চীনে আজ এক উৎসবমুখর পরিবেশ। সম্রাটের দরবারে তো চলছে বিশেষ আয়োজন। নাচ-গান, বাদ্য-বাজনায় গম গম করছে চারপাশ। হবেই বা না কেনো? চীনের সম্রাট ঝু-ডি ইয়ংলে তার মহিমা প্রমাণ করেছে। নিঃসন্দেহে মহান এই সম্রাট, তা না হলে এমন অমূল্য উপহার তিনি পেলেন কি করে? এমন অদ্ভূত প্রাণী তো এর আগে কখনোই দেখে নি চীনবাসী। এ তো সাক্ষাৎ কিলিন, এক পবিত্র দেবসম পশু। সুদূর বাংলা থেকে এমন অমূল্য উপহার তো এমনি এমনি এখানে আসে নি। এ নিশ্চয়ই সম্ভব হয়েছে সম্রাটের অপার মাহাত্ম্যের কারণে। পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে মহান সম্রাট এবং কিলিনের সামনে নতজানু হয়েছে আজ সমগ্র চীন। এক অদ্ভূত ও অনন্য প্রাপ্তিই সম্রাটকে করে তুলেছে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আর এই ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি অঞ্চল, বাংলা, হ্যাঁ আমাদেরই এই বাংলা।

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের সাথে বহিঃর্বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য আমরা জেনেছি। তবে এই বাণিজ্য যখন থেকে নৌবাণিজ্যের রূপ নিয়েছে, তখন থেকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। হাজার হাজার বিশাল জাহাজ ভিড় করতো পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে ব্যবসার জন্য। আর ব্যবসায়ীদের জন্য ভারতবর্ষ কোনো স্বর্গের চেয়ে কম ছিলো না। বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে বন্দরে বন্দরে গড়ে উঠেছিলো বিশাল বাজার। বাংলা এতো সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিলো যে, তার কখনো আমদানি করবার প্রয়োজনই পড়ে নি। একটা সময় পর্যন্ত বাংলায় শুধু হতো রপ্তানি। আর বাংলার বহুমূল্যবান পণ্যের বিনিময়ে বিদেশী অর্থের প্রাপ্তি ক্রমেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছিলো বাংলাকে। সমৃদ্ধ বাংলা হয়ে উঠছিলো আরও বহুগুণ সমৃদ্ধ।

চীনের মুসলিম পর্যটক মা-হুয়ান

বর্তমানের অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীনও এক সময় সর্বকালের সবচেয়ে বড় জাহাজ নিয়ে ভিড় করেছিলো বাংলার সমুদ্র বন্দরে। ১৫ শতকের সেই সময় চীনের একজন মুসলমান খোঁজা অ্যাডমিরালের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিলো সাতটি সমুদ্র অভিযান। অ্যাডমিরালের নাম ছিলো ঝেং-হে। তিনি ছিলেন একজন সফল অ্যাডমিরাল। চীনের আরেকজন মুসলমান অনুবাদক ও লেখক মা-হুয়ান, যাকে চতুর্থ অভিযানে নিয়োগ করা হয়েছিলো, তিনিই মূলত লিখে গিয়েছেন সমুদ্র অভিযান ও নৌবাণিজ্যের বিশদ বর্ণনা। সেই সাথে তিনি লিখে গিয়েছেন বাংলার বিবরণী। সেই বিবরণী যে কতোটা মনোমুগ্ধকর, তা মা-হুয়ানের লেখা না পড়লে বোঝা যাবে না। তা ছাড়া চীনাদের কাছে বাংলা ‘বুদ্ধের ভূমি’ হিসেবে পরিচিত ছিলো, আর এ কারণেও এই অঞ্চলের প্রতি তাদের আগ্রহ ছিলো অনেক বেশি।

অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌ-অভিযান

বাংলায় চীনের জাহাজ এসেছিলো, কিন্তু অ্যাডমিরাল ঝেং-হে বাংলায় এসেছিলেন কিনা তা সঠিকভাবে জানা যায় নি। কিন্তু নিঃসন্দেহে মা-হুয়ান এসেছিলেন আমাদের এই সমৃদ্ধ অঞ্চলে। শুধু মা-হুয়ানই নন, আরও অনেক চীনা পর্যটকের লেখায় ফুটে উঠেছে ১৫ শতকের বাংলার ছবি। মা-হুয়ানদের লেখা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, সেই মধ্য যুগে বাংলায় ছিলো মুসলমানদের আধিপত্য।

মা-হুয়ান চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন ১৪০৬ সালে। বাংলার সুলতান তখন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ। বাংলায় আসবার পর থেকে মা-হুয়ানের মুগ্ধতা ও বিস্ময় কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। বাংলার রাস্তাঘাট, ব্যস্ত বাজার, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার, ক্ষেত, ফসল, গাছপালা, ফুল-ফল, খাল-বিল, মাছ, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, শিল্প, জীবনাচরণ, বিনোদনের মাধ্যম, বিলাসিতা, আপ্যায়ন সমস্তই নজর কেড়েছিলো তার। তার লেখায় বাংলার নারীদের অভাবনীয় রূপ-সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিলো। মা-হুয়ান লিখেছিলেন বাংলার ধন-রত্ন ও সম্পদের প্রাচুর্যের কথাও।

সম্রাট ইয়ংলে

তিন দফায় বাংলার সুলতানের পক্ষ থেকে চীনের মিং সম্রাট ঝু-ডি ইয়ংলের দরবারে উপহার পাঠানো হয়েছে। না ধন-রত্ন নয়, পাঠানো হতো দুর্লভ কিছু জিনিস। সুলতান জানতেন চীনা সম্রাটের কৌতুহলের কথা। তাই তার সংগ্রহের জন্য উপহারস্বরূপ বিভিন্ন অদ্ভূত পশুপাখি পাঠাতেন সুলতান। বিশাল বিশাল জাহাজভর্তি সুলতানের শুভেচ্ছা পৌঁছে যেতো চীনা সম্রাটের দরবারে।

১৪১৪ সাল। বাংলার সুলতান তখন শিহাবুদ্দীন আজম শাহ। এইবার সম্রাটের জন্য পাঠানো হলো অসাধারণ কিছু উপহার। খাল-বিলের আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে ধরা হলো অজস্র মাছরাঙা পাখি। বাক্স ভর্তি করা হলো মাছরাঙা পাখির রঙিন পালক দিয়ে। সেই বাক্স, অনেক উন্নত জাতের একটি তেজী ঘোড়া এবং একটি আফ্রিকান জিরাফ নিয়ে এইবার চীনের জাহাজ চললো সম্রাটের দরবারে। যদিও বলা হয়, সুলতান শিহাবুদ্দীনের পক্ষ থেকে এই উপহারগুলো পাঠানো হয়েছিলো, তবে অনেকে এ-ও বলেন, ১৪১২ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন মারা যাবার পর তার আরেক ছেলে সাইফুদ্দীন আজম শাহ জিরাফসমেত সেই উপহারগুলো চীনের সম্রাটকে পাঠিয়েছিলেন।

বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ

সুলতানের কাছ থেকে পাওয়া উপহার আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ উপহার হলেও চীন ও চীনের সম্রাটের কাছে সেগুলো ছিলো স্বর্গতুল্য, বিশেষ করে সেই আফ্রিকান জিরাফটি। চীনের জনগণ আগে কখনও এমন প্রাণী দেখে নি। তবে চীনা পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, এক সময় এই দেশে আসবে এক স্বর্গীয় প্রাণী, যার পায়ের স্পর্শে দেশ হবে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ। পুরাণে সেই প্রাণীটির নাম দেয়া হয় ‘চিলিন’ বা ‘কিলিন’।

তৃণভোজী জিরাফটির শান্ত ও মধুর স্বভাব, ছন্দোময় গতি এবং অপরূপ সৌন্দর্য চীনা জনগণের হৃদয়ে সৃষ্টি করলো এক অদ্ভূত বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলো এই প্রাণীই স্বর্গীয় কিলিন। সেই সাথে তারা স্থাপন করলো সম্রাটের প্রতি অগাধ আস্থা, কেননা সম্রাট মহান না হলে এই সময় চীনের ভূমিতে কিলিনের আবির্ভাব সম্ভব হতো না। তাই সম্রাটের তথাকথিত ঐশ্বরিক শক্তিকে পুঁজি করে শুরু হলো চীনা জনগণের নতুন জীবন।

তবে আসল ঘটনা হলো, সুলতানের পাঠানো প্রাণীটি ছিলো নিতন্তই সাধারণ এক জিরাফ, যেটিকে সুলতান কোনোভাবে আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, নৌবাণিজ্যের মাধ্যমেই কোনো আফ্রিকান বণিকের কাছ থেকেই এই জিরাফের সন্ধান পেয়েছিলেন বাংলার সুলতান।

সেই আফ্রিকান জিরাফটি কিন্তু হয়ে উঠেছিলো মিং সম্রাটেরও চোখের মণি। জানা যায়, তার সবচেয়ে পছন্দনীয় প্রাণী হয়ে উঠেছিলো সেটি। হবেই বা না কেনো, এটি কিলিন হোক বা না হোক, মূলত এর আবির্ভাবই তো সম্রাটের প্রতি সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। সম্রাটের প্রিয় চিত্রকর শেন-দু রেশমি কাপড়ে জিরাফটির একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটির নাম দেয়া হয়, ‘বেঙ্গালা জিন চিলিন তু’, অর্থাৎ ‘বাংলার জিরাফ উপহার’। পরবর্তীকালে আরেকজন চিত্রকর শেন-ঝাং এই ছবিটির একটি কপি করে রেখেছিলেন। বর্তমানে তা চীনের জাদুঘরে রাখা আছে।

‘চিলিন’ বা ‘কিলিন’

কিলিন তথা আফ্রিকান জিরাফের কাহিনীটি চীনের ইতিহাসে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, ততোটা বাংলার ইতিহাসেও। এই ঘটনা এক সমৃদ্ধ বাংলার সাথে বর্তমানের শক্তিশালী বহিঃর্বিশ্বের যোগসূত্রের দলিল। আমাদের ইতিহাস লিখে রাখার অভ্যাস ছিলো না, আর তাই নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যকে জানবার বা বুঝবার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠে নি। কিন্তু এটি সে সময়ের গল্প, যখন বাংলা ছিলো চীনের চেয়েও সমৃদ্ধ। আর কিলিনের গল্প একটি মিথ হলেও চীনের জন্য কিন্তু এই বিশ্বাসই সে সময় তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তিলে তিলে তাদের পৌঁছে দিয়েছে অসীম উচ্চতায়, পরিণত করেছে অন্যতম ক্ষমতাধর জাতিতে।

রেফারেন্সঃ

 

মীরাবাঈ, লেডি ম্যাকবেথ, বিনোদিনীর রুপে মঞ্চ মাতিয়ে রাখা তিনকড়ি দাসী

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বড়লোক বাবুর রক্ষিতা হতে হয়েছিল তাকে। আর সেই রক্ষিতার পুরস্কার হিসেবেই পেয়েছিলেন তিন তিনটে বাড়ি। তিনটি বাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তা নিজের করে ধরে রাখার কোন ইচ্ছে ছিল না তার। বাড়ি তিনটির একটি তার রক্ষক বাবুর ছেলেকে এবং বাকি দুটো মৃত্যুর আগে...

নারীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সৃষ্টির শুরুর ইতিহাসের সাথে পরবর্তী ইতিহাসের সংঘাত

প্রত্যেক সময়ের প্রেক্ষাপটেই দেখতে পাওয়া যায়, নারীর ওপর সমাজ কতোগুলো বিধি-নিষেধ আরোপ করে থাকে। তাদের চলা-ফেরা, বাক-স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমস্ত কিছুর উপর প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে সমাজ। তবে এতো বাধা-বিপত্তির পরও প্রতিটি যুগে অসংখ্য নারী...

তিন সম্রাটের শাসনের প্রত্যক্ষদর্শী মুঘল রাজকন্যা গুলবদন বানু বেগম

“ইতিহাসের বই দিয়ে ব্যক্তিত্ব বিচার করলে এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পুরুষরাই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক চরিত্র ছিলেন। অন্তত মনে রাখার মতো কোনো চরিত্র যদি থেকে থাকে, তবে পুরুষরাই সবার সামনে চলে আসেন। অবশ্যই এটি একটি অসত্য বিষয়। কিন্তু আমরা এই অসত্য বিষয়টিকেই...

আমার চোখে ‘বড় আপা’, অগ্রণী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুর

ছেলেবেলা থেকে আমার গড়ে উঠবার প্রতিটি ধাপে আমার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে, আমার অনুধাবন ও উপলব্ধিকে গঠনমূলক রূপ প্রদানের ক্ষেত্রে এবং আমার স্বশিক্ষাকে পরিপূর্ণ করবার ক্ষেত্রে বেশ ক’জন ব্যক্তির অবদান রয়েছে। এই তালিকায় অবশ্যই আমার মা, বাবা, খালাসহ পরিবারের...

বিস্মৃতপ্রায় অযোধ্যার রাজমাতা: মালিকা কিশোয়ার

লখনৌ এর বিশাল রাজবাড়ি। অন্দরমহল থেকে ছুটে আসছেন অযোধ্যার রাজমাতা। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট; পা খালি, জুতো ছাড়াই ছুটে আসছেন তিনি; গা থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে চাদর। রাজমাতার এমন অবস্থা দেখে পেছন পেছন ছুটছেন দাসীরা। কি হলো রাজমাতার! নিজের কামরা থেকে কদাচিৎ বের...

মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি মুসলিম পরিবারে সম্পদ বন্টন এবং উত্তরাধিকার আইনের প্রয়োগ

সম্পদের সাথে ক্ষমতার একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যে কোনো দেশের মতোই বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীর ক্ষমতাহীনতার বিভিন্ন কারণের মাঝে সম্পদহীনতা একটি অন্যতম কারণ। যে কোনো সমাজে সম্পদের মালিকানা দুইভাবে সৃষ্টি হয়-সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে এবং উত্তরাধিকার...