১৯২২ সাল। বর্তমান ইরাক, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর। জায়গাটি খনন করতে এসেছেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার চার্লস লিওনার্ড উলি। সঙ্গে এসেছেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন উলি। ক্যাথরিন নিজেও একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। ১৮৫৩ সালের দিকেও একবার এই জায়গায় খননকাজ চালানো হয়েছিলো, আরেকজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ জন জর্জ টেইলরের নেতৃত্বে। তবে সেই খননের উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। আসলে কৌতুহলী লিওনার্ড উলি এবং ক্যাথরিন উলি প্রাচ্যে এসেছেন বিবলিকাল যোগসূত্রের খোঁজে। বাইবেলের উৎস খুঁজে বের করাই ছিলো তাদের মূল লক্ষ্য।
শুরু হলো খনন। খুঁড়তে খুঁড়তে এক পর্যায়ে উলি দম্পতির সামনে উন্মোচিত হলো এক বিস্ময়। না, কোনো বিবলিকাল যোগসূত্র ছিলো না সেটি। বরং উরের সেই জায়গাটি ছিলো সুমেরীয় রাজবংশীয়দের সমাধিস্থল।
সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলো একটি রাজকীয় সমাধি। সমাধির ভেতর একটি সিলিন্ডারে সুমেরীয় ভাষায় খোদাই করা ছিলো একটি নাম, রাণী পুয়াবী।
রাণী পুয়াবীর সমাধিটি লুটেরাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি, যার প্রমাণ সমাধির ভেতর থাকা অফুরন্ত সম্পদ। রাণী পুয়াবীর মাথা ও চুলের সজ্জাটি ছিলো সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর, চমৎকার ডিজাইনের গড়া স্বর্ণের অলংকারে পূর্ণ। সোনার রিবন দিয়ে তার সম্পূর্ণ চুল মোড়ানো ছিলো। মাথার ওপর ছিলো সোনার অনেকগুলো পাতা ও লাপিস লাজুলি দিয়ে তৈরী মুকুট এবং তারাফুলের নকশা ও সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত সোনার চিরুনী। কানে মোটা দুই রিং বিশিষ্ট দুল, হাতের দশ আঙ্গুলে দশটি সোনার আংটি, গলায় সোনার পেনডেন্ট এবং লাপিস লাজুলি ও দামী পাথরে তৈরী চমৎকার নেকলেস ও কন্ঠহার, মূল্যবান বিডসে তৈরী কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত বিন্যস্ত গাত্রাবরণ বা ক্লোক পরিহিতা রাণী যেনো কবরে শায়িত থেকেই জানান দিচ্ছেন তার শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে।
তার সমাধিতে থাকা নকশাযুক্ত বাদ্যযন্ত্র হার্প, টেবিলে রাখা রূপার প্রসাধন বাক্স যার ওপর আঁকা আছে শিকারী সিংহের শিকারের চিত্রপট, সূক্ষ্ম নকশাযুক্ত অসংখ্য সোনা ও রূপার পাত্র -সমস্তই জানান দিচ্ছে রাণীর প্রজাদের শিল্প ও সংস্কৃতিগত দক্ষতাকে।রাণী পুয়াবীর সমাধি থেকে পাওয়া এতো এতো মূল্যবান সম্পদ হতবাক করে দেয় খননকারীদেরকে। লিওনার্ড উলি অত্যন্ত যত্নসহকারে ক্ষতিবিহীনভাবে পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাই চোখের সামনে এই আশ্চর্য নিদর্শন পেয়ে দেরী না করে কাজে নেমে পড়লেন তিনি। খুবই সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করলেন সমস্ত সম্পদ।
আসলে রাণী পুয়াবীর এই সমাধি আবিষ্কার প্রাচ্যের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে প্রাচ্যের সমৃদ্ধি এবং অবসান ঘটায় প্রাচ্য নিয়ে পাশ্চাত্যের সকল ভুল ধারণার। মেসোপটেমিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিলো না। সুতরাং রাণী পুয়াবীর অলঙ্কারগুলো মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যিক দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। অ্যান্টিক নীলাভ লাপিস লাজুলিগুলো নিঃসন্দেহে আফগানিস্তান থেকেই আনানো হয়েছিলো এবং কার্নেলিয়ান ও অ্যাগেট পাথরগুলো আনা হয়েছিলো ইরান থেকে। অতএব প্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাস ও সমৃদ্ধি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলো উরে পাওয়া রাণী পুয়াবীর সমাধি। আমাদেরকেও আমাদের প্রাচীন ইতিহাস উদ্ধারের বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। সামান্য সচেতনতা এবং ইচ্ছাশক্তিই একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনার জন্য যথেষ্ট।
রেফারেন্সঃ
The royal tombs of Ur revealed Mesopotamia’s golden splendor-National Geographic