১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস। কোনো এক সকাল বেলা সিকান্দারবাগের ভেতর থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর উপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করতে লাগলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিপদে দিশেহারা ব্রিটিশ বাহিনী। তবুও সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললো তারা। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণে সিকান্দারবাগের দেয়ালে ছোট একটি গর্ত করে ফেললো ব্রিটিশ সেনারা। দীর্ঘ সময় ধরে চললো সংঘর্ষ। আর ঐ সময়ের মাঝে দেয়ালের ছোট গর্তটি দিয়ে এক জন এক জন করে বহু সৈন্য সিকান্দারবাগে প্রবেশ করে ফেললো। এক পর্যায়ে ভারতীয় বিপ্লবীরা বিপদকে অনুধাবন করলেন। তারা বুঝে ফেললেন, পালিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আর কোনো দরজা খোলা নেই। পেছনের ফটকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ লড়াই শেষে আজ তারা ক্লান্ত, শ্রান্ত। মৃত্যুকে তারা চোখের সামনে অনুভব করলেন। ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ব্রিটিশ সৈন্যের মধ্যে সংঘটিত ভয়ংকর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের সিকান্দারবাগ।

লখনৌ এর শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। তিনি গোমতী নদীর কাছে ১৮৪৭ সালে তার প্রিয় স্ত্রী সিকান্দার বেগমের নামে গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান হিসেবে ব্যবহারের জন্য সিকান্দারবাগ প্রাসাদটি তৈরী করেছিলেন।

সংস্কৃতিমনা নবাবের পছন্দ ছিলো কত্থক-নৃত্য ও সংগীত-মুশায়রা। গোলাম আলী রাজা খান, দয়ানাত উদ্দৌলা এবং সাবিতের মতো নামকরা স্থপতিদের নিয়োগের মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে দীর্ঘ এক বছর সময় নিয়ে তিনি এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। তার এই মহলে প্রতিফলিত হয়েছে লখনৌ এর স্থাপত্যের আভিজাত্য।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ © Wikipedia

অসাধারণ সুন্দরভাবে তৈরী করেছিলেন তিনি এই মহল। দরবারের প্রধান চিত্রশিল্পী কাশীরামকে দিয়ে বাগের প্রধান প্রবেশদ্বারে আঁকিয়ে নিয়েছিলেন চমৎকার একটি ম্যুরাল। ম্যুরাল তৈরী শেষে এর সৌন্দর্যে তিনি এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, খুশি হয়ে তিনি কাশীরামকে একটি বিশেষ পোশাক দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।

তিন ফটকবিশিষ্ট এই মহল ছিলো লখনৌ এর এক অসাধারণ স্থাপত্য। প্রধান প্রবেশদ্বারের খিলান, ছাতা, ত্রিভুজ স্তম্ভ, প্যাগোডা ইত্যাদিতে ভারতীয়, ইরানি, ইউরোপীয় ও চীনা স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষণীয়। দরজাটিতে ছিলো মাছের ম্যুরাল। এ ধরনের ম্যুরাল মুঘলরা ব্যবহার করতেন। এটি ছিলো মারাতিব বা সম্মানের প্রতীক।

চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত এই মহল এবং বাগানের মাঝখানে ছিলো বিশাল মঞ্চ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বা অনুষ্ঠানগুলো মঞ্চস্থ হতো সেখানে। ততো দিনে সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিলো মুঘল দরবারী সংস্কৃতি। লখনৌ এর নবাবরা তা আবারো ফেরত নিয়ে আসলেন আউয়াধে।

ওয়াজিদ আলী শাহের নাচ-গানের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই হয়তো এখানে মঞ্চস্থ হয়েছিলো রাধা-কানাইয়ের কেচ্ছা। বহু নৃত্য-নাট্য প্রদর্শিত হয়েছিলো এই মঞ্চে। কত্থক নাচের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহ। তার দলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই শিল্পী-প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পেতো। রাজকীয় জৌলুসপূর্ণ বিলাসবহুল প্রাসাদ এবং বাগ-বাগিচা ঘেরা এই মঞ্চে দামী দামী গহনা-মণি-মুক্তা পরে নবাব যখন আসরের মধ্যমণি হতেন, তখন কি এক বারের জন্যও তিনি ভেবেছিলেন যে, তার হাতে তৈরী এই প্রেম-নিবাসের সাথেই যুক্ত হয়ে যাবে এক রক্তাক্ত ইতিহাস! বিশ্রামের জন্য তৈরী নবাবের প্রিয় এই সিকান্দারবাগের ভাগ্যে রচিত হয়েছিলো ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

সিকান্দারবাগের গেট, লখনউ

সময়টা ১৮৫৬ সাল। কুচক্রী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর নবাব ও তার পরিবারকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কোলকাতায়। আর আউয়াধ হয়ে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা মেনে নিতে পারলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠলো মহাবিদ্রোহের আগুন। স্থানীয় জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হলো ক্ষোভ। এমন পরিস্থিতিতে নবাবের আরেক স্ত্রী বেগম হজরত মহল তার ছেলে বিরজিস কাদেরকে নতুন নবাব ঘোষণা দিয়ে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী হজরত মহল ও তার সহযোদ্ধাদের ভয়ে স্থানীয় ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নেয় ব্রিটিশ রেসিডেন্সিতে। বিদ্রোহীরা চারদিক থেকে ঘিরে রাখে বাড়িটিকে। আর সিকান্দারবাগ প্রাসাদটিকে পরিণত করে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে।

মহাবিদ্রোহের সময় কানপুর ও লখনৌ এর সরকারি বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলো ভারতবর্ষের ব্রিটিশরা। নারী, পুরুষসহ বহু ইউরোপীয়কে বিল্পবীরা নিবিড়ভাবে হত্যা করেছিলো এবং বেশ কিছু দিন পর্যন্ত স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ভারতবর্ষের বিদ্রোহীরা। ব্রিটেন এবং ভারতীয় ব্রিটিশদের মনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়েছিলো সে সময়। এবার প্রতিশোধের পালা। প্রচন্ড গুলিবর্ষণে সৃষ্ট সিকান্দারবাগের ছোট ছিদ্রটি দিয়ে ঢুকে এক এক করে সব বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো ব্রিটিশরা।

ব্রিটিশ সামরিক কমান্ডার লর্ড রবার্টের বর্ণনায় জানা যায়, গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো ভারতীয় মুক্তিকামী সৈন্যদের। মৃতদেহের স্তুপ মাথার উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। মৃতদের গলিত শরীরের গন্ধে টিকতে পারছিলো না কেউ। অথচ বর্বরতা সেখানেও থেমে যায় নি। ব্রিটিশ অফিসাররা সৈন্যদের মৃতদেহগুলোকে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর পর্যন্ত করতে দেয় নি। দুর্ভাগা সেনাদের শেষকৃত্য পালনের সুযোগটা পর্যন্ত হয় নি। চিল ও শকুনের খাবার হিসেবে মৃতদেহগুলোকে ফেলে রাখা হয়েছিলো সিকান্দারবাগের উঠোনে। পরবর্তীতে উপর থেকে তোলা সিকান্দারবাগে পড়ে থাকা কঙ্কালগুলোর একটি বিখ্যাত ছবি এই নাটকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ বহন করে।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

সিকান্দার বাগ প্রবেশদ্বার, ১৮৬০-৭০ © British Library

পরবর্তীকালে সিকান্দারবাগ খননের ফলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো কামানের গোলা, তলোয়ার, ঢাল, বন্দুক, রাইফেলের কিছু অংশ। দেয়ালে আজও খুঁজে পাওয়া যায় কামানের গোলার সেই চিহ্ন, যে চিহ্ন আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভারতবর্ষের জনগণের দুইশো বছরব্যাপী গোলামীর শিকল পড়তে বাধ্য হবার এক অন্যতম যুদ্ধের কথা।

আজ আর সিকান্দারবাগে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। রয়েছে একটি প্রাচীর, ছোট একটি মসজিদ এবং বিশাল প্রবেশদ্বার। আর রয়েছে সেই বিদ্রোহে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত একজন অসীম সাহসী নারীর প্রতিফলক। রাইফেল হাতে দৃঢ় দৃষ্টিতে সামনের দিকে অগ্রসরমান পুরুষ সেনার ছদ্মবেশধারী দলিত সম্প্রদায়ের এই নারীর নাম উদা দেবী পাসি।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

কমান্ডার-ইন-চিফ স্যার কলিন ক্যাম্পবেল

বিদ্রোহী উদা দেবী ছিলেন আউধে জন্মগ্রহণকারী একজন মুক্তিকামী নারী। সিকান্দারবাগের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তার সম্পর্কেও রয়েছে এক মর্মস্পর্শী গল্প। ছোটবেলা থেকেই তিনি ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যখন সাধারণ জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করলো, তখন বেগম হযরত মহলের কাছে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি চেয়েছিলেন উদা দেবী। হজরত মহলের গঠিত মহিলা ব্যাটেলিয়নে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে উদা দেবীর স্বামী মাক্কা পাসি নিহত হন। আর এর প্রতিশোধ নেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন উদা দেবী।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

বর্তমান সময়ে প্রবেশদ্বার © Wikipedia

গোমতী নদীর দক্ষিণ তীর ধরে ব্রিটিশরা যখন সিকান্দারবাগের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিলো, তখন উদা দেবী একজন পুরুষের ছদ্মবেশে বট গাছে উঠে প্রায় ৩২ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেন। ব্রিটিশ সেনাদের কেউ একজন লক্ষ করেছিলো, তার সহযোদ্ধাদেরকে কোনো বিদ্রোহী উপর থেকে গুলি করছে। এটি বুঝতে পারার সাথে সাথে আশেপাশের গাছগুলোতে গুলি করতে শুরু করলো ব্রিটিশ সেনারা। এতে গুলিবিদ্ধ হন উদা দেবী। গাছ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তার দেহ। দেহটি পরীক্ষা করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যায় ব্রিটিশরা। এ তো পুরুষের ছদ্মবেশে একজন বিদ্রোহী নারী! এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়েও উদা দেবীর সাহসিকতায় ব্রিটিশ অফিসার কলিন ক্যাম্পবেল তার মৃতদেহের সামনে মাথা নত করে তাকে সম্মান জানান।

অসংখ্য মুক্তিকামী যোদ্ধাদের ইতিহাস আজও আমাদের কাছে রয়ে গেছে অজানা। লক্ষ্মীবাঈ, নানা সাহেবদের নাম যতো বার উচ্চারিত হয়েছে, উদা দেবীর নাম ততো বার আমরা শুনতে পাই নি। উদা দেবী আজ নেই। কিন্তু তার অসম সাহসিকতার গল্প রয়ে গেছে লখনৌতে।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

উদা দেবী © Wikipedia

সিকান্দারবাগ নিয়ে আজ নানা রকম গল্প প্রচলিত। সাধারণ মানুষ মনে করে, সিকান্দারবাগ প্রাসাদে ভুতের আনাগোনা আছে। অনেকে বলে, বিদ্রোহীদের বিদেহী আত্মাগুলো নাকি সিকান্দারবাগে ঘোরাফেরা করে। এসব কারণে সন্ধ্যায় সিকান্দারবাগের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে এ সব নিছকই উপকথা। শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই বাগ আসলে বহন করে চলেছে অগণিত বীরের স্মৃতি, ধারণ করে আছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। তাই তো আজও কান পাতলেই শোনা যায় ঘুঙুরের আওয়াজ, বিদেশী ভাষায় হিংস্রভাবে উচ্চারিত ‘কিল দেম’ ধ্বনি এবং ভারতীয় মুক্তিকামী বীরের দীপ্ত কন্ঠের শ্লোগান।

সিপাহী বিদ্রোহে সিকান্দারবাগের ভূমিকা ও একজন উদা দেবী

সিকান্দার বাগের অভ্যন্তর, ৯৩ তম হাইল্যান্ডার এবং 4র্থ পাঞ্জাব পদাতিক দ্বারা ২২০০ মিটানিনদের বধের দৃশ্য এবং মাটিতে মৃতদেহের অবশেষ। © Wikipedia

 

রেফারেন্সঃ