১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলার হিন্দু ধর্মালম্বী বৃদ্ধ সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে নদীয়া ছিনিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের যে নতুন সূর্যোদয় হয়, তার অন্তিম পরিনতি আসে ব্রিটিশ রাজশক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে।
এই সুদীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন মুসলিম রাজবংশের উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই শাসিত হয় বাংলা। এই মুসলিম শাসকদের মধ্যে কোনো কোনো শাসক পরাক্রমশালী দিল্লী সালতানাতের অধীনে থেকে শাসন করেছেন আবার অনেকেই স্বাধীন সুলতান হিসেবে বংশ পরম্পরায় শাসন করেছেন পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এই ভূখন্ডকে। বাংলার এই স্বাধীনতা ১৩৩৮ সাল থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত প্রায় দুইশত বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিলে। এই লম্বা সময়ে বাংলার শাসনভার কখনও হিন্দু রাজন্যবর্গের হাতে তেমন পড়ে নি। এক্ষেত্রে ইতিহাসের পাতায় একজন হিন্দু রাজার নাম পাওয়া যায় যিনি কিছু সময়ের জন্য হলেও বাংলাকে ব্রাহ্মণ্য শক্তির অধীনে নিয়ে আসেন। পরাক্রমশালী মুসলিম রাজশক্তির হাত থেকে প্রায় একক কৃতিত্বে রাজা গণেশ সমগ্র বাংলায় হিন্দু রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন।
মূলত বাংলার মুসলিম সুলতানদের বেশিরভাগই ছিলেন ধর্মনিরপক্ষ। তাঁরা তাঁদের রাজসভার উচু পদে যোগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুব্যাক্তিদেরকে নিযুক্ত করেছিলেন। এই সমস্ত হিন্দু রাজপুরুষদের সবাই আক্ষরিক অর্থে মুসলিম সুলতানদের অনুগত ছিলেন না। তাঁদের অনেকেরই ভিনদেশী মুসলিম রাজশক্তির কবল থেকে পুনরায় বাংলায় হিন্দু শাসন ফিরিয়ে আনার উচ্চাভিলাষ ছিলো। রাজা গণেশ এমনই একজন উচ্চাভিলাষী অমাত্য ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের দরবারে। তিনি ইলিয়াস শাহী রাজবংশের হাত থেকে রাজসিংহাসন ছিনিয়ে নেন। তাঁর উত্থান নিয়ে খুব বিশদ বিবরণ খুব একটা পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় তিনি বর্তমান বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁয়ের ভাতুরিয়ার প্রাচীন জমিদারবংশের সন্তান ছিলেন। আবার অনেকের মতে তিনি দিনাজপুরের হাকিম তথা গভর্নর ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিনের উজীর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও দলীয় কোন্দল বিভিন্ন রাজবংশের পতন ডেকে নিয়ে আসে। বাংলার সুলতানের দরবারে আমির-ওমরাহদের এই রেষারেষীর সূচনা হয় মূলত সুলতান সিকান্দার শাহের সময় থেকে, যিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পিতা ছিলেন। এর চূড়ান্ত পর্যায়ে ও বিমাতার ষড়যন্ত্রে পিতা-পুত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সিকান্দার শাহ মৃত্যুবরণ করেন। মসনদে আরোহন করে তাঁর বিজয়ী পুত্র গিয়াসউদ্দিন। তাঁর দরবারেই রাজা গণেশ উচ্চপদ লাভ করেন। এর পাশাপাশি এসময় তিনি রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করেন। রাজা গণেশের এই উত্থানকে অনেকেই ভালো চোখে দেখলেন না। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আচঁ করতে পেরেছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত সুফী হযরত মুজাফ্ফর শামস বলখী।
তিনি কুরআন হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী সুলতান গিয়াসউদ্দিনকে সতর্ক করেছিলেন হিন্দু রাজ অমাত্যদের বেশি প্রশ্রয় না দিতে। কিন্তু ততোদিনে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কেন্দ্রের আমির -ওমরাহদের অনৈক্যের সুযোগে অনেকটাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন গণেশ। সুযোগ বুঝে সুলতানকে হত্যা করান তিনি। এরজন্য যে রাজা গণেশের উচ্চাভিলাষই শুধু দায়ী ছিলো তা নয়, ধারণা করা হয় রাজত্বের শেষ দিকে এসে সুলতান গিয়াসউদ্দিন কিছু ভ্রান্ত নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিছুটা বেকায়দা অবস্থায় ছিলেন। যদিও তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের অন্যতম যোগ্য সুলতান ছিলেন। রাজা গণেশ এ সময়ের সুযোগের সদ্বব্যবহার করেন। তাঁর কূটচালে কোনো এক গোলমালে মৃত্যুবরণ করেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন। সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন দরবারের অন্যতম উজির গণেশ।হামজা শাহ “সুলতান-উস-সালাতীন” বা সুলতানদের সুলতান উপাধী গ্রহণ করেছিলেন।তিনি নানাগুণে গুণান্বিত যোগ্য সুলতান ছিলেন। কিন্তু প্রায় দুবছরের মধ্যে তিনি নিজ কৃতদাস শিহাবউদ্দিন কর্তৃক নিহত হন। অধিকাংশ মত অনুযায়ী এই ঘটনারও মূলে ছিলেন গণেশ। এর মধ্য দিয়ে শিহাবউদ্দিন সুলতান হন নামে মাত্র আর মূল ক্ষমতা থেকে যায় গণেশের হাতে। শিহাবউদ্দিন মসনদে বসেন শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ নামে। তিনি প্রায় তিনবছরের মতো শাসন করেছিলেন। ধারণা করা হয় গণেশের প্রভাব থেকে বের হতে চাওয়ার জন্যেই গণেশ তাঁকে আক্রমন করে পরাজিত ও হত্যা করেন। এর ফলে গণেশের সামনে কার্যত আর কোনো বাধা থাকলো না। এর পরবর্তী অবস্থা বেশ অস্পষ্ট। বায়েজিদ শাহের রাজত্বের শেষের দিকের কিছু মূদ্রা পাওয়া যায়, যা আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের নামাঙ্কিত। ধারণা করা হয় তিনি বায়েজিদ শাহের পুত্র ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পর মসনদ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও গণেশের কাছে পরাজিত করেন। এরপর গণেশ নিজেই মসনদে আসীন হন “দনুজমর্দন দেব” নামে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজা গণেশের মসনদ প্রাপ্তীতে দরবারের আমির-ওমরাহদের অন্ত:কোন্দল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো। রাজা গণেশের মসনদ দখলে তাঁদের বোধোদয় হলেও তাঁদের তখন কিছুই করার ছিলো না। তাঁরা হতবিহবল হয়ে পড়েছিলেন। আরোও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলার সীমান্তবর্তী হিন্দু রাজ্যগুলোও রাজা গণেশের মিত্র ছিলো, কারণ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ তাঁর রাজত্বের শেষ সময়ে বাংলার প্রতিবেশী কামরূপ, কামতা ও ঊড়িষ্যায় ব্যার্থ সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন।কামতা-রাজ যখন অহোম-রাজ কর্তৃক আক্রান্ত হন তখন সুযোগ বুঝে গৌড়ের সুলতান কামতা আক্রমন করেন। তখন কামতা-রাজ স্বীয় কন্যার সাথে অহোম-রাজের বিবাহ দিয়ে মিত্রতা স্থাপন করে যৌথ বাহিনী গঠন করে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তাছাড়া সমসাময়িক কবি বিদ্যাপতির বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহ সুলতান গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত করেছেন।যদিও এটা সত্যি অবিশ্বাস্য যে, গৌড় তথা প্রায় সমগ্র বাংলার সুলতানকে রাজা শিবসিংহের মতো ক্ষুদ্র নরপতি পরাস্থ করেছেন। এই রাজা শিবসিংহের সাথে রাজা গণেশের মিত্রতা ছিলো এবং ধারণা করা হয় রাজা গণেশের উত্থানের পেছনে তাঁরও ভূমিকা ছিলো।
রাজা গণেশ মসনদে আসীন হয়েই হিন্দু শক্তির হৃত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন এবং মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চালান। সুফী -দরবেশরাও তাঁর অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তখন বৃদ্ধ সুফী নূর কুতুব আলম প্রতিবেশী মুসলিম শাসক জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীকে বাংলা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান এবং রাজা গণেশকে উৎখাতের আহবান জানান।ইব্রাহিম শর্কি এক বিরাট সৈন্যদল নিয়ে বাংলা আক্রমন করেন ফলশ্রুতিতে রাজা গণেশ ভীত হয়ে ওঠেন। তিনি নিজের ১২ বছরের নাবালক পুত্র যদুসেনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে সিংহাসনে বসানোর প্রস্তাব করেন হযরত নূর কুতুব আলমকে। মূলত এটা ছিলো তাঁর একটি রাজনৈতিক চাল। হযরত নূর কুতুব আলম দেখলেন সিংহাসনে একজন মুসলিম আসীন হবেন, তখন তিনি ভাবলেন যে এখন হয়তো মুসলিমদের উপর নিপীড়নের অবসান ঘটবে।তিনি সরল বিশ্বাসে যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ইব্রাহিম শর্কিকে নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর এই ভুল ভেঙ্গে যায়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, অবস্থা অপরিবর্তিত ও মূল ক্ষমতা রাজা গণেশের হাতেই রয়েছে। এইভাবে যদু প্রায় ২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। হযরতের ইন্তেকালের পর গণেশ যদুকে আবার শুদ্ধি আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মে ফেরত আনলেন ও নিজে পুনরায় মসনদে বসেন।এরপর তিনি প্রায় ১৪ মাস রাজত্ব করেন। এসময়ে নিজ পুত্র যদুকে কারাবন্দ্বী করে রাখেন। পরবর্তীতে যদু কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে পিতাকে হত্যার ব্যবস্থা করেন। এরপর সিংহাসনে বসেন রাজা গণেশের কনিষ্ঠপুত্র মহেন্দ্রদেব। দরবারের আমিরদের সমর্থনের অভাবে যদু প্রথমেই সিংহাসনে বসেন নি। এরমধ্যে তিনি ইসলাম ধর্মে আবার ফিরে আসেন এবং মহেন্দ্রদেবের প্রায় ২ মাসের সংক্ষিপ্ত শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেই সিংহাসনে বসেন। ইতোমধ্যে দরবারে তাঁর অনেক অনুসারীও জুটে যায়। যদু বাংলার মসনদে বসেন সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম নিয়ে। এইভাবে রাজা গণেশের সংক্ষিপ্ত হিন্দু শাসনামলের অবসান ঘটে তাঁরই ধর্মান্তরিত পুত্রের দ্বারা। সুলতান জালালুদ্দিন ছিলেন নানা গুণের অধিকারী তথা বাংলা সালতানাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান।
রাজা গণেশ নি:স্বন্দেহে মধ্যযুগের ব্যাতিক্রমী এক চরিত্র। সুপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য যিনি রাজক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।এটাকেই তাঁর কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।ভাগ্যের পরিহাসে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম আবার মুসলিম ধারায় ফিরে গিয়েছিলো। রাজনীতি, কূটনীতিতে তিনি অত্যান্ত দক্ষ ছিলেন। পাশাপাশি ছলনা ও ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেছিলেন। অনেকের মতে, তিনি কেবল মুসলমান সুফী-দরবেশদের প্রতিই কঠোর ছিলেন কিন্তু সাধারণ মুসলমান প্রজাদের প্রতি কোনো অত্যাচার করেন নি, যার জন্য মুসলমানদের মধ্যে নাকি তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিলো। তাই বলা চলে যে, মধ্যযুগে বাংলার সুলতানী আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেব।