স্টিফেন হকিংয়ের বয়স যখন একুশ বছর, তখনই তিনি মৃত্যুর পরোয়ানা পান।দুরারোগ্য মোটর নিউরনে তিনি আক্রান্ত হন, ডাক্তাররা তাঁর আয়ু বেঁধে দেন মাত্র দুইবছর। একে একে তাঁর হাত পা অকেজো হতে লাগলো কিন্তু তিনি বাঁচার স্বপ্ন দেখা ছাড়েন নি। হুইল চেয়ারে বসেই তিনি তাঁর অসাধারন মস্তিষ্ক আর হৃদয় সম্বল করে তাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়ে গেলেন। একসময় ঘাতক নিওমোনিয়া তাঁর অস্পষ্ট কথাও কেড়ে নিলো। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি এক ধরনের ভাষা – উৎপাদনকারী যন্ত্রের সাহায্যে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতেন। প্রথমে হাতে রাখা একটি সুইচের মাধ্যমে এবং শেষ পর্যন্ত গালের একটিমাত্র পেশীর সাহায্যে তিনি যন্ত্রটি চালাতেন। তারপরও বহু বছর যাবৎ তিনি তার গবেষণা সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসাবে টানা তিরিশ বছর তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১৩ সালে লিখলেন ‘ আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। বইটি সর্বকালের জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের তালিকায় ঠাঁই পেলো। তিনি হয়ে উঠলেন একজন তারকা ! আইনস্টাইন পরে আর কোন বিজ্ঞানীর কপালে এমন খ্যাতি জোটেনি। বইটিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও বিজ্ঞানীজীবন একাকার হয়ে আছে।

তাঁর বাবা ফ্রাঙ্কের জন্ম ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়রের এর বর্গাচাষি পরিবারে। ফ্রাঙ্কের দাদা জন হকিং ছিলেন খুব সম্পদশালী কৃষক, সে সময় তাঁর অনেকগুলি খামার ছিলো। কৃষিমন্দার সময় তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়লে, তাঁর ছেলে রবার্ট ( স্টিফেন হকিংয়ের দাদা) তাঁকে সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পরে তিনিও দেউলিয়া হয়ে পড়েন। রবার্টের স্ত্রীর একটি বাড়ি ছিলো বরোব্রিজে, খুব সামান্য আয়ে সেখানে তিনি একটি স্কুল চালাতেন। কোনমতে তারা ছেলে ফ্রাঙ্ককে ( হকিংয়ের বাবা) অক্সফোর্ডে পাঠান ডাক্তারী পড়তে। ফ্রাঙ্ক সেখানে বেশ কয়েকটি স্কলারশিপ ও পুরস্কার পান, যে কারনে বাবা- মাকে আর্থিক সহায়তা করতে পারতেন। এরপর তিনি গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার ট্রপিকাল মেডিসিন বিষয়ে গবেষনা করেন। দেশে ফিরে তিনি সামরিক বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দেন।

স্টিফেন হকিংয়ের মায়ের জন্ম স্কটল্যান্ডের ডানফার্মলাইনে। তাঁরও জন্ম এক চিকিৎসক পরিবারে, সেই পরিবারের আট সন্তানের মধ্যে বড় মেয়েটি ডাউন সিনড্রোমে ভুগে তের বছর বয়সে মারা যান। এরপর তাঁদের পুরো পরিবার ডেভনে চলে আসে। যদিও তাঁদের পরিবার এতো স্বচ্ছল ছিলোনা, তারপরও তাঁর মাকে অক্সফোর্ডে পড়তে পাঠানো হয়। সেখানকার লেখাপড়া শেষ করে তিনি বেশ কয়েকটি চাকরি করেন। সেই সময় তিনি ছিলেন তরুন কমিউনিস্ট লীগের সদস্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে তাঁর দেখা হয় ফ্রাঙ্কের সাথে। লন্ডনে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন একটি চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে হকিংয়ের মা-বাবার পরিচয় হয়, সেখানে তিনি মেডিক্যাল সহকারী হিসেবে এবং ফ্রাঙ্ক চিকিৎসা গবেষক হিসেবে কাজ করতেন।হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান, সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে ‘বোমাবর্ষণ’ করতো। ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি স্টিফেন হকিং জন্ম নেন অক্সফোর্ডে। তাঁর জন্মের পর তাঁরা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। তাঁর জন্মের ১৮ মাস পরেই তাঁর বোন মেরির জন্ম হয়। তাদের বয়সের গ্যাপ কম থাকায় ছেলেবেলায় ভাই বোনের খুনসুটি লেগেই থাকতো।অবশ্য বড় হয়ে সেসব আর ছিলোনা, মেরি ডাক্তার হওয়ায় তাঁর বাবা- মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন ফিলিপ্পা নামের আর একটি বোন হয় তাঁদের, সেই বোনটি ছিলো সবার আদরের। পরে এডওয়ার্ড নামে একজনকে দত্তক নেয়া হয়, পড়ালেখা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোন কাজে তার আগ্রহ ছিলোনা। সে ছিলো খানিকটা বেয়াডা ধরনের। ২০০৪ সালে সে মারা যায়।

সে সময় পড়ালেখার জন্য হাইগেট এলাকার বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা তাঁদের সন্তানদের বায়রন হাউস স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু হকিংয়ের অভিযোগ ছিলো এই স্কুল তাঁকে কিছু শেখাতে পারছেনা। তাঁর স্মৃতির মধ্যে ছিলো প্রতিবেশী বন্ধু হাওয়ার্ড। যেহেতু তার বাবা- মা কোন বুদ্ধিজীবী ছিলেন না, তাই সে পড়তো কাউন্সিল স্কুলে। সে ফুটবল, বক্সিংসহ এমন সব খেলা জানতো যেটা তাঁর বাবা- মা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।

১৯৫০ সালে তাঁর বাবার কাজের জায়গাটি সরিয়ে নেয়া হয়, হ্যাম্পস্টেড থেকে লন্ডনের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী মিল হিলে, নবনির্মিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চে। সেই সময় তাঁর বাবা মা সেন্ট আ্যালবান্সের ক্যাথেড্রাল সিটিতে একটি বাড়ি কিনে ফেললেন। সেন্ট আ্যালবান্সের অবস্থান ছিলো প্রাচীন রোমান শহর ভেরুলিমিয়ামের কাছে। লন্ডনের পরে এটাই ছিলো ব্রিটেনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোমান বসতি। ১৯৮৫ সালে তাঁর বাবার অসুস্থতার সময় বাড়িটি বিক্রি করে দেয়া হয়। তার পরের বছরই তাঁর বাবা মারা যান।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং কয়েক মাস সেন্ট অ্যালবান্স‌ের মেয়েদের স্কুলে পড়েন। সে সময় ১০ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো। পরে সেখান থেকে ছেলেদের স্কুলে চলে যান। স্কুলে তাঁর রেজাল্ট ভালো ছিল বটে তবে তেমন অসাধারণ ছিল না। হকিংয়ের বাবা মা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তার পুত্র প্রখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াশুনা করুক, এটা ছিলো বৃটেনের প্রধান পাবলিক স্কুল। যেহেতু তাঁর বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা, তাই সেই স্কুলে ভর্তি হতে হলে হকিংকে স্কলারশীপ পেতে হবে, নয়তো সেই স্কুলে পড়ানো সম্ভব হবেনা। কিন্তু ১৩ বছর বয়সী হকিং স্কলারশীপ পরীক্ষার দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে তাঁকে সেন্ট অ্যালবান্স স্কুলেই থাকতে হয়।

অবশ্য এর একটি ইতিবাচক দিক ছিল হকিং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথেই রয়ে যান। তিনি বোর্ড গেম খেলতেন, আতশবাজি বানাতেন, উড়োজাহাজ ও নৌকার মডেলও তৈরি করতেন, এবং খ্রিস্টান ধর্ম ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অনুভূতি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতেন।

স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে গণিত শিক্ষক ডিকরান তাহতার অনুপ্রেরণার কথা তিনি পরবর্তী জীবনে স্মরণ করেন।১৯৫৮ সাল থেকে শিক্ষক তাহতার সাহায্যে তাঁরা ঘড়ির অংশবিশেষ, পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড, ও অন্যান্য রিসাইকেল করার উপাদান দিয়ে কম্পিউটার তৈরি করেন। তিনি গণিত শিক্ষক তাহতার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তাঁর মতো ডাক্তার হন, কারণ গণিতে স্নাতকদের জন্য খুব বেশি চাকরির সুযোগ ছিল না। এছাড়া তাঁর নিজের কলেজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর শিক্ষক তাঁকে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ১৯৫৯ সালের মার্চে পরীক্ষা দিয়ে স্কলারশীপ পান। সে সময়ে তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা, এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

১৯৫৯ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার স্নাতক লেখাপড়া শুরু করেন।তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ “হাস্যকর রকমের সহজ” মনে হতো।তার পদার্থবিদ্যার শিক্ষক রবার্ট বারম্যান পরে বলেন, “তাঁর জন্য শুধু জানা দরকার ছিল কিছু করা যাবে, এবং তিনি নিজেই অন্যরা কীভাবে করছে তা না দেখেই করতে পারতেন।” বারম্যানের মতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয় এবং তিনি “অন্য ছেলেদের মত” হওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি নিজেকে জনপ্রিয়, স্বতঃস্ফুর্ত, ও বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে গড়ে তুলেন এবং ধ্রুপদী সঙ্গীত ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আগ্রহ বোধ করেন। তাঁর এই পরিবর্তনের কারন ছিল কলেজের বোট ক্লাব। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বোট ক্লাবে, যোগ দিয়ে হকিং তার নিজের মধ্যে সাহসী প্রতিমূর্তি গড়ে তুলেছেন, এবং তার দলকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিতেন।

কেমব্রিজে আসার পরপরই হকিং মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হন। এ কারণে তার প্রায় সকল মাংসপেশি ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে। কেমব্রিজে প্রথম দুই বছর তার কাজ তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু, রোগের প্রকোপ কিছুটা থামলে, হকিং তার সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামার সাহায্য নিয়ে পিএইচডি করতে এগিয়ে যান।

তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০ এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ এর দশকে হকিং প্রথম তাদের (পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত) তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তগুলি পূরণ করে। আগে যেমনটি ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকোনো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে। ১৯৭৪ সালে হকিং রয়্যাল সোসাইটির অন্যতম কনিষ্ঠ ফেলো নির্বাচিত হন।

কেমব্রিজে হকিং যখন স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন জেন ওয়াইল্ডের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেন ছিলেন তার বোনের বান্ধবী। ১৯৬৩ সালে হকিংয়ের মোটর নিউরন রোগের চিকিৎসার আগে জেনের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে তাদের বাগদান সম্পন্ন হয়।হকিং পরবর্তীতে বলেন এই বাগদান তাকে “বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা” যুগিয়েছিলো। ১৯৬৫ সালের ১৪ই জুলাই তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের প্রথম বছরে জেন লন্ডনে বসবাস করতেন এবং তাঁর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা কনফারেন্স ও পদার্থবিজ্ঞান-বিষয়ক কাজের জন্য কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ফলিত গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কাছাকাছি জায়গায় বাড়ি খুঁজে পেতে তাঁদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। জেন পিএইচডি শুরু করেন। তাদের পুত্র রবার্ট ১৯৬৭ সালের মে মাসে, এবং কন্যা লুসি ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করে। তৃতীয় সন্তান টিমোথি ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে জন্মগ্রহণ করে।

১৯৮৫ সালে সুইজারল্যান্ডের ‘সার্নে’ ট্রিপে গিয়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। এক পর্যায়ে চিকিৎসকরা নিরাশ হয়ে তার ভেন্টিলেটর সরাতে চাইলে জেন বাধা দেন এবং এয়ার আ্যাম্বুলেন্সে করে কেমব্রিজের আদেনব্রুক হাসপাতালে ভর্তি করেন। শেষ পর্যন্ত তারা শ্বাসনালীতে অপারেশন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।এই অপারেশনের পর তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়।

ওয়াল্ট ওলটম, ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ তাঁর এই অবস্থা শুনে, একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তাঁর জন্য, যার নাম ইকুয়ালাইজার।পরে তিনি আরেকটি প্রোগ্রাম পাঠান, সেটার নাম ওয়ার্ডস প্লাস। এই প্রোগ্রামটি তাঁর চশমায় বসানো ছোট্ট একটি সেন্সর দিয়ে নিয়ন্ত্রন করতেন। সেন্সরটি তাঁর গালের ওঠা নামায় সাড়া দিতো। তিনি কি বলতে চান সেটা ঠিক করতে পারলেই সেটা স্পিচ সিন্থেজাইজারে পাঠিয়ে দিতেন। এই পদ্ধতি ব্যাবহার করে তিনি সাতটি বই এবং অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছেন। আবার বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ও জনপ্রিয় ধারার বক্তৃতাও দিয়েছেন।

হাসপাতাল থেকে বাইরে আসার পর তাঁর সব সময়ের জন্য নার্সিং দরকার হওয়ায় নার্স রাখা হলো। এদিকে তাঁর স্ত্রী জেন, জোনাথানের প্রেমে পড়ায় তিনি ১৯৯০ সালে তাঁর এক নার্স এলেন ম্যাসনকে নিয়ে একটি আলাদা ফ্ল্যাটে উঠে যান। ১৯৯৫ সালে তিনি এলেনকে বিয়ে করলেন। এর ঠিক নয় মাস পর জেনও বিয়ে করলো জোনাথনকে। ২০০৭ সালে এলেনের সাথে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদের পরে এক হাউসকিপারের সাথে তিনি একাই থাকতেন।

হকিং ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ক্যামব্রিজে তাঁর বাড়িতে মারা যান। তার সন্তানরা তাদের দুঃখ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেয়। তাঁর মৃত্যুতে গনভিল অ্যান্ড কাইয়ুস কলেজের পতাকা অর্ধ-নমিত রাখা হয় এবং সেখানকার শিক্ষার্থী ও অতিথিরা শোক বইয়ে সাক্ষর করেন। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩১শে মার্চ ক্যামব্রিজের গ্রেট সেন্ট ম্যারিস গির্জায়।শেষকৃত্যের অতিথি হিসেবে ছিলেন এডি রেডমেইন, ফেলিসিটি জোন্স ও কুইন ব্যান্ডের গিটারবাদক ব্রায়ান মে। তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার পর ২০১৮ সালের ১৫ই জুন ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে আইজ্যাক নিউটনের সমাধির পাশে ও চার্লস ডারউইনের সমাধি সংলগ্ন অংশে তার ভস্ম পুঁতে ফেলা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। প্রয়াত শিল্পী আয়ান ওয়াল্টার এটি তৈরি করেন। ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে। মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরে বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রেখেছে। এছাড়া তিনি তার কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রচুর পদক ও পুরস্কার অর্জন করেছেন।

দীর্ঘ ৫৬ বছর শুধু মানষিক শক্তির জোরে জীবনের সব অসম্ভব আর অনিশ্চয়তার সূত্র একে একে অগ্রাহ্য করেছেন হকিং। অগ্রাহ্য করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের রেকর্ডও। এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজির এক অধ্যাপকের মত হচ্ছে, হকিং যেভাবে তার শারিরীক অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন, তাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তাঁর অবদান বাদ দিলেও তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।

আইন্স্টাইনের পরে এখন তাঁকেই বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও প্রভাবশালী বিজ্ঞানী হিসাবে ধরা হয়। তিনি নিশ্চলভাবে হুইলচেয়ারে বসে থেকেই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা ৩০ বছর গণিতের শিক্ষকতা করে পরিণত হয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম ২৩৭ সপ্তাহ বেস্টসেলার তালিকায় ছিলো।

*তথ্য ঋন গ্রন্থ — মাই ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, লেখক — স্টিফেন হকিং আত্মস্মৃতি ভাষান্তর — আবুল বাসার উইকিপিডিয়া