল্যামার জগতে থাকতে গেলে ঠাটবাট বজায় রাখা খুবই দরকার, কিন্তু সেভাবে ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে একটি পানীয় কোম্পানির হয়ে মডেলিংও সুযোগ আসে। ‘মোনা মনরো’ নাম নিয়ে ঐ পানীয় কোম্পানির জন্য ন্যুড ফটোশ্যুট করেন মনরো।

Photo of Monroe taken by David Conover in mid-1944 at the Radioplane Company. Source: Wikipedia
‘এ টিকিট টু টোমাহক’, ‘রাইট ক্রশ’, ‘দ্য ফায়ারবল’ ছবিগুলিতে খুব ছোট চরিত্রে অভিনয়ের পর ‘দ্য এপসল্ট জঙ্গল’ ও ‘অল এবাউট ইভ’ ছবি দর্শক মহলে সাড়া ফেলে। ছোট্ট চরিত্র হলেও এই ছবিতে মনরোর লাস্যময়ী অভিনয় তাঁকে রাতারাতি তারকায় পরিণত করে। ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরির ফক্স’ আগামী সাত বছরের জন্য সাথে চুক্তি করে মনরোর সাথে। ফক্স এর সাথে চুক্তি মনরোকে হলিউডের রাস্তা প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছিল। এইসময় ‘এম জিএম’-এর ‘হোম টাউন ষ্টোরী’ ফক্স-এর ‘অ্যাজ ইয়াং অ্যাজ য়্যু ফীল’, ‘লাভ নেস্ট’, ‘লেটস মেক ইট লিগাল’- ছবি দর্শকের মন জয় করে, যদিও সমালোচক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। অভিনয় প্রতিভার তুলনায় তাঁর যৌন আবেদন আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে প্রায় প্রতিটি সিনেমাতে পর্দায় তাঁকে একজন যৌন আবেদনময়ী নারী হিসেবে দেখা যেত, পর্দায় তাঁর খোলামেলা পোশাক ঝড় তুলেছিল সমালোচকের কলমে আর লাখো পুরুষের হৃদয়ে। এলিজা কাজান, নিকোলাস রে, ইয়েল ব্যানার, পিটার লফোর্ড-এর মত চিত্র পরিচালকদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার খবর হলিউড গসিপ কলামগুলোতে নিয়মিত পরিবেশিত হতে থাকে। এই সময় মনরো তাঁর বাদামী চুলের রঙ পাল্টে প্লাটিনাম সোনালী আভা আনেন তাঁর এই স্বর্ণকেশদাম এক নতুন ও অনন্য স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, এটা ছিল মনরোর একান্ত নিজস্ব ট্রেডমার্ক। ১৯৫২-র মার্চে একটি বিতর্কের মুখোমুখি হোন মনরো, কিছু বছর আগে একটি ক্যালেন্ডারের জন্য নুড ফটোশ্যুট করেছিলেন। তা সামনে আসতে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে, কিন্তু ভক্তদের সহানুভূতি আদায়ে ব্যর্থ হননি মনরো। ‘ক্ল্যাশ বাই নাইট’, ‘ডোন্ট বদার টু নক’, ‘উই আর নট ম্যারিড’ ছবিতে তার প্রতিফলন পড়ে। পরে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কেন ন্যুড ফটোশ্যুট করেছিলেন?” তখন মনরো বালিকাসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, “ন্যুড কোথায় আমার সাথে তো একটি রেডিও ছিল!”

Monroe in The Asphalt Jungle (1950). This was one of her first performances noted by critics. Source: Wikipedia

Monroe with Keith Andes in Clash by Night (1952). The film allowed Monroe to display more of her acting range in a dramatic role. Source: Wikipedia

Monroe and Arthur Miller at their wedding in June 1956. Source: Wikipedia

Monroe with Lemmon and Curtis in Some Like It Hot (1959), for which she won a Golden Globe. Source: Wikipedia

Monroe, Betty Grable, and Lauren Bacall in How to Marry a Millionaire, her biggest box office success of 1953. Source: Wikipedia

Monroe’s dramatic performance in Bus Stop (1956) marked a departure from her earlier comedies. Source: Wikipedia
