ইউজিনিয়া মারিয়া গ্রসুপোভাই ওরফে রাণী তারা দেবী সাহিবা, Stay Curioussis

ঘটনাটি ঘটেছিলো একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের চোখের সামনে। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস। শীতের দিন। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পরে নভেম্বর মাস থেকে দিল্লির মেইডেন্স হোটেলে বসবাস করছিলেন এক বিদেশী রমণী। সেখানকারই একজনের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিদিন সকালে নিজের কুকুরগুলোকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন তিনি।

হঠাৎ কি যে হলো তার! নয় ডিসেম্বর শীতের সকালে পৃথিবীর মায়া তাকে আর ধরে রাখতে পারে নি। নিজের হোটেল থেকে বের হয়ে একটি ট্যাক্সি ডাকলেন এবং চলে গেলেন কুতুব মিনারে। হয়তো অনেকদিন ধরেই ভেবে রেখেছিলেন। কুতুব মিনার যেহেতু শহরের সবচেয়ে উঁচু মিনার, তাই সেখান থেকে পড়লে তাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তিনি গাড়িতে উঠলেন। ট্যাক্সি এসে থামলো কুতুব মিনারের সামনে। তার সাথে থাকা হ্যান্ডব্যাগটি ড্রাইভারের কাছে দিয়ে কুকুরগুলোকে নিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন মিনারের দিকে। ড্রাইভারটি ভেবেছিলেন, যেহেতু ব্যাগ রেখে গিয়েছেন, তিনি অবশ্যই ফিরে আসবেন। কিন্তু হঠাৎ-ই ড্রাইভার দেখলেন, মিনারের চূড়ায় পৌঁছে গেছেন সেই বিদেশিনী। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়েই নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন শূন্যের দিকে। সুউচ্চ কুতুব মিনার থেকে ঝাঁপ দিলেন অনন্তের পথে।

পরের দিন খবরের কাগজে বিরাট আর্টিকেল ছাপা হলো তার সম্পর্কে। সবাই জানতে চাইলো, এই অসাধারণ সুন্দরী হতভাগা নারীর পরিচয়। তার পরিচয় খুঁজে পাওয়া গেলো তার হ্যান্ডব্যাগ থেকেই। তিনি আর কেউ নন, রাণী তারা দেবী, ৬৭ বছর বয়স্ক মহারাজ জগৎজিৎ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী। আসল নাম ইউজিনিয়া মারিয়া গ্রসুপোভাই। পোস্টমর্টেম করে দিল্লির কাশ্মীরী গেইটের পাশে সেইন্ট জেমস চার্চের কবরস্থানে সমাহিত করা হলো মাত্র ৩৩ বছর বয়সী প্রাক্তন রাণীকে।

 জগৎজিৎ, Stay Curioussis

মহারাজা জগৎজিৎ সিংহ

কাপুরথালার বৃদ্ধ মহারাজা জগৎজিৎ সিংহের ষষ্ঠ স্ত্রী ছিলেন ইউজিনিয়া। তিনি চেক প্রজাতন্ত্রের একজন বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী। জগৎজিৎ সিংহের সাথে বিয়ের পর তার নাম বদলে রাখা হয় রাণী তারা দেবী সাহিবা। তিনি একবার তার অভিভাবক ড. পিস্টলকে জানিয়েছিলেন, ভারতে তার আর ভালো লাগছে না, তিনি আমেরিকা চলে যেতে চান।

ইউজিনিয়া মারিয়া বনেদি পরিবারের এক অবৈধ সন্তান ছিলেন। চার বছর বয়স থেকে বিশ বছর অবধি ড. পিস্টলই তার অভিভাবকের দায়িত্বে ছিলেন। তবে ইচ্ছা থাকলেও এ জীবনে তার আর আমেরিকায় যাওয়া হয় নি। তার আগেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছে ভারতের মাটিতে।

অসংখ্য বিদেশিনী ভারতবর্ষে এসে সুখের সংসার গড়েছিলেন। আবার অনেকে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন নি বলে অকালেই চলে গিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। লম্বা কেশ, মায়াময় চোখ ও দীর্ঘাঙ্গিনী ইউজিনিয়াও ছিলেন তাদেরই একজন।

অসাধারণ সুন্দর ছিলেন তিনি। তার জন্ম ১৯১৪ সালে। একটি নাটকে তার সৌন্দর্য ও অসাধারণ অভিনয় দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তখনই তাকে একটি গোলাপ ফুলের বুকে পাঠিয়ে দিলেন কাপুরথালার মহারাজা। রাজা তাকে ভারতে আসার জন্যও অনুরোধ করলেন। কিন্তু তার আগেই ড্রামা-কোম্পানির সাথে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলেন তিনি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাজার সাথে যেতে পারছিলেন না ইউজিনিয়া। শেষমেষ রাজা ঐ কোম্পানিকে বিশ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাকে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন। ইউজিনিয়ার সাথে তার মা এবং কাজের লোকও এসেছিলেন।

প্রথমে রাজা তাকে শুধুমাত্র অতিথি হিসেবেই রাখেন। ৬৭ বছর বয়স্ক রাজা প্রতিনিয়ত নানা রকম উপহার দিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করেন ২৬ বছর বয়সী ইউজিনিয়াকে। তারপর এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের শুরু হয়। তিনি রাজার ষষ্ঠ স্ত্রীর মর্যাদা পান। কিছু দিন সংসার করার পর তার আর মন বসছিলো না। বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন এই সাংসারিক জীবনে। তার উপর সন্দেহজনকভাবে মারা যান ইউজিনিয়ার মা। সমস্ত কিছু মিলিয়ে তার মনের মধ্যে হয়তো চরম হতাশা দানা বাঁধছিলো। হয়তো সেই হতাশা থেকেই বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। কে জানে!

Eugenie Grosup, Stay Curioussis

রাণী তারা দেবী সাহিবা

না জানি আরও কতোশত অপ্রকাশিত ঘটনা লুকিয়ে আছে আমাদের এই উপমহাদেশের ইতিহাসে! এক সময় অদ্ভুত সুন্দরী ইউজিনিয়ার অভিনয়, তার নৃত্য মুগ্ধ করেছিলো সবাইকে। পত্রিকার কলামে ভূয়সী প্রশংসা হয়েছিলো তার। বার্গ থিয়েটারের সেই রূপসী হতে পারতেন কোনো নাম করা অভিনেত্রী। কিন্তু তা হয়নি। অকালে মৃত্যুবরণ করলেন তিনি।

ইউজিনিয়ার মৃত্যুও সন্দেহের উর্ধ্বে ছিলো না। তার অভিভাবকরাও এমনটাই মনে করেন। ১৫০ হাজার ডলারের সম্পদ ছিলো তার। এক হাজার ডলারের তো শুধু গহনাই ছিলো। মৃত্যুর আগে নাকি তিনি বার বার বলেছিলেন যে, কেউ একজন তাকে অনুসরণ করে। তিনি ভীতিগ্রস্ত ছিলেন। কে জানে কি হয়েছিলো তার সাথে!

তার অভিভাবক ডক্টর পিস্টল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মামলাও করেছিলেন। সেই মামলা চলেছিলো পাঁচ বছর। তবে রাজার মৃত্যুর পর মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। তাই ইউজিনিয়ার মৃত্যু-রহস্যের কুল-কিনারা আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।

Hrob Eugenie Grosup, Stay Curioussis

দিল্লির নিকলসন কবরস্থানে রাণী তারা দেবী সাহিবা কবর

আজ খুব সাধারণভাবেই এই উপমহাদেশের একটি কবরে শুয়ে আছেন তিনি। রাণীদের সমাধির মতো বিশেষ কোনো স্তম্ভ বা আয়োজনও নেই সেখানে। অচেনা ভূমিতে স্বজনবিহীন এক বিদেশিনী রাণী ঘুমিয়ে আছেন। হয়তো এক বুক কষ্ট নিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি, অবহেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন স্মৃতির অতলে।

রেফারেন্স: