
যদি এ যুগের মুসলিম যুবকদের জিজ্ঞেস করা হয় হাইরেদ্দীন বারবারোসা কথা। তাহলে দেখা যাবে আমরা অধিকাংশই তাকে চিনি না। যারা চিনি তারাও হয়তো এটুকুই জানি তিনি ছিলেন লাল দাড়িওয়ালা একজন জলদস্যু, ভূমধ্যসাগরে মদ্যপ হয়ে লুটতরাজ করে বেড়াতেন। আফসোস ইসলামের এই বীর সেনাপতি সম্পর্কে এমন চিত্রই অঙ্কন করা হয়েছে Pirates Of The Caribbean নামক হলিউড মুভি এবং পশ্চিমা লেখকদের গল্প-উপন্যাসে। অথচ হাইরেদ্দীন বারবারোসা কোনো জলদস্যু ছিলেন না। তিনি ছিলেন উসমানী সালতানাতের একজন নৌসেনাপতি। মুসলিম জাতির প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে।

উসমানীয়া সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সীমানা, ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ
মধ্যযুগীয় সময়ে প্রভাবশালী বিশ্বশক্তির মধ্যে অন্যতম ছিল তুর্কি উসমানী সালতানাত। পানি ও স্থলে উভয় ক্ষেত্রে ছিল উসমানীয় মুসলমানদের আধিপত্য। বিশ্বজুড়ে এই প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারে উসমানীয় সুলতানদের পাশে থেকে যারা অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হাইরেদ্দীন বারবারোসা। আমরা ইতিহাসের অসংখ্য বীর যোদ্ধা সম্পর্কে জানলেও হাইরেদ্দীন বারবারোসার মতো অসাধারণ সেনাপতি সম্পর্কে খুব একটা জানা হয়ে ওঠেনি। তাই আজ আমরা জানবো, ইসলামি ইতিহাসের এমন এক বীর সেনাপতি সম্পর্কে যার নেতৃত্বেই ভূমধ্য সাগর যুক্ত হয়েছিল উসমানীয়দের মানচিত্রে।
হাইরেদ্দীন বারবারোসা আর দু চারজন সেনাপতির মতো ইতিহাসের কোন এক কোণায় ঠাঁই পেতেন কিন্তু তার অসামান্য অবদানের কারণে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন। মুসলিম জাতি তাকে স্মরণ করতে বাধ্য হয় তার অবিস্মরনীয় কর্মকাণ্ডের জন্য। হাইরেদ্দীন বারবারোসা কে মুসলিম জাতি স্মরণ করেন কারণ তিনি অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন মুসলিম জাতির কল্যাণ সাধনে। তিনি আন্দামান থেকে ৭০ হাজার মুসলমানকে মুক্ত করে আলজেরিয়া নিয়ে আসেন। স্পেনিশ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে ভূমধ্য সাগরকে তিনি নিরাপদ করে তোলেন। প্রিভেজার যুদ্ধে তিনিই ক্রসেডারদের নির্মমভাবে পরাজিত করেছিলেন।
হাইরেদ্দীন বারবারোসার জন্ম ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রীসের লেসবস দ্বীপের পালাইওকিপস গ্রামে। তিনি ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। পিতা ইয়াকুব বিন ইউসুফ ছিলেন উসমানী বাহিনীর একজন সাধারণ যোদ্ধা। মা ছিলেন আন্দালুসের বংশোদ্ভূত একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিমা নারী। সাদামাটা ছিম ছাম পরিবার। রাজনৈতিক বা সামাজিক ভাবে এই পরিবারের কোনো কতৃত্ব ছিল না। হাইরেদ্দীন বারবারোসার অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন আরুজ,আবু ইসহাক ও মোহাম্মদ ইলিয়াছ। খাইরুদ্দিনের মূল নাম খাসরুফ। দ্বীপে বসবাস করার কারণে খাইরুদ্দিনের ভাইয়েরা নৌবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বড় ভাই আরুজের বেশ কয়েকটি নৌকা ছিল।

হাইরেদ্দীন বারবারোসার বড় ভাই অরুজ।
প্রথম দিকে তিনি নাবিক হিসেবে কাজ করলেও পরে তারা ভুমধ্যসাগরের সেন্ট জনের জলদস্যুদের মোকাবেলা করতে থাকেন। আরুজ ও ইলিয়াস লেভান্টে অর্থাৎ আধুনিক সিরিয়া ও লেবাননে এবং খিজির এশিয়ান সাগরে তৎপরতা চালাতে। খাইরুদ্দিনের মূল ঘাটি ছিল স্যালোনিকা। ছোটো ভাই ইসহাক গ্রীসেই অবস্থান করতেন। তার কাজ ছিল পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করা। আরুজ অত্যন্ত দক্ষ নাবিক ছিলেন, তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। লেবাননের ত্রিপোলি অভিযান শেষে ফেরার পথে সেন্ট জনের জলদস্যুরা তার ওপর হামলা করে। আরুজ বন্দি হন, সংঘর্ষে ইলিয়াস নিহত হন। আরুজ তিন বছর বদ্রুম দূর্গে বন্দি থাকেন। সংবাদ পেয়ে হাইরেদ্দীন বদ্রুম যান এবং আরুজকে পালাতে সাহায্য করেন। মুক্তি পেয়ে আরুজ তুরস্কের আনাতোলিয়ায় যান।

বোদরামের দূর্গ, যেখানে অরুজ প্রায় তিন বছর বন্দি অবস্থায় ছিলেন এবং তার ছোট ভাই খিজর তাকে পালাতে সহয়তা করেন।
সেখানে তিনি উসমানী গভর্নর শাহজাদা কুরকুত কর্তৃক জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। সে সময়ে জলদস্যুরা উসমানীয়দের বাণিজ্যিক জাহাজ গুলোর উপর হামলা করে বেশ ক্ষতি সাধন করছিল। আরুজ এসব জলদস্যুদের ওপর একের পর এক অভিযান চালাতে থাকেন। তবে আরুজ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন আন্দালুস তথা স্পেনে অভিযান পরিচালনা করে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আন্দালুসের ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আন্দালুসে এসমন মুসলমানেরা সাগর পাড়ি দিয়ে তিউনেশিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকায় চলে আসে। যারা পালাতে পারেনি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। এই ধর্মান্তরিতদের কি পরবর্তীতে মরিসকো বলে অভিহিত করা হতো। তবে মুসলমানদের অনেকেই বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরিবর্তন করে গোপনে নিজের আকীদা-বিশ্বাসকে ধরে রেখেছিলেন। তারা গোপনে এবাদতও করতেন কিন্তু এই সুযোগ বেশিদিন মিলল না। তাদেরকে মুখোমুখি হলো ইনকুইজিশনের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও নির্মম নির্যাতনের।

নির্যাতনের এসব ছবিই বলে দেয় ইনকুইজিশনের ভয়বহতার পরিনাম
ইনকুইজিশন হল ক্যাথলিক চার্চ এর অধিনে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন যাদের কাজ ছিল ভিন্ন ধর্মালম্বিদের দমন করা। ইনকুইজিশন শুরু হলে আন্দালুস হয়ে ওঠে মুসলমানদের জন্য নরক তুল্য। এমন নরক যেখান থেকে পালানোর কোন উপায় নেই। ১৪১৫ সালে আরুজ ও হাইরেদ্দীন আলজিরিয়ার জিজেল শহরে অবস্থিত স্প্যানিশদের নৌঘাঁটিতে হামলা চালান। এই যুদ্ধে স্পেনরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। শহরের নিয়ন্ত্রণ আরুজের হাতে চলে আসে। শহরটি সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় এর সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনা করে আরুজ এই শহরকেই নিজেদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে আরুজ ও হাইরেদ্দীন তিলিসমাত শহরে অবস্থিত স্পেনিশ বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করেন। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের এক ফাঁকে আরুজকে স্প্যানিশরা ঘিরে ফেলে। তরবারির আঘাতে তাকে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। আরুজ আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন, কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে তিনি শহীদ হয়ে যান। স্প্যানিশরা আরুজের মাথা কেটে ইউরোপে নিয়ে যায়। তার কর্তিত মস্তক ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘোরানো হয়। আরুজের কর্তিত মস্তক যেদিক দিয়ে যেত সেখানকার গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা হতো। আরুজের মৃত্যুতে ইউরোপিয়ানরা খুব খুশি হয়েছিল। তারা ভেবেছিল আরুজের মৃত্যুর ফলে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে যাবে। আরুজের মৃত্যুতে ইউরোপীয়ানদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছিল কিন্তু তাদের জানা ছিল না তাদের এই স্বস্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। শিঘ্রই তাদেরকে মুখোমুখি হতে হবে এমন এক সেনাপতির যিনি আরুজের চেয়েও দুর্ধর্ষ ও বিচক্ষণ। সামনের দিনগুলিতে যিনি একাই ইউরোপিয়ান বাহিনীর ঘুম কেড় নেবেন। সেই সেনাপতিই হচ্ছেন হাইরেদ্দীন বারবারোসা।

হাইরেদ্দীন বারবারোসা
আরুজের মৃত্যুর পর মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব খাইরুদ্দিনের হাতে আসে। তার হাতে রয়েছে ছোট্ট একটি বাহিনী। এছাড়া আলজেরিয়ার বিশাল এলাকা তার দখলে। এছাড়া তিনি চাইলে স্বাধীন শাসক হিসেবে আলজেরিয়াই নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। আরাম-আয়েশে দিন কাটাতে পারতেন। স্প্যানিশদের সাথে খাতির করে নিজের রাজত্ব দৃঢ় করতে পারতেন। যেমনটা করছিল তিউনিসিয়ার হাফসি সুলতানরা। হাইরেদ্দীন সে পথে গেলেন না, তিনি তো আরামের জীবন চান না। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তার জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। প্রায়ই তিনি সঙ্গীদের বলতেন, মৃত্যুই যখন শেষ গন্তব্য তখন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয়।
হাইরেদ্দীন ভাবছিলেন আন্দালুসের মুসলমানদের কথা। তিনি ও তার ভাই বেশ কিছু মুসলমানকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখনো বন্দী অনেকেই ইনকুইজেশনের কারাগারে। হাইরেদ্দীন তাদেরকেও মুক্ত করতে চান। এদিকে ভূমধ্যসাগরে ঘুরছে ইউরোপিয়ানদের নৌবহর। হাইরেদ্দীন চান তাদের দম্ভচূর্ণ করতে কিন্তু হাইরেদ্দীন এর ছোট বাহিনী নিয়ে একাজ করা সম্ভব নয়। তার পাশে চায় শক্তিশালী কোন মিত্রকে। হাইরেদ্দীন ভাবছিলেন কে হতে পারে সেই মিত্র। অনেকভেবে হাইরেদ্দীন ঠিক করলেন উসমানীয়রাই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই মিত্ররা।

প্রথম সেলিম
১৩রা নভেম্বর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে খাইরুদ্দিনে আলজেরিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে একটি পত্র লিখেন। পত্রে তারা আরুজ ও খাইরুদ্দিনের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়। তারপর সুলতানের কাছে আবেদন জানানো হয় যেন আলজেরিয়াকে উসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। সুলতান সেলিম সবেমাত্র মিশর ও সিরিয়া সফর করে ফিরেছেন। এই পত্র পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হন। তিনি আলজেরিয়া কে উসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেদিন থেকে সুলতান সেলিম এর নামে আলজেরিয়াতে খুতবা পড়া হয়। সুলতান আলজেরিয়াতে ২০০০ সৈন্য ও একটি তোপখানা প্রেরণ করেন। হাইরেদ্দীন কেউ সম্মান সূচক বেলারবি পদ প্রদান করা হয়। হাইরেদ্দীন তার ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ভাইয়ের অসমাপ্ত মিশন সমাপ্ত করার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। হাইরেদ্দীন তো এটাই চাচ্ছিলেন, তিনি তো ক্ষমতা চাচ্ছিলেন না। চাচ্ছিলেন সামান্য একটু সাহায্য। যা নিয়ে তিনি ছুটে যাবেন নির্যাতিত মুসলমানদের কাছে। সুলতান প্রথম সেলিমের পর ক্ষমতায় বসেন সুলতান সোলায়মান আল কানুনি যিনিও পিতার মতো হাইরেদ্দীনকে সাহায্য করতে থাকেন।
১৫২৯ খৃষ্টাব্দে হাইরেদ্দীন আলজেরিউয়ার একটি দ্বীপে অবস্থিত স্প্যানিশ দুর্গে আক্রমণ করেন। তিনি বিশদিন একটানা গোলা বর্ষণ করেন। পরে কেল্লার পতন ঘটে। স্প্যানিশরা পালিয়ে যায়, অনেকেই হয় বন্দি । সেবছর হাইরেদ্দীন ৩৬টি জাহাজ নিয়ে স্পেনের উপকূলের বিভিন্ন শহরে যান এবং অনেক মুসলমান বন্দীকে মুক্ত করে আলজেরিয়া নিয়ে আসেন। এভাবে হাইরেদ্দীন বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। খায়রুদ্দিন ৭ দফায় ৭০ হাজার বন্দী মুসলমানকে স্পেন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। খাইরুদ্দিনের মূল নাম ছিল খাসরুফ। আন্দালুসিয়ার বাসিন্দারা তাকে উপাধি দেয় হাইরেদ্দীন। সেই নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এ নামের সাথে মিশে আছে নিজ জাতির জন্য তার অসামান্য কোরবানির ইতিহাস। ইউরোপীয়রা তার নাম দেয় বারবারোসা। ইতালি ভাষায় এই শব্দের অর্থ লাল দাড়িওয়ালা।

বারবারোসা হাইরেদ্দীন পাশা
হাইরেদ্দীন নিয়মিত ভুমধ্য সাগরে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। একের পর এক ইউরোপিয়ান নৌবহরকে তিনি পরাজিত করতে থাকেন। তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলেমান আল-কানুনি হাইরেদ্দীন ইস্তাম্বুলে আমন্ত্রণ করেন। হাইরেদ্দীন ৪৪টি জাহাজ নিয়ে ইস্তাম্বুলের পথে রওনা দেন। পথে যেসব দ্বীপে তিনি যাত্রাবিরতি করেছিলেন সেখানে উৎসুক জনতা তাকে একনজর দেখতে ছুটে আসে। হাইরেদ্দীন ইস্তাম্বুলে পৌছালে, তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়া হয়। পাশেই একটি মহলে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সুলতান তাকে উসমানীর নৌবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করেন। একইসাথে থাকে উত্তর আফ্রিকার বেলারবি বা গভর্নর নিয়োগ করা হয়। সুলতান তাকে রত্নখচিত একটি তরবারিও উপহার দেন। হাইরেদ্দীনকে নির্দেশ দেওয়া হয় একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলার। তাকে অস্ত্রাগার ও গোল্ডেন হর্নের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। হাইরেদ্দীন খুব দ্রুত কাজ করতে থাকেন। তিনি এক বছরে ৮৪টি জাহাজ নির্মাণ করেন। এরপর হাইরেদ্দীন তার বহর নিয়ে ইতালির কয়েকটি দ্বীপে হামলা করেন। কয়েকটি শহর উসমানীয়দের দখলে আসে। ঐতিহাসিক হাজী খলিফা লিখেছেন বারবারোসা ১২টি দ্বীপ দখল করেন এবং আরও ১৩ টি দ্বীপে হামলা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। তার অভিযানে মোট ১৬ হাজার লোক বন্দি হয়, মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া যায় প্রায় ৪ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। একের পর এক হামলা বিপর্যস্ত ইউরোপিয়ানরা সিদ্ধান্ত নেয় এবার তারা খাইরুদ্দিনের উপর চূড়ান্ত হামলা করবে। ভূমধ্যসাগর থেকে মুসলিম নৌবহরকে বিতাড়ন করা হবে। পোপ তৃতীয় জন পল হলি লীগ আহ্বান করেন। পুরো ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। গঠিত হয় সেসময়ের সবথেকে বড় নৌবাহিনী। ইউরোপিয়ানদের প্রস্তুতির খবর পৌঁছে যায় খাইরুদ্দিনের কাছে। তিনিও তার বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকেন। অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দুই বাহিনী গ্রীসের প্রিভেজা এলাকায় মুখোমুখি হয়।

রত্নখচিত তরবারি হাতে বারবারোসা
২৮ সেপ্টেম্বর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ, ইউরোপিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি উসমানীয় বাহিনী। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই নির্ধারন হয়ে যাবে কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ভুমধ্য সাগরের নৌপথ। ইউরোপিয়ানদের বিশাল বাহিনী। যুদ্ধজাহাজ এসেছে ৩০২টি, মোট সেনা সংখ্যা ৬০ হাজার। অপরদিকে উসমানীয় বাহিনীর জাহাজ ১২২টি, সেনা সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। ইউরোপিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে এন্ডোরিয়া ডোরিয়া। অপরদিকে মুস্লিম বাহিনীর নেতৃত্বে হাইরেদ্দীন বারবারোসা। তার সহকারি হিসেবে আছেন সাঈদ আলী রইস, বিখ্যাত মিরাতুল মামালিক গ্রন্থের লেখক। যেকোনো বিশ্লেষণেই এই যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। শক্তির বিচারে দুর্বল উসমানীয় বাহিনীর শক্তিশালী ইউরোপিয়ান বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টেকার কথা নয়। হাইরেদ্দীন বারবারোসা তার বহরকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম তিনটি বাহর তিনি ব্রক্রাকারে সাজান। যুদ্ধের শুরুতেই এই তিনটি বহর ব্রক্রাকারে এগিয়ে যায় ইউরোপিয়ান বাহিনীর দিকে। এন্ডোরিয়া ডোরিয়া অবাক হয়ে দেখলেন উসমানীয় বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক উসমানীয় বাহিনী থেকে এমন দুঃসাহসীক হামলা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এন্ডোরিয়া ডোরিয়া তার বহর নিয়ে সরে যেতে চাইলেও বাতাস স্থির থাকায় তার চেষ্টা সফল হয়নি। ইতমধ্যে খাইরুদ্দিনের বহর থেকে গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। ইউরোপিয়ান বাহিনীর পাল্টা জবাব দেয় কিন্তু খাইরুদ্দিনের প্রথম আক্রমণ তাদের মনোবলে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, সমুদ্র হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্র।
একের পর এক কামান গর্জাচ্ছে, বাতাসে বারুদ আর রক্তের গন্ধ, চারপাশ থেকে আহতদের চিৎকার ও জীবিতদের শ্লোগান ভেসে আসে। যুদ্ধে উসমানীয় বাহিনী এগিয়ে যায়। বিপুল সেনা থাকার সত্বেও ইউরোপিয়ান বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। ৭ ঘন্টার লড়াই শেষে ইউরোপীয় বাহিনী পরাজিত হয়। এন্ডোরিয়া ডোরিয়া পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের ১৩ টি জাহাজ ধ্বংস হয়, ৩৬টা জাহাজ উসমানীয়রা দখল করে নেয়। ৩ হাজার ইউরোপিয়ান সেনা বন্দি হয়। অপরদিকে উসমানীয়দের ৪০০ সেনা নিহত হয়, আহত হয় ৮০০ সেনা। তাদের কোন জাহাজই হারাতে হয়নি। এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য। শীঘ্রই এই যুদ্ধের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্ব জুড়ে। মক্কা, মদিনা, আল কুদস, সামারকান্দ, দামেস্ক, কাইরোর মসজিদ গুলোর মিনার হতে উচ্চারিত হতে থাকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। এই যুদ্ধের ফলে ভূমধ্যসাগরে উসমানীয়দের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে ভূমধ্য সাগরের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই হাতে। এমনকি ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও সিসিলির জাহাজগুলো ভূমধ্য সাগরে চলার জন্য উসমানীয়দের ট্যাক্স দিত।
এই যুদ্ধ জয়ের পেছনে ছিল হাইরেদ্দীন বারবারোসার কুশলি আক্রমণ ও সেনা পরিচালনা। ইউরোপের কাছে এই নাম ছিল আতঙ্কের মতো। হাইরেদ্দীন বারবারোসার সারা জীবন কেটেছে সমুদ্রে। একের পর এক লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। চাইলে নির্বিঘ্ন জীবন বেছে নিতে পারতেন, কিন্তু সে পথে হাঁটেনি কখনোই। নিজ জাতির কল্যাণ সাধনের মাঝেই খুজে পেয়েছিলেন সুখ। পুথিগত বিদ্যায় হাইরেদ্দীন হয়তো পরও কেউ ছিলেন না, কিন্তু তার জীবনটাই হয়ে উঠেছে উত্তরসূরিদের জন্য হাজারো বইয়ের চেয়ে মূল্যবান কিছু। ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে পুত্র হাসান পোশাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে হাইরেদ্দীন বারবারোসা ইস্তাম্বুলে চলে যান। ৪ জুলাই ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে ৬৮ বছর বয়সে ইসলামের এই মহান যোদ্ধা ইস্তাম্বুলে ইন্তেকাল করেন।

হাইরেদ্দীন বারবারোসার সমাধি ইস্তাম্বুল