লন্ডনের ব্রাইটনের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন – গণ পরিবহন বা হতে পারে রেস্টুরেন্ট বা রিসোর্টে “দীন মোহাম্মদ” -এর নাম দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি জাদুঘরেও তার ব্যবহৃত জিনিস রক্ষিত আছে। ব্রাইটনে এইসব দেখার পর একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, “দীন মুহাম্মদ” লন্ডনবাসীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তি। কিন্তু কে এই দীন মোহাম্মদ?

১৭৫৯ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশ। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির একটি শহর ছিল পাটনা। এই পাটনাতেই জন্ম হয় দীন মোহাম্মদের। তার বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। এমনিতে তাদের পেশা ছিল খাবার পরিবেশন করা। কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন আইরিশ সেনা গডফ্রে ইভান বেকার তার দায়িত্ব নেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আওতায় থেকে বেকারের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন দিন মুহাম্মদ। ইংরেজদের পক্ষ হয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন তিনি। হয়তো বংশগত কারণে দীন মোহাম্মদেরও ক্ষার ও ক্ষারীয় পদার্থের প্রতি শুরু থেকেই আগ্রহ ছিল। তাই এগুলো নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে থাকেন তিনি। তার এই গবেষণাই পরবর্তীতে তার জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছিলো।

১৭৮২ সালে দীন মুহাম্মদ বেঙ্গল আর্মির তৃতীয় ইউরোপীয় রেজিমেন্টে সুবেদার (লেফটেন্যান্ট) পদে অধিষ্ঠিত হন। এটা যেমন আনন্দের সংবাদ ছিল তার জন্য, তেমনি দুঃখের সংবাদ ছিল ক্যাপ্টেন বেকার তখন চাকরিতে অবসর নেয়ার পর নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসছেন। এদিকে পলাশীর যুদ্ধের পর সেই সময় বাংলার মসনদে ছিল মীর কাশেম, যে শুধুমাত্রই ইংরেজদের হাতের পুতুল। দীন মুহাম্মদ ভাবলেন, এই দেশে থেকেও তিনি কোন উন্নতিই করতে পারবেন না। ছোট বয়সেও ভবিষ্যৎটা তার কাছে পরিষ্কার ছিল। তাই দীন মোহাম্মদও চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেকারের সাথে আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান এবং ১৭৮৪ সালে আয়ারল্যান্ডের কর্কের অভিবাসী হন । কর্কে এসে ক্যাপ্টেন বেকারের সাহায্যে ১৭৮৬ সালে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় জেন ডেলির। জেন ডেলির সাথে তার বন্ধুত্ব একসময় ভালোবাসায় রূপ নেয়। কিন্তু জেনের পরিবার কিছুতেই দীনের মতো একজন সাধারণ ছেলের কাছে মেয়েকে দিতে রাজি হননি। দীন মুহাম্মদও তাই নিজের ধর্ম পাল্টে খ্রিস্টান হয়ে জেনকে বিয়ে করেন।

১৭৯৩ সালে দীন মুহাম্মদ ‘The Travels of Dean Mahomet’ নাম একটি বই প্রকাশিত করেন, যা সেসময়কার প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একজন ভারতীয়ের লেখা বই। ১৮০৭ সালে দীন কর্ক শহর ত্যাগ করেন এবং পোর্টম্যান স্কোয়ারে ‘হিন্দোস্তানী কফি হাউস’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। এটিই ছিল ইংল্যান্ডের প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। আর্থিকভাবে লাভ না হওয়ায় একসময় রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টটি বিক্রির পর দীন মুহাম্মদ ব্রাইটনে ফিরে আসেন এবং নতুন কিছু করার চিন্তা করতে থাকেন। সেই চিন্তা থেকেই ১৮১৪ সালের দিকে লন্ডনে প্রথম একটি ম্যাসাজ সেন্টার খোলেন। সেখানে বলা হলো, হালকা গরম পানিতে ভারতীয় ভেষজ উপাদান মিশিয়ে ম্যাসাজ করলে শরীরের বিভিন্ন ব্যথা দূর হয়। তাছাড়াও ভারতীয় ভেষজ উপাদান দিয়ে দাঁতের মাজন এবং চুলের রং- এর সাফল্যে তার নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ম্যাসাজ ছাড়াও ভারতীয় তেল ব্যবহার তিনি স্টিম বাথেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তার ম্যাসাজ সেন্টারে। ভারতীয় উপমহাদেশে মাথা মালিশকে বলা হতো চাম্পু। দীন মুহাম্মদ এই চাম্পু শব্দেরই পরিবর্তন করে ‘শ্যাম্পুং’ নামে অভিহিত করেন। বর্তমানে যেখানে বিখ্যাত কুইন্স হোটেল দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই ছিল দীন মুহাম্মদের ম্যাসাজ বা স্পা সেন্টার।

এই ম্যাসাজ সেন্টারে তিনি বিভিন্ন মেশিনেরও ব্যবস্থা করেন। ব্রাইটনের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও রোগী পাঠানো হতো তার স্পা সেন্টারে। তিনি এই ম্যাসাজের নাম দিয়েছিলেন ‘শাম্পনা’, যা পরবর্তীতে ‘শ্যাম্পু’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। যদিও ‘শ্যাম্পু’ বলতে বর্তমানে চুল পরিষ্কারের উপাদানকে বুঝায়।  ১৮২২ সালে ‘Cases cured by Sake Deen Mahomed, shampooing surgeon, and inventor of the Indian medicated vapour and sea-water bath.’ নামে আরেকটি বই প্রকাশিত করেন। সেই বইতে শ্যাম্পু এবং স্পা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা ছিল।

তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তিনি ছিলেন একজন পথ প্রদর্শক। দীন মুহাম্মদের সন্তানরা ও তাদের সন্তানরা যার যার জায়গা থেকে প্রতিষ্ঠিত ছিল। লন্ডনের ব্রাইটনে তাদেরও খুব সম্মান ছিল। দীন মোহাম্মদই প্রথম ব্যাক্তি ছিলেন, যিনি খ্রিস্টান ধর্মের নিয়ম ভেঙে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন।

ভারতীয় উপমহাদেশ যখন সিপাহী বিদ্রোহ করে ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলো, তারও ৮০ বছর আগে দীন মুহাম্মদ জয় করেছিল ইংল্যান্ডকে। ১৯৯৮ সালে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডেলরিম্পেল ‘The Travels of Dean Mahomet’ বইটি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার ফলাফলে তিনি বইয়ের লেখক দীন মোহাম্মদকে ‘ট্রিপল ফার্স্ট’ বলে অভিহিত করেন। প্রথমত, প্রথম ভারতীয় ব্যাক্তি হিসেবে তিনিই প্রথম ইংরেজি ভাষায় বই লিখেছিলেন। দ্বিতীয়ত, প্রথম ভারতীয় ব্যাক্তি হিসেবে তিনিই প্রথম লন্ডনের মাটিতে ভারতীয় খাবারে রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। তৃতীয়ত, প্রথম ভারতীয় ব্যাক্তি হিসেবে তিনিই প্রথম যার নামে ব্রিটিশ রিসোর্টের নামকরণ করা হয় “মাহোমেদ”। ১৮৫১ সালে ৯২ বছর বয়সে দীন মোহাম্মদ মারা যান। লন্ডনের সেন্ট নিকোলাস গির্জায় আছে তার সমাহিত করা হয়েছে। একজন ভারতীয় হয়েও ব্রাইটনবাসীর মনে আজও দীন মোহাম্মদ বেঁচে আছে তার কর্মের গুনে। ব্রাইটন শহরের আনাচে কানাচে তার স্মৃতি লালন করছে ব্রাইটনবাসী, গভীর শ্রদ্ধায়, পরম ভালোবাসায়।

 

Images Collected from Google

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...