সত্যজিৎ রায় সস্ত্রীক বিলেতে যাবেন, তার আগে দিলীপ গুপ্ত তাঁকে সদ্য লেখা ছোটদের সংস্করন ‘ পথের পাঁচালী’ পড়তে দিয়েছিলেন। যখন শুনলেন সত্যজিৎ বইটি পড়েননি তিনি খুব রাগ করে বললেন, বইটা ভালো করে পড়ে দেখো, আমাদের গ্রাম বাংলার সব কিছু জানতে পারবে। সত্যজিৎ তার এই কথায় লজ্জা পেলেন, তবে পড়ে মুগ্ধ হলেন। তখন থেকেই তাঁর মনের মধ্যে এটা নিয়ে ছবি করার ইচ্ছাটা গোপনে দানা বাঁধলো।
বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি বংশীর সাথে ছবিটির ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করলেন, কারন তাঁর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র বংশীই চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন, ছোটখাটো অভিনয়ের পাশাশাশি তিনি শিল্প নির্দেশক হিসাবেও কাজ করেছেন এবং চলচ্চিত্র সম্বন্ধেও প্রচুর লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫০ সালে বিভূতিভূষন মারা যাওয়ায় তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আশা ছিলো ‘ পথের পাঁচালী’ নিয়ে তাঁর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবেন! বংশী রোজ আসে আর ‘পথের পাঁচালী’র স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা চলে। একদিন বন্ধু বংশী আর সুব্রতর সাথে গ্রামও দেখে আসলেন।
এরপর চললো অপু আর দূর্গার খোঁজ…তিনি হাজার হাজার বাচ্চার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, কিন্তু অপু আর মিলে না। ঠিক তখনই বিজয়া রায় হঠাৎ করেই পাশের বাড়িতে অপুকে পেয়ে গেলেন। দুই ভাই বাইরে খেলছিলো, তার মধ্যে পাঁচ/ ছয় বছরের ছেলেটির নাম সুবীর, দেখতে ভারি সুন্দর। তার চোখ-নাক, ঠোঁট দেখে তার মনে হলো, এর চেয়ে ভালো অপু আর হতেই পারে না। তিনি তাদেরকে ডেকে সন্ধ্যায় একবার এই বাড়িতে আসতে বললেন। সন্ধ্যেবেলায় সত্যজিৎ রায় বাড়িতে ফিরতেই তিনি হাসিমুখে বললেন, অপুকে পাওয়া গেছে। অপুকে (সুবীর) দেখার সাথে সাথেই সত্যজিৎ রায় তাকে পছন্দ করে ফেললেন। অপুকে বললেন, অভিনয় করতে আপত্তি নাই তো? ছেলেটি মাথা নেড়ে বললো, না। আমি যেরকম দেখিয়ে দিবো, সেইরকম করবে।পারবে তো? ছেলেটি আবার মাথা নেড়ে বললো, হ্যাঁ। এই হ্যাঁ আর না এর বাইরে আর একটি কথাও সে বললো না, ভারি লাজুক ছেলে ! তিনি বললেন ঠিক আছে, তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবো, তারা রাজি হলে খুব শিগগির কাজে হাত দিবো। তিনি স্ত্রীকে জানালেন, এরচেয়ে ভালো অপু আর হতেই পারে না! অপুকে পাওয়ার পর চললো দূর্গার খোঁজ, তাকে খুঁজে বের করলেন তাঁর আ্যাসিসট্যান্ট এবং লেখক আশিস বর্মন। তিনি একটা কাজে বেলতলা হাইস্কুলে এক শিক্ষিকার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সেখানে উমা দাসগুপ্তকে তার খুব পছন্দ হয়। তিনি তক্ষুনি তার নাম- ধাম, ঠিকানা নিয়ে সত্যজিৎকে জানালেন। সত্যজিৎও সময় নষ্ট না করে উমার বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর বাড়িতে আসতে বললেন।
এগারো- বারো বছরের উমা, গলায় মুক্তার মালা পরে বেশ সেজেগুজেই এলো। তখন তাকে দূর্গা হিসাবে ভাবাই যাচ্ছিলো না। সত্যজিৎ রায় স্ত্রীকে বললেন, তাকে গাছকোমর শাড়ি পরিয়ে টেনে চুল বঁধে দিতে। মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ আর চটপটে। সেই রকম সাজে যখন উমাকে তাঁর সামনে আনা হলো, দূর্গাকে দেখে তিনি হাত তালি দিয়ে বললেন, এইতো দূর্গা! সত্যিই তাই… শ্যামলা রং, মুখের মধ্যে এমন একটা ছাপ দেখেই মনে হলো, সে সত্যিই একটা গ্রামের মেয়ে যার শহরের সাথে কোন সম্পর্কই নাই!
সর্বজয়ার চরিত্রে নেয়া হলো তাঁর বন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুনাকে, উচ্চশিক্ষিত এবং পুরোপুরি শহরের মেয়ে। তিনি খুব সহজেই নিজেকে সর্বজয়ার চরিত্রের মতো নিজেকে তৈরি করলেন। বুড়ি পিসি ইন্দিরা ঠাকুরনের ভূমিকায় অভিনয় করেন চুনিবালা দেবি। হরিহরের ভূমিকায় ছিলেন একজন প্রফেশনাল অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোট রোলের মধ্যে রেবা দেবী ও অপর্না দেবী অভিনয় করেন। বাকি সব চরিত্রে তিনি গ্রামের লোকদের দিয়েই অভিনয় করিয়ে নেন। প্রথমে নিজেদের পুঁজি নিয়ে ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং শুরু হয়। সে কথায় পরে আসছি…।
সত্যজিৎ রায় তার ইউনিটে যাদের নেবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তাদের সবাইকে পাওয়া যায়নি। বংশী প্রথম থেকেই শিল্প নির্দেশক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। সুব্রত ছিলেন স্টিল ফটোগ্রাফার কিন্তু ‘রিভার’ ছবির শ্যুটিং দেখে কিছুটা ধারনা করেছিলেন, তাই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ক্যামেরাম্যান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। এটা সম্ভব হয়েছিলো শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারনে। পরে তাকে মার্চেন্ট আইভরি ডেকে নিয়ে যান। সত্যজিৎ রায় তাকে বাধা দেননি, প্রথমতঃ ইংরেজি ছবিতে টাকার অঙ্কটা বেশি আর পৃথিবীশুদ্ধ মানুষ তার ছবি দেখতে পাবেন। এরপর এলো নতুন ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায়, তিনি প্রথমে ছিলেন ক্যামেরা কেয়ার টেকার। তিনিই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে ক্যামেরাম্যানের সুযোগ করে দেন, পরে সে ও নামকরা ক্যামেরাম্যান হয়।
এরপর সত্যজিৎ রায়কে প্রযোজকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতে হতো। কত ঠাট্টা- তামাশা, নাচ নেই, গান নেই, প্রেমিক প্রেমিকা নেই, এই ছবি কিভাবে চলবে? এক প্রোডিউসারের চিত্রনাট্য পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু তখন তার একটা ছবি সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছে। বললেন, ছবি হিট হলে তিনি এটি করার কথা ভাববেন, কিন্তু ছবি ফ্লপ করায় তিনি সরে দাঁড়ালেন। তার সঙ্গে আরেক ভদ্রলোক ছিলেন নাম অনিল চৌধুরী, তিনি চিত্রনাট্যটি খুব পছন্দ করলেন, তারপর থেকে তিনি আমৃত্যু সত্যজিৎ রায়ের সাথে ছিলেন। অনেক চেষ্টার পরও যখন কোন প্রযোজক পাওয়া গেল না, তখন তিনি ঠিক করলেন, প্রথম দিকের কিছু শ্যুটিং তিনি নিজের পয়সায় করে সেটা প্রযোজকদের দেখিয়ে টাকা উঠাবেন। যেহেতু তাঁর নিজের টাকা ছিলো না, তাই তিনি নিজের জীবনবীমার টাকা, দামী আর্ট বুক বিক্রি করার টাকা, বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছেও কিছু টাকা ধার করে ছবির কাজ শুরু করলেন। এইটুকু শ্যুটিং করতে করতেই টাকা শেষ, বিজয়া গয়নার বাক্স বন্ধক দিলেন, তাতে আরো দু’ একদিনের শ্যুটিং চলবে।
প্রথমদিন অপু দূর্গাকে নিয়ে কাশবনে শ্যুটিং শুরু করলেন, শ্যুটিংয়ের সময় দেখা গেলো অপু কাঠের পুতুলের মতো হাঁটছে। তিনি ক্যামেরার পেছন থেকে চিৎকার করে বলছেন কি করতে হবে। কাশবনের বিভিন্ন জায়গায় তিনি তিনজনকে বসিয়ে দিলেন। তারা সুবীর (অপু)বলে ডাকলেই সে সেদিকে ফিরে তাকাতে লাগলো। তিনি চিৎকার করে বললেন, “ সুবীর বাঁ পাটা তুলে একটু চুলকে নাও”। সুবীর তাই করে, দেখে মনে হয় অপু তার দিদিকে খুঁজছে।
টাকা শেষ, এই সময় অনিল বাবু যখন তিন মাসের জন্য উধাও হয়ে গেলেন, তখন সত্যজিৎ রায় খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। চুনিবালা দেবী এতটাই বৃদ্ধা যে, তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ছবির কাজ বন্ধ করে দিতে হবে কারন ওরকম ইন্দিরা ঠাকুরন আর পাওয়া যাবে না। তাছাড়া অপুর ভূমিকায় যে অভিনয় করবে, সে যদি লম্বা হয়ে যায় তাহলে অপু চরিত্রে তাকে মানাবে না। দূর্গার বেলাতেও তাই।
তিনমাস পর অনিল বাবু ফিরে এলেন, তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ের এক কর্মচারীর মুখে শুনে, খবর নিয়ে এসেছেন…. পশ্চিমবঙ্গের সরকার বিধানচন্দ্র রায়কে আ্যাপ্রোচ করলে তিনি রাজি হলেও হতে পারেন। কর্মচারীটি এটাও জানিয়েছেন যে, বেলা সেন ও তার স্বামীর সাথে বিধানসবাবুর ঘনিষ্ঠতা আছে, কাজেই তাদের ধরলে কাজ হতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের মায়ের চেনাজানা ছিলো বেলা সেনের সাথে, তিনি ছেলের জন্য গিয়ে দাঁড়ালেন তাদের সামনে। সবাই অপেক্ষায় আছে কি হয় সেটার জন্য। তিনদিন পর বিধানচন্দ্র সত্যজিৎ রায়কে ডেকে পাঠিয়ে চিত্রনাট্য শুনলেন। শেষের দিকে হরিহর গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনে তিনি বললেন, “ কেন বাপু, গ্রামপঞ্চায়েতের সাথে মিলেমিশে গ্রামেই থাকুক না কেন!” যাই হোক, পরে সেই সমস্যারও সমাধান হয়। যদিও এই ব্যাপারে প্রচার দফতরের মিঃ মাথুরের খুবই আপত্তি ছিলো, কিন্তু বিধানচন্দ্রের কথার উপরে কথা বলার সাহস তার ছিলো না।
প্রথমে ‘পথের পাঁচালী’র’ শ্যুটিং শুরু হয় ১৯৫১ সালে, তারপর টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছবির ব্যয়ভার নেওয়াতে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ফিরিয়ে আনলেন স্ত্রীর বন্ধক দেয়া গয়নার বাক্স। এবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো ছবিটির। ততদিনে অপু বা দূর্গা চোখে পড়ার মতো বড় হয়নি, আর ইন্দিরা ঠাকুরনও বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। রবিশঙ্করের সেতারের মূর্ছনায় সম্পূর্ন করা হলো কালজয়ী ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি।
তথ্যঋণ গ্রন্থ—- আমাদের কথা লেখক— বিজয়া রায় ছবি— সংগৃহীত