আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

আজ থেকে প্রায় ২২০০ বছর আগের গল্প বলছি। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের কথা। মেসিডোনিয়া থেকে শত শত মাইল দূরে ছোট একটি গ্রীক নগরী গড়ে উঠেছিলো, আমু-দরিয়া নদীর তীরে। এটি অক্সাস নামেও পরিচিত ছিলো। প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, কি করে মেসিডোনিয়া থেকে এতো দূরে আফগানিস্তানের এক কোণে একটি গ্রীক নগরী বিকশিত হলো? আমরা জানি যে, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে মেসিডোনিয়ার এক উচ্চাভিলাষী যুবক রাজা প্রচণ্ড প্রতাপশালী পারস্যের রাজাকে পরাজিত করেন। ‘বুসেফেলাস’ নামক ঘোড়ায় চড়ে সেই যে দিগ্বিজয়ের শুরু তিনি করেছিলেন, তার সমাপ্তি ঘটে এই হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে। নিজের সেনাপতিদের খুশি করতে গিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত আর অতিক্রম করেন নি তিনি। রাজ্যের শেষ সীমা সেখানেই বেঁধে দিলেন এবং সেখান থেকেই স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তিনি।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

অয়-Khanoum চরম পূর্ব অবস্থিত ছিল ব্যাকট্রিয়ার , এর দোরগোড়ায় এ মৌর্য সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারত ।

কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তার সহায় ছিলেন না, পথিমধ্যে ব্যবিলনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হেলেনীয় বিজয়ের এই ধারা সেই যে আলেকজান্ডারের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো, তার শেষ হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার এই বিশাল সাম্রাজ্য তার উত্তরসূরীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলো এবং তারাই গ্রীক সংস্কৃতিকে গ্রীস থেকে মিশর ও মিশর থেকে আফগানিস্তানে পৌঁছে দিয়েছিলো। তিনটি শক্তিশালী জাতির মিলনের ফলে স্থানীয়ভাবে স্বীকৃত একটি স্বতন্ত্র গ্রীক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে আফগানিস্তানে। কতোটা জলজ্যান্ত এ মিলনের গল্প! যেনো চোখ বন্ধ করলেই সেই আফগানিস্তানকে দেখা যাবে। দেখেই আসা যাক তবে, কি হচ্ছে সেখানে।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

আই-খানুমের পরিকল্পনা

একটি শহরের প্রধান সড়কে বড় বড় স্প্রিংবিহীন কাঠের চাকার এক্কাগাড়িতে চড়ে নগরীর গভর্নর চলেছেন একটি বিশাল মন্দির উদ্বোধন করতে। তার আগমনী বার্তা জানিয়ে দেয়া হচ্ছে বিউগল বাজিয়ে। মন্দিরের বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গ্রীক পোশাক পরে ও মাথায় ফুলের ব্যান্ড লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। তাদের পাশে সম্ভ্রান্ত পার্সিয়ান ও ভারতীয় নাগরিকদেরও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। পৌঁছে গেলেন গভর্নর মন্দিরটির দরজায়। অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন অনন্য সেই কীর্তিকে। এমন নিদর্শন চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হয়তো সবার হয় না।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

সিংহ দ্বারা টানা সাইবেলের চিত্র , একটি ভোটদানের বলি এবং সূর্য দেবতা । আই-খানৌম, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী।

সময়টা ১৯৬১ সাল। আফগানিস্তানের বাদশাহ মোহাম্মদ জাহির, মতান্তরে খান গোলাম সারওয়ার নাসের উত্তর-পূর্বে অবস্থানকালে একটি জঙ্গলপূর্ণ এলাকায় শিকারের জন্য বের হয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে হঠাৎ করেই তিনি একটি প্রাচীন বসতির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান। এর তিন বছর পর পল বার্নার্ডের নেতৃত্বে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল এই জায়গাটি খনন শুরু করে। তাদের এই আবিষ্কার ছিলো এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। প্রাচীন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে এটি ছিলো অন্যতম। পুরো জায়গাটির নাম ‘আই-খানুম’, উজবেক ভাষায় যার অর্থ ‘লেডী-মুন’। একটি ক্লাসিক্যাল গ্রীক শহরের যে সব বৈশিষ্ট্য থাকার কথা, তার সবই ছিলো সেখানে। প্রথমে মনে করা হতো, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর শেষের দিকে আলেকজান্ডার যে ২০টি শহর গড়ে তুলেছিলেন, তার মধ্যে কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া একটি শহর ‘আলেকজান্দ্রিয়া অক্সাস’-ই এই ‘আই-খানুম’। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন সাইটে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলো পরীক্ষা করে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ সালে সেলিউসিড সাম্রাজ্যের রাজা অ্যান্টিওকাস এই শহরটি গড়ে তোলেন।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

এআই-খানৌমে পাওয়া ভারতীয় প্লেটটি কুনালার পুরাণকে (পুনর্গঠনের সাথে) উপস্থাপন করার কথা ভেবেছিল ।

এই শহরে কলোনী তৈরী নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক আরিয়ান এর মতে, সভ্যতা থেকে বঞ্চিত এই অজ্ঞাত অঞ্চলকে শিক্ষিত করে তোলার জন্যই মেসোপটেমিয়া থেকে মানুষকে এখানে এনে বসবাস করানোর চেষ্টা শুরু করা হয়। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই যুক্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আলেকজান্ডার নিজেই মৃত্যুর আগের সময়টাতে পার্সিয়ান পোশাককে নিজের করে নিয়েছিলেন, তিনি পার্সিয়ান স্ত্রীকে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই স্ত্রীরই গর্ভের সন্তানের পিতা হতে চেয়েছিলেন। পার্সিয়ান কোর্ট সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তার সভাসদদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সেসব তোয়াক্কা না করে তাকে আপন করে নিয়েছিলেন।

আলেকজান্ডারের উত্তরসূরীদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন সেলিউকাস নিকাতোর। সিরিয়া, পার্সিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার পুরোটাই ছিলো তার পাওয়া অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সেলিউকাস ও তার ছেলে অ্যান্টিওকাস এই রাজ্যে গ্রীক জনগোষ্ঠী বাড়াবার লক্ষ্যে মেসোপটেমিয়া থেকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে বহু লোকবল নিয়ে এসেছিলেন। ব্যাক্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের পাশে অক্সাস ও কোকশা নদীর মধ্যবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত ‘আই-খানুম’ তেমনই একটি বসতি। সমৃদ্ধ কৃষিজমি, ফসল ফলানোর জন্য অত্যন্ত উপযোগী নদীবাহিত পলি, পাশেই হিন্দুকুশ পর্বত থেকে পাওয়া খনিজ পদার্থের আকরিক এবং বাণিজ্যের জন্য বিকশিত সিল্ক রোডই ছিলো এই অঞ্চল বাছাইয়ের প্রধান কারণ। একদিকে ছিলো ভারতবর্ষ এবং অন্যদিকে চীন। চীন থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি হিন্দুকুশ এর মধ্য দিয়ে আই-খানুমে আসা ছিলো খুবই সহজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই শহরটি ছিলো প্রাচীন ভারতবর্ষের একেবারে দ্বারপ্রান্তে। আর তাই, ভারতীয় সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে নিজেদেরকে আলোকিত করার ইচ্ছা সংবরণ করার কোনো কারণই ছিলো না। দক্ষিণ ভারতের সাথে যে আই-খানুমের গভীর যোগাযোগ ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানে পাওয়া একটি নিদর্শন থেকে। একটি ঝিনুকের ওপরে একটি চাকতিতে ‘কালিদাসের শকুন্তলা’ গল্পটিকে লিখে অমর করে রেখেছিলো তারা।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

ভারতীয় সম্রাট অশোক 258 খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোকের কান্দাহার এডিক্টে গ্রিক ও আরামাইক ভাষায় একটি দ্বিভাষিক শিলালিপিতে গ্রিকদের সম্বোধন করেছিলেন । কাবুল মিউজিয়াম ।

গ্রীকদের তৈরীকৃত বিশাল মন্দিরটি কিছুটা পার্সিয়ান স্থাপত্যকৌশলকে গ্রহণ করেছিলো। শহরের কেন্দ্রে যে মন্দিরটি, সেটি পাহাড়ের উপরে ৬০ ফুট উঁচু শক্ত ভিত্তির উপর তৈরী করা হয়েছিলো। বিশাল তার আকৃতি! শহরের ভেতরে আরেকটি মন্দিরে জিউসের বিগ্রহকে জোরোস্ট্রিয়ান মডেলে স্থাপন করা হয়েছিলো। খোলা কলামের কাঠামোর পরিবর্তে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির ধারাকে গ্রহণ করে বিশাল প্রাচীর ঘেরা ঘরের ভেতর বিগ্রহটি স্থাপন করা হয়েছিলো। পাথরের অপ্রতুলতার জন্য ভেতরের মূর্তিটিও তারা নতুন ধারায় বানিয়েছিলো। প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জিমনেসিয়াম এবং ৬০০০ আসনের অ্যাম্ফিথিয়েটারও তৈরী করেছিলো তারা। হোমার তখন খুব জনপ্রিয় ছিলো, তাই নিজেদের আদি ভূমির স্বাদ পেতে হোমারের নাটকগুলো সেখানে মঞ্চস্থ করা হতো। পার্সিয়ান, ভারতীয় ও গ্রীক সকলের পরিচিত ট্রয়ের ট্র্যাজেডিও দেখানো হতো সেখানে। তাদের ইচ্ছা ছিলো, এই থিয়েটার ভবন যেনো ব্যবিলনের চেয়েও আকারে বড় হয় এবং তা-ই করা হয়েছিলো। গ্রীক নর্তকী ও অপেরা গায়িকারা ঝরনার মতো কলকল শব্দ করে হেঁটে যেতো এদিক-ওদিক। আরও ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো সুগঠিত দেহ, সৌম্যকান্তি, কোঁকড়া চুল, তামাটে বর্ণ ও কটা চোখের যুবকদের। তাদের গলার স্বর কিছুটা কর্কশ শোনালেও খেলার সময় হাতের ডিস্কটা যখন তারা ছুঁড়ে মারতো, তখন বোঝাই যেতো যে জিমনেসিয়ামে নিয়মিত ব্যায়াম করে তারা গড়ে তুলেছিলো এই দক্ষতা। স্পার্টার যুবকদের আদর্শে তারা গড়ে তুলেছিলো নিজেদের দেহ। মোজাইকগুলোও করা হয়েছিলো গ্রীক আদলে গ্রীক স্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টায়। মেসিডোনিয়ার সূর্য, বাসক পাতা, কাঁকড়া, ডলফিন ইত্যাদির ছবিগুলো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো মোজাইকে। শহরের বাড়িঘরগুলো করা হয়েছিলো গ্রীক রীতিতে। করিন্থিয়ান স্টাইলে খোদাই করা ছিলো প্রতিটা কলাম এবং উঠোন ছিলো সংঘবদ্ধ। শহরের কেন্দ্রে এর প্রতিষ্ঠাতাকে উৎসর্গকৃত একটি মন্দিরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ পাওয়া যায়, যাতে ‘ডেলফির প্রবচন’ খোদাই করা ছিলো। প্রবচনটি হলো- “ছেলেবেলায় ভালো আচরণ করতে শেখো, যৌবনে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো, মধ্যবয়সে ন্যায়সংগত হও, বৃদ্ধ বয়সে ভালো উপদেশ দাও, আর বিনা অনুতাপে মৃত্যুবরণ করো”।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

সেলিউসিড রাজা অ্যান্টিওকাস আই সোটারের স্বর্ণের স্টেটার আই-খানৌমে খনন করা হয়েছিল, গ। 275 BCE। বিপরীত: অ্যান্টিওকাসের ডায়াডড হেড। বিপরীত: নগ্ন অ্যাপোলো ওমফালোসে বসে , ধনুকের উপর ঝুঁকে এবং দুটি তীর ধরে। গ্রিক কিংবদন্তি: ΒΑΣΙΛΕΩΣ ΑΝΤΙΟΧΟΥ (কিং অ্যান্টিওকোসের)। Left বাম মাঠে Ai-Khanoum এর মনোগ্রাম।

ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ছিলো তাদের কঠোর দৃষ্টি। কাশ্মীর থেকে আসা শাল, গান্ধার থেকে উটের পিঠে চড়ে আসা ফল, চীন থেকে আসা কাঁচের বাসন, জলপাই, আঙ্গুর ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে বসতো দোকানদাররা। আরও পাওয়া যেতো বিদেশী শূরা এবং নানারকম পাথর বসানো গয়না। গয়নাগুলোতে থাকতো পার্সিয়ান মুক্তা, বার্মার রুবি, ব্যাক্ট্রিয়ার লাপিজলাজুলি এবং মেসোপটেমিয়ার কোরাল। মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়া থেকে তারা অ্যাম্ফোরিয়াতে করে তেল নিয়ে আসতো। কেউ কেউ আবার দেশীয় মেয়েদের বিয়ে করে সংসারও শুরু করতো। বাগানগুলোও খুব পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতো তারা, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো জলপাই এর গাছ। আর সেই প্রমোদ ঊদ্যানে বসে এথেন্স থেকে আসা কোনো এক গৃহশিক্ষক হয়তো আবৃত্তি করে শোনাতেন মনোমুগ্ধকর কোনো কবিতা, পড়ে শোনাতেন অতীতের গ্রীকবিদদের জীবনের গল্প, অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর জীবনী নিয়ে চলতো জ্বলন্ত বিতর্ক। গ্রীস থেকে এতো দূরে বসবাসকারী গ্রীকদেরকে গ্রীসের সাথে পরিচিত করানো হতো ফেলে আসা অতীত ইতিহাসকে বর্ণনা করার মাধ্যমে।

সেলিউসিড সাম্রাজ্যের রাজধানী থেকে ব্যাক্ট্রিয়া কিংবা আই-খানুম অনেক দূরত্বে অবস্থিত হওয়ায় ব্যাক্ট্রিয়া, সগডিয়ানা –এই অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সেলিউকাসদেরকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো। আর এই দূরত্বের সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ব্যাক্ট্রিয়ার গভর্নর ডিওডোরাস নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে নিজেই ব্যাক্ট্রিয়ার সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এভাবেই ‘গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়া’ নামক আরেকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্শ্ববর্তী রাজ্য হিসেবে ‘আই-খানুম’ –ও এই সুযোগটি গ্রহণ করে। সেলিউকাসের সাথে টলেমীর ক্রমাগত যুদ্ধ লেগে থাকার কারণে তাদের মনোযোগ পূর্ব দিকেই নিবদ্ধ থাকতো বেশি। আর এ কারণেই একদম এক কোণে অবস্থিত এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি তাদের পক্ষে। কিন্তু এক পর্যায়ে, টলেমীর সাথে তাদের সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে গেলে আবারও এই রাজ্যগুলো তারা পুনরুদ্ধার করেন, তবে এবারও তারা স্থায়ীভাবে এই রাজ্যগুলো রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। রাজ্য পরিচালনার স্বার্থে যেই না একটু অন্যদিকে মনোযোগ নিবদ্ধ হতো, তৎক্ষণাৎ ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা আবারো নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে বসতেন। এক্ষেত্রে গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্কটাই গভীর হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বার যখন ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা স্বাধীন হলেন তখন তা গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের জন্য একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করে। এটিকে বলা হতো, ‘গোল্ডেন এইজ অফ দ্য কিংডম’। ধীরে ধীরে এই গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়তে থাকে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা আরো বেশি সমৃদ্ধ হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০ অব্দে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যায় তারা এবং ঐ দশকেই ভারতবর্ষের সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক চরমভাবে বিকশিত হয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট অশোকের গ্রীক ও আর্মাইক ভাষায় লেখা কান্দাহার শিলালিপি এবং কান্দাহারে সম্পূর্ণ গ্রীক ভাষায় লেখা শিলালিপিই দুই রাজ্যের মধ্যকার সুসম্পর্ক ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের প্রমাণ বহন করে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, চীনের সাথেও গড়ে ওঠে গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ানদের এক শক্তিশালী সম্পর্ক। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর শেষ দিকে হান রাজ্যের কূটনৈতিক দূত জাং-কিয়ান ব্যাক্ট্রিয়ায় এসে সেখানকার বাজারে চীনা পণ্য দেখে হতবাক হয়ে যান। ভারতবর্ষের মাধ্যমে পণ্যটি চীন থেকে ব্যাক্ট্রিয়ার বাজারে প্রবেশ করেছিলো। চীনে ফিরে গিয়ে তিনি ব্যাক্ট্রিয়ার পরিশীলিত নগর সভ্যতা সম্পর্কে সম্রাটকে অবহিত করেন এবং তাদের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে সম্রাটকে উৎসাহিত করেন। সিল্ক রোডের সূত্রপাতও এর মাধ্যমেই হয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ‘আই-খানুম’ এর সাথে আর তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে নি। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বিশাল অর্থের আমদানি ও বিত্তবান হওয়া আই-খানুমে বহিরাগত দস্যুকে নিমন্ত্রণ দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০-১২০ অব্দে দক্ষিণ থেকে যাযাবর ইন্দো-ইউরোপীয়ান সিথিয়ানরা ব্যাক্ট্রিয়া অতিক্রম করে ঐ জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এভাবে নির্বিচারে আক্রমণের কারণে একসময় জনমানবশূন্য হয়ে যায় অঞ্চলটি। চীন থেকে আসা ইউ-চি জাতি, যারা কুষাণ বংশের পূর্বপুরুষ, তাদের আক্রমণে তছনছ হয়ে যায় সম্পূর্ণ শহরটি।

আই-খানুমঃ সংমিশ্রণের দৃষ্টান্ত বহনকারী হারিয়ে যাওয়া একটি অনন্য ইন্দো-গ্রীক নিদর্শন, Stay Curioussis

হিন্দু দেবতাদের সঙ্গে গ্রিকো-ব্যাকট্রিয়ান রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রা ।

এভাবে শহরটি ধুলোয় মিশে যাওয়ার ফলে বহু দিন আমরা গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান ও ইন্দো অভিবাসনের ধারণা শুধুমাত্র কিছু মুদ্রার মাধ্যমেই পেয়েছি। আর এ কারণেই ‘আই-খানুম’ এর আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক আবিষ্কার। মেসিডোনিয়া থেকে এতো দূরে এসে যে গ্রীকরা বসতি গড়েছিলো এবং নিজেদের সংস্কৃতিকে সংমিশ্রণের একটি অনন্য পরিচয় দিয়েছিলো, তারই প্রমাণ দেয় এই আবিষ্কার। ইস্টের দোরগোড়ায় তাদের আবির্ভাবের এতো স্পষ্ট প্রমাণ এর আগে আমাদের কাছে ছিলো না। এ জন্যই গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ানদের ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রেও এই আবিষ্কার ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় উপমহাদেশের ৫০০০ বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণীর এটি একটি অংশমাত্র। এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।