রোমান রাজতন্ত্রের বিলুপ্তের পর (দেখুন রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-২) রোমান প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৫০৯ সালে (দেখুন রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-৩), এবং এর ব্যাপ্তি ছিল পরবর্তী ৪৫০ বছর। রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল অস্থিরতা এবং গৃহযুদ্ধ, যা’ স্বৈরশাসনের জন্য সৃষ্টি করেছিল উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ। ঐ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রান পেতে, নির্বাচনের মাধ্যমেই রোমান প্রজাতন্ত্র শাসনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় স্বৈরশাসক কর্নেলিয়াস সুল্লাকে। তিনি রোমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ৮২ থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত। অল্প সময়ের জন্য রোমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেও, খ্রীষ্টপূর্ব ৭৯ সালে সুল্লা পদত্যাগ করলে প্রজাতন্ত্রে দেখা দেয় আবারো অস্থিরতা। রোমের রাজনীতির মঞ্চে আগমন ঘটলো জুলিয়াস সিজার (Caesar), গনিয়াস পম্পিয়াস ম্যাগনাস (Pompeius) এবং মার্কাস লিসিনিয়াস ক্র্যাসসুসের (Crassus) মতো অভিজ্ঞ রাজনীতির খেলোয়াড়দের। ঐ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাবার জন্য রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষের দিকে এই তিনজন গড়ে তোলে “প্রথম ট্রাইউমভাইরেট” (First Triumvirate) নামের এক অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক জোট।
খ্রীষ্টপূর্ব ৬০-এর আগের বছরগুলোতে রোমান রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মসূচী সিনেটে অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হওয়ায় পম্পিয়াস, ক্রাসাস এবং সিজার ঐ জোট গড়ে তোলে। সাংবিধানিক অনেক বাধা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষগুলোকে আইনে রূপান্তর করার জন্যই তারা গোপনে ঐ জোট গঠন করেছিল। অর্থাৎ, তাদের পারস্পারিক রাজনৈতিক স্বার্থগুলোকে সমর্থন করার জন্য তাদের নিজ নিজ প্রভাব ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল একে অপরকে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তাদের অনেক রাষ্ট্র-বিষয়ক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সিনেটের বিরোধিতা বন্ধ করতেই তাদের পারস্পরিক প্রয়োজনেই ঐ জোট গঠিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে জোটটি ছিল গোপন; কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব ৫৬ সালে সিজারের প্রথম কনসালশিপের সময় এই তিনজনের জোটটি প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়।
সিজারের কনসালসিপের এক বছরের মধ্যেই খ্রীষ্টপূর্ব ৫৫ সাল থেকেই জোটটি পম্পিয়াস এবং ক্রাসাসকে কনসাল হিসাবে নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। প্রজাতন্ত্রের সিনেট গল (Gaul) অঞ্চলে সিজারের নিয়ন্ত্রণ আরো পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করে, স্পেনের প্রাদেশিক কমান্ড নির্বাচিত করে পম্পিয়াসকে, এবং সিরিয়ার কতৃত্ব দেয় ক্রাসাসকে। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নগ্ন শক্তির ব্যবহার এবং রোমে আরও শক্তি প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে ক্রাসাস খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩ সালে পার্থিয়া আক্রমন করতে যেয়ে নিহত হন। ক্রাসাসের মৃত্যুর পর বাকী দু’ মিত্র, সিজার এবং পম্পিয়াস, আরো কয়েক বছর তাদের বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৫২ সালে পম্পিয়াস রোমের একমাত্র কনসালশিপ হবার পর এবং পম্পিয়াসের স্ত্রী জুলিয়ার (সিজারের কন্যা) মৃত্যুর পরেও তারা একে অপরের মিত্র ছিল অনেকদিনই। পম্পিয়াস অবশ্য ক্রাসাসের মৃত্যুর পর সিজারের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অন্য মিত্রদের সাথে গোপনে রাজনৌতিক জোট গঠন করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫১ সালে গ্যালিক (Galic) যুদ্ধে বিশাল এক সামরিক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সিজার রোমান প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। সিজারের ঐ বিজয় রোমান সাম্রাজ্যকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছিল। সিজারের গ্যালিক বিজয় পম্পিয়াসের রাজনৈতিক অবস্থানকেও করেছিল দূর্বল। গ্যালিক যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে, খ্রীষ্টপূর্ব ৫১ সালে রোমের কনসাল মার্সেলাস (Marcellus) সিজারকে সেনাবাহিনীর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করে রোমে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। সিনেটে সিজারের প্রতিপক্ষ কট্ররপন্থী ক্যাটো (Cato), সিসেরো (Cicero), বিবুলাস (Bibulus) এবং সমমনা নেতাদের নিয়ে সিজারের বিরুদ্ধে পম্পিয়াসকে দাঁড় করাতে সফল হয়। ধীরে ধীরে সিজারের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে যাবার সিন্ধান্ত নেয় সিজারের জামাতা পম্পিয়াস। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০ সালে সিজার এবং পম্পিয়াসের মধ্যে আস্থার চরম অবনতি হতে থাকে। পম্পিয়াসের উপর সিজার-বিরোধী কট্টরপন্থীদের প্রভাব পড়তে থাকে দ্রুতই।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫০ সনে রোমে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে যায়। সিজার এবং তার প্রতিপক্ষরা যথাক্রমে দক্ষিণ গল এবং উত্তর ইতালিতে সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। সিসেরো এবং অন্যান্যরা পম্পিয়াসকে দিয়ে সিজারকে নিরস্ত্র করার এক আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাশ করার চেষ্টা করে সিনেটে। কিন্তু একজন কনসাল সভাটি ভেঙে দিলে এটি আর সিনেটে পাস হয়নি। সে বছরই, রোমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সিজার ইতালির রোম আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়েছে। রোমান প্রজাতন্ত্রের উভয় কনসাল সিজারের জামাতা পম্পিয়াসকেই সিজারের আক্রমণ থেকে রোমকে রক্ষা করার নির্দেশ দেয়।
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯ সালে সিজার প্রকাশ্যে সিনেটের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন এবং তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে রোমের দিকে অগ্রসর হন। সিজারের এমন আগ্রাসী ভূমিকা অচিরেই রোমে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি করে। ঐ বছরের ৭ই জানুয়ারী সিনেট আনুষ্ঠানিকভাবে সিজারকে রোমান প্রজাতন্ত্রের শত্রু ঘোষণা করে। সিনেটের ঐ “চূড়ান্ত ডিক্রি”র প্রতিক্রিয়ায় সিজার তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ইতালির উত্তর সীমানা নির্ধারণকারী নদী রুবিকন অতিক্রম করেন। সিজারের আক্রমণে ভয় পেয়ে পম্পিয়াস এবং কট্ররপন্থী অনেক সিনেটর রোমের দক্ষিণে পালিয়ে যায়। সিজার রোমের প্রধান যোগাযোগ পথগুলো অবরোধ করে ফেলেন। পম্পিয়াসকে বন্দী করার জন্য সিজার আরো দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকেন। সিজারের তাড়া খেয়ে পম্পেসিয়াস মিশরে; অন্যদিকে, কট্ররপন্থী ক্যাটো আফ্রিকায় পালিয়ে যায়। অন্যরা, যেমন সিসেরো এবং মার্কাস সিজারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ধারণা করা হয়, পম্পেসিয়াস মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছালে খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে সিজারের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।
সিজার গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে রোমান প্রজাতন্ত্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দী এক রাজনৈতিক শক্তি হয়ে আবির্ভুত হন। রোমান প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর, সিজার প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন সামাজিক ও সরকারী সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তিনি রোমান প্রজাতন্ত্রের দূরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব দেন। তিনি প্রবীণদের জন্য ভূমি এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান শুরু করেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের আমলাতন্ত্রকে কেন্দ্রীভূত করে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। অবশেষে খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬ সালে সিজার নিজেকে রোমান প্রজাতন্ত্রের “চিরস্থায়ী একনায়ক” (dictator perpetuo) ঘোষণা করেন। তার জনপ্রিয়তা এবং কর্তৃত্ববাদী সংস্কার ও শাসন প্রজাতন্ত্রের অভিজাত সম্প্রদায়কে করেছিল সাংঘাতিকভাবে ক্ষুব্ধ। তারা গোপনে সিজারের বিরুদ্ধে আরম্ভ করে ষড়যন্ত্র। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ই মার্চ ইডেসে এক অধিবেশনে, ব্রুটাস (Marcus Brutus) এবং ক্যাসিয়াসের (Gaius Cassius) নেতৃত্বে একদল বিদ্রোহী ৫৫ বছরের সিজারকে প্রকাশ্যে ২৩ বার ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
সিজারের হত্যাকান্ড প্রজাতন্ত্রের গৃহযুদ্ধকে করে আরো জটিল এবং দীর্ঘ। প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক সরকার রোমে আর কখনই পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয় নি। সিজারের ভাতিজা এবং দত্তক উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়ান (Octavian), পরবর্তীতে অগাস্টাস (Augustus) নামে পরিচিত, রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষ গৃহযুদ্ধে তার বিরোধীদের পরাজিত করে একক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অক্টাভিয়ানের জয়ের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের যুগ।
সিজার ছিলেন একাধারে একজন লেখক, ইতিহাসবিদ এবং সেই সাথে একজন দক্ষ সেনা ও রাষ্ট্রনায়ক। সিজারের রাজনৈতিক উত্থান, সামরিক অভিযান সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানা যায় তার সমসাময়িক সিসেরোর (Cicero) বর্ণিত চিঠি, বক্তৃতা, এবং স্যালুস্টের (Sallust) ঐতিহাসিক লেখা থেকে। পরবর্তীতে, সুয়েটোনিয়াস (Suetonius) এবং প্লুটার্কের (Plutarch) বিবরণ থেকে জানা যায় সিজারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অনেক ইতিহাসবিদ সিজারকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক নেতা হিসেবেও বিবেচনা করেন। অনেক ইতিহাসে সিজারের নামটি “সম্রাট” এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। “সিজার” উপাধিটি পরবর্তীকালে কায়সার (Kaiser) এবং জার (Tsar) রাজবংশের জন্ম দেয়।
(চলবে)
রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-১
রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-২
রোমান সাম্রাজ্য: পর্ব-৩