খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী। বৃহৎ রোমান সাম্রাজ্য বেশ জোরেসোরে নিজেদের বাণিজ্য পরিচালনা করছে। বাণিজ্যের সুবাদে বহু দূর-দূরান্তেও পাড়ি দিতে হচ্ছে তাদেরকে। লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বহু দূরের ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রারত একটি জাহাজে নিজের ডায়েরিতে কিছু একটা লিখে চলেছেন একজন বণিক। খুব বেশি পড়ালেখা না জানলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাণিজ্যিক নির্দেশিকা লিখে রাখার মতো অক্ষরজ্ঞান তার রয়েছে। জাতিতে তিনি একজন গ্রীক। তবে তার বসবাস রোমান নিয়ন্ত্রণাধীন মিশরে। রোম থেকে এতো দূরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য পরিচালনা সত্যিই ভীষণ দুষ্কর কাজ। তাই এই গ্রীক বণিক সুবিধাজনক বাণিজ্য রুটগুলো লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন, যেনো পরবর্তীতে তা বণিক ও নাবিকদের দুর্গম যাত্রাকে সহজতর করে তুলতে সহায়তা করতে পারে। নাম-পরিচয়হীন স্বল্প শিক্ষিত গ্রীক বণিকের লেখা এই ডায়েরি বা দিনলিপিটিই পরিণত হয়েছিলো ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য নির্দেশিকা গাইডে, যার নাম ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’।
ধারণা করা হয়, ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ বইটি ৪০ থেকে ৫৫ সালের মধ্যে কোনো এক সময় লেখা হয়েছে। তখন মিশর ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত। রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হচ্ছিলো। আর এই শক্তির মূল ভিত্তি ছিলো বৈদেশিক বাণিজ্য।
‘পেরিপ্লাস’ বলতে সাধারণত বোঝায় একজন নাবিক বা বণিকের লগ-বই, যেখানে তিনি তার যাত্রাপথের সমস্ত রেকর্ড লিপিবদ্ধ করেন। আর ‘এরিথ্রিয়ান সী’ মূলত আফ্রিকার শৃঙ্গ থেকে শুরু করে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের সম্পূর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল। সম্ভবত এই সমগ্র অঞ্চলটিকে তখন ‘এরিথ্রিয়ান সাগর’ নামেই অভিহিত করা হতো।
এই ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ থেকেই আমরা জানতে পেরেছি যে, প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে মৌসুমী বায়ুর গতিপথ আবিষ্কার করেছিলেন হিপ্পোলাস। এই বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটি আমাদেরকে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ভারতবর্ষের বাণিজ্যের বহুমাত্রিক সংযুক্ততার বর্ণনা দিয়েছে। সেই সাথে বইটিতে স্পষ্টভাবে বাণিজ্য পথের দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বাণিজ্য পোর্টকে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে মিশর হয়ে রোমানরা বারিগাযা এবং মুজিরিস পর্যন্ত দুটি সরাসরি বাণিজ্য পথ ব্যবহার করতো। এ ছাড়াও কোন অঞ্চলে কি ধরনের মানুষ বাস করতো, কি ধরনের পণ্যের বাণিজ্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো, কোন কোন পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হতো -এ সমস্ত মহামূল্যবান তথ্যাদি আমরা এই অজ্ঞাত লেখকের ডায়েরিটি থেকে জানতে পেরেছি, যা সত্যিই ভীষণ চমকপ্রদ ব্যাপার।
বাণিজ্য পথের দূরত্বের একটা পরিমাপও আমরা জেনেছি বইটি থেকে। প্রধান বাণিজ্য বন্দরগুলোর অবস্থান এবং সেখানে পৌঁছানোর সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়ও বর্ণিত আছে এতে। ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ এর ম্যাপ থেকে প্রথম যেই বাণিজ্য বন্দরটিকে নির্দেশ করা যায়, তা হলো সিথিয়ান শাসিত বারবারিকাম বন্দর।
বইটি বিশ্লেষণে তিনটি প্রধান ক্যাটাগরি পরিলক্ষিত হয়, যার প্রথম অংশে বর্ণিত আছে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলীয় বাণিজ্য সম্পর্কিত তথ্য, যা রোমান সাম্রাজ্যের মূল ভূখণ্ড বা মিশর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সুতরাং সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের বর্ণনা। দ্বিতীয় অংশটিতে বলা হয়েছে মিশর থেকে সুদূর ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলীয় বাণিজ্য সম্পর্কে। তৃতীয় অংশটি আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের জন্য, কেননা এখানে রোমান বাণিজ্য পূর্ব উপকূল অর্থাৎ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত প্রসারিত হবার কথা বলা হয়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, কোন অঞ্চলে কার শাসন চলছে তা সম্পর্কে অবগত থাকা, যেনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট পণ্যের নিয়ন্ত্রণ এবং ট্যাক্স কার হাতে আছে তা বোঝা যায়। এই বিশদ তথ্যগুলোও ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’-তে উল্লেখ করা হয়েছে। শাসকদের উল্লেখই বইটি রচনার সময় বুঝতে আমাদেরকে সাহায্য করেছে।
এবার আসা যাক পণ্যের বিবরণে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে উৎপন্ন হতে না পারা ভারতীয় পণ্যগুলো রোমানদের কাছে ছিলো ভীষণ আকর্ষণীয়। মূলত এ কারণেই এতো দূরবর্তী বৈদেশিক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলো রোমানরা। ভারতীয় মশলা, সুতি বস্ত্র, ওষধি গাছ, হাতির দাঁতের অলংকার, মুক্তা, জেমস্টোন বা রত্ন ইত্যাদি ছিলো রোমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমদানি পণ্য। বইটিতে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সুদূর ‘ক্রাইস’ নামের একটি জায়গার উল্লেখ আছে, যেখান থেকে কচ্ছপের খোলস আমদানি করতো রোমানরা।
লগ বইটিতে আরো একটি দূরবর্তী স্থানের উল্লেখ রয়েছে, যার নাম লেখক ‘থিস’ বলে অভিহিত করেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, এই স্থানে সবচেয়ে উন্নত মানের সিল্ক বা রেশম পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, জায়গাটি এতো দূরে অবস্থিত এবং এতো দুর্গম পথ-পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে যেতে হয় যে, সেখান থেকে সরাসরি সিল্ক আনা সম্ভব নয়। দূরবর্তী সেই অঞ্চলটি থেকে পায়ে হাঁটা পথে সিল্ক আসতো ভারতবর্ষের বাণিজ্য বন্দরগুলোতে এবং রোমানরা সেখান থেকেই সিল্কগুলো সংগ্রহ করতো।
‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ প্রথম শতাব্দীর অজ্ঞাতনামা এক গ্রীক বণিকের কাছে নেহায়েতই একটি লগ বই হলেও এটি প্রাচীন বিশ্বের আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ভাবতেও অবাক লাগে, মিশরবাসী এই গ্রীক বণিক নিজেই বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কিভাবে এতো সুনিপুণভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বাণিজ্যিক নির্দেশিকা সম্বলিত এতো সমৃদ্ধ নির্দেশিকা প্রাচীন ইতিহাসে বিরল।
রেফারেন্স: