রোমান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম অধিপতি রোমুলাসের তিরোধানের পর (রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-১ দেখুন) রোমের বৃক্ষরাজির ঝরেছে অনেক পাতা, নদী টিবেরে (Tiber) গড়িয়েছে অনেক জল, শহরটির হয়েছে অনেক পরিবর্তন। রোমানরা তখনো শোকার্থ। খুঁজছে রোমের জন্য নতুন রাজা। পুরোনো রোমান লোক-সাহিত্য, যেমন ঐতিহাসিক লিভিয় (Livy) এবং প্লাটার্চ (Plutarch) লিখিত গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, রোম খ্রীষ্টপূর্ব ৭৫৩ থেকে ৫০৯ সাল পর্যন্ত ছিল পর্যায়ক্রমে সাতজন রাজার নিয়ন্ত্রণে। প্রাচীন রোমান চিন্তাবিদ মার্কাস ভাররোর (Marcus Varro) মতে, ঐ ২৪৪ বৎসরে সাত রাজার প্রত্যেকে রোম শাসন করেছে গড়ে ৩৫ বছর করে। রোমুলাস ছিলেন সাত রাজার মধ্যে প্রথম রাজা, যিনি ঐ রাষ্ট্র শাসন করেন খ্রীষ্টপূর্ব ৭৫৩ থেকে ৭১৫ সাল। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, রোমুলাসের গড়া রোম-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রটি ছিল প্রথম রোমান রাজতন্ত্র। অন্যদের ধারণা, রোমুলাসের রাষ্ট্রে ছিল আংশিক রাজতন্ত্র।
রোমুলাসের অন্তর্ধানের পর অন্তর্বর্তীকালে রোমের সিনেট থেকে নির্বাচিত দশ জন রোম শাসন করেছিল রাজার অবর্তমানে। তখন ছিল না কোন রাজা। পরবর্তীতে রোমের সিনেট (রাষ্ট্রের প্রশাসন) নুমা পম্পিলিয়াসকে (Numa Pompilius), যিনি ছিলেন একজন সাবাইন (Sabine), নির্বাচন করে। রোমের দ্বিতীয় রাজা নুমার ন্যায়বিচার এবং ধার্মিকতার জন্য তাকে রোম শাসনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। নুমার রাজত্ব ছিল শান্তি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। রাজা নুমা প্রথমে রোমানদের দু’ মুখ বিশিষ্ট দেবতা জানুসের (Janus) জন্য একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে রোমের প্রতিবেশীদের সাথে সন্ধি স্থাপনের পরে, এলাকায় শান্তি স্থিতিশীল বজায় রাখার জন্য তিনি জানুস মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেন। তার লক্ষ্য ছিল, বিশেষ দেবতার প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাতিত্বের জন্য যেন তার রাজ্যে শান্তি বিঘ্নিত না হয়, এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলোও যেন ক্ষুন্ন না হয় তার উপর। নুমার রাজত্বকাল ছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৭১৫ থেকে ৬৭২ সাল।
নুমার মৃত্যুর পর খ্রীষ্টপূর্ব ৬৭২ সালে রোমের তৃতীয় রাজা হয় টুলুস হোস্টিলিয়াস (Tullus Hostilius)। টুলুস ছিল নুমার সম্পূর্ণ বিপরীত। তার যুদ্ধের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রোমকে জড়িয়ে ফেলে আলবা লঙ্গা (Alba Longa), ফিদেনা (Fidenae), ভেইই (Veii) এবং সাবিনদের (Sabines) বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে। টুলুস রোমানদের কাছে স্মরণীয় হয়েছিল বেশ সময়কাল। সে রোমের প্রশাসন সিনেটের জন্য কুরিয়া হোস্টিলিয়া (Curia Hostilia) নামের একটি বিশাল কার্য্যালয় নির্মাণ করেছিল, যা’ তার মৃত্যুর পরেও ৫৬২ বছর টিকে ছিল। রোমানদের ধারণা, দেবতাদের প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাবই টুলুসকে করে ফেলেছিলো বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর।
টুলুসের আক্রমণে আলবা লঙ্গা শহরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। রোমান ইতিহাসবিদ লিভিয়র মতে, টুলুস দেবতাদের প্রতি অবহেলা করার জন্যই তার রাজত্বের শেষ দিকে সে হয়ে পড়ে অসুস্থ। টুলুস হয়ে পড়ে সাংঘাতিকভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন। রোমান লোক-শ্রুতি থেকে জানা যায়, রাজা টুলুস যখন দেবতা জুপিটারকে (গ্রহ বৃহস্পতি) স্মরণ করলো এবং সাহায্যের জন্য অনুরোধ করলো, তখন জুপিটার এক বিকট বজ্রপাতের মাধ্যমে তাকে এবং তার বাড়িকে পুড়ে ছাই করে ফেলে। টুলুসের শাসনকালের অবসান ঘটে খ্রীষ্টপূর্ব ৬৪০ সনে।
টুলুসের মৃত্যুর পর, রোমানরা তার স্থানে একজন শান্তিপূর্ণ ধার্মিক রাজা নির্বাচিত করে। খ্রীষ্টপূর্ব ৬৪০ সালে রোমের চতুর্থ রাজা নিযুক্ত হয় দ্বিতীয় রাজা প্রয়াত নুমার নাতী, অ্যানকাস মার্সিয়াস (Ancus Marcius)। পিতামহের মতোই, অ্যানকাস রোমের সীমানা প্রসারিত করতে আগ্রহী ছিলেন না একেবারেই। রাজা অ্যানকাস শুধুমাত্র তখনই যুদ্ধ করেছিলেন যখন রোমকে বহিরাক্রম থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অ্যানকাসের শাসনকাল ছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৬১৬ সাল পর্যন্ত।
আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৬৫০ সালের পর, ইট্রুস্ক্যানরা (Etruscan) ধীরে ধীরে ইতালীতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। উত্তর-মধ্য ইতালীতে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমেই। ইট্রুস্ক্যানরা ছিল ইতালীর একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠি। তাদের আবাসস্থল ছিল আপেইনিনেস (Appennines) পর্বতমালা ও টিবের এবং আর্নো (Arno) নদীর মাঝামাঝি এক জনপদে। যাদের নগর সভ্যতা খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে অনেক প্রসারিত হয়েছিল। রোমান সমাজে ইট্রুস্ক্যান সংস্কৃতির প্রভাব ছিল প্রবল।
রোমুলাস-প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের শেষ তিন রাজাই ছিলেন ইট্রুস্ক্যান জাতিগোষ্ঠীর। এরা হলেন লুসিয়াস তারকুইনিয়াস প্রিসকাস (Lucius Tarquinius Priscus), সার্ভিয়াস টুলিয়াস (Servius Tullius), এবং তারকুইনিয়াস সুপারবাস (Tarquinius Superbus)। মজার ব্যাপার হলো, নিজেরা ইট্রুস্ক্যান হয়েও ইট্রুস্ক্যান রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
রোমের চতুর্থ রাজা অ্যানকাস মার্সিয়াসের পর লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস ছিলেন রোমের পঞ্চম রাজা। প্রিসকাসের মা ছিলেন ইট্রুস্ক্যান, এবং পিতা ছিলেন এক গ্রীক শরণার্থী। রোমে অভিবাসনের পর, অ্যানকাসের অনুগ্রহ লাভ করেন প্রিসকাস। অ্যানকাস পরে প্রিসকাসকে তার পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন।
রোমের শাসনভার গ্রহণের পর, প্রিসকাস সাবিনস (Sabines) এবং ইট্রুস্ক্যানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং জয় করেন এলাকা দু’টো। কিছুদিনের মধ্যেই প্রিসকাস রোমের আকার দ্বিগুণ করে ফেলেন এবং রোমে নিয়ে আসেন প্রচুর ধনসম্পদ। তার শাসনের প্রথম সংস্কারের মধ্যে একটি ছিল বিজিত ইট্রুস্ক্যান উপজাতি থেকে ১০০ জন নতুন সদস্যকে রোমের সিনেটে নিয়োগ দেয়া। যার ফলে সিনেটরের মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ জনে। তিনি সামরিক বিজয় থেকে অর্জিত ধন-সম্পদ দিয়ে রোমে নির্মাণ করেন অনেক স্মৃতিস্তম্ভ। সব নির্মাণের মধ্যে অন্যতম ছিল, রোমান ফোরাম, ক্যাপিটোলিন পাহাড়ে জুপিটারের মন্দির এবং সার্কাস ম্যাক্সিমাস। তার শাসনামলে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল রোমে বেসামরিক শাসন এবং কর্তৃত্বের প্রবর্তন। পিসকাস রোম শাসন করে খ্রীষ্টপূর্ব ৬১৬ থেকে ৫৭৮ সাল পর্যন্ত।
পিসকাসের মৃত্যুর পর, খ্রীষ্টপূর্ব ৫৭৮ সালে তার জামাতা সার্ভিয়াস টুলিয়াস হন রোমের ষষ্ঠ রাজা। পিসকাসের মতো, সার্ভিয়াসও ইট্রুস্ক্যানদের বিরুদ্ধে সফল যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করেন রোমের প্রথম পোমেরিয়াম (Pomerium), যে নগর-দেয়াল পুরোপুরি রোমের সাত-পাহাড়কে ঘিরে ফেলে। সার্ভিয়াস রোমানদের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। রোমের জনস্বার্থে সার্ভিয়াসের সংস্কারগুলো রোমান জীবযাত্রায় বড় রকমের পরিবর্তন এনেছিল। তবে ভোটের অধিকার প্রদান করা হতো নাগরিকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। সার্ভিয়াস রোমান অভিজাত সম্প্রদায়কে পৃষ্ঠপোষক করতেন অনেকভাবেই। তাদেরকে সমাজের অনেক ক্ষমতা প্রদান করেন অকাতরে। সার্ভিয়াসের ৪৪ বছরের রাজত্বের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩৪ সালে, যখন তিনি তার নিজের কন্যা, টুলিয়া এবং তার স্বামী, লুসিয়াস তারকুনিয়াস সুপারবাসের নেতৃত্বে একটি ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারান।
প্রিসকাসের মৃত্যুর পর খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩৪ সালে রোমুলাস-প্রতিষ্ঠিত রোমান রাজতন্ত্রের সপ্তম এবং শেষ রাজা হন তারই জামাতা লুসিয়াস তারকুইনিয়াস সুপারবাস (Lucius Tarquinius Superbus)। ক্ষমতায় থাকাকালীন, তারকুইনিয়াস রোমের প্রতিবেশী রাজ্য, যেমন ভলস্কি, গাবিই এবং রুটুলির (Volsci, Gabii, Rutuli) বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেন। টারকুইনিয়াস জনসাধারণের স্বার্থে অনেক কিছুই করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল, ক্যাপিটোলিন পাহাড়ে জুপিটার অপটিমাস ম্যাক্সিমাসের মন্দিরের নির্মাণ সমাপ্তি। তবে রোমকে শক্তিশালী করতে তারকুইনিয়াসের কঠোরতা এবং সহিংসতা ছিল প্রতিবেশীদের জন্য ভীতিকর। সেইসাথে রোমান চিরাচরিত প্রথা এবং রোমের প্রশাসন সিনেটকে তারকুইনিয়াসের অবজ্ঞা ও অসম্মান ছিল অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। উত্তেজনা চরমে ওঠে যখন তার পুত্র সেক্সটাস টারকুইনিয়াস রোমান এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী লুক্রেটিয়াকে লাঞ্ছিত করে। লুক্রেটিয়া তার আত্মীয়দের কাছে তাকে সেক্সটাসের লাঞ্ছনার কথা জানিয়ে দেয়। পরবর্তীতে সমাজে তার প্রতি অসম্মান থেকে বাঁচতে লুক্রেটিয়া একদিন আত্মহত্যা করে। তারকুনিয়াস অতি দ্রুতই তার জনপ্রিয়তা হারান।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫০৯ সালে লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসের (Lucius Junius Brutus) নেতৃত্বে একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রোমের সপ্তম রাজা তারকুনিউস ক্ষমতা হারায়। বিপ্লবীরা রোম থেকে তাকে এবং তার পরিবারকে বিতাড়িত করে। লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসের এবং লুসিয়াস ট্র্যাকুইনিয়াস কোলাটিনাস (Lucius Tarquinius Collatinus) রোমের প্রথম কনসাল নিযুক্ত হন। তারাই রোমে রোমুলাস-প্রতিষ্ঠিত ২৪৪ বছরের রোমান রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সূচনা করে রোমান প্রজাতন্ত্র। এই নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকারই জুলিয়াস সিজার এবং সিজার অগাস্টাসের উত্থানের আগ পর্যন্ত পরবর্তী ৫০০ বছর রোমকে শাসন করে। আরম্ভ হলো রোমানদের আরেক নাটকীয় অধ্যায়। দেখলাম রোমান রাজতন্ত্র, দেখবো রোমান প্রজাতন্ত্র, তারপর জানবো রোমান সাম্রাজ্য!
(চলবে)