জুলাই, ১৬৪৮ সালে ঐতিহাসিক ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে সুইডিশ আর্মি চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহর ব্যাপকভাবে লুট করে নেয়। অনেক মূল্যবান সামগ্রীর পাশাপাশি ছিনিয়ে নেয়া হয় চেক প্রজাতন্ত্রের অনেক ঐতিহাসিক দলিল। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বে এমনই এক পান্ডুলিপি চলে যায় সুইডিশদের হাতে। ৩১০ পৃষ্ঠার গাধার চামড়ায় তৈরি এই বইয়ের নাম ছিল কোডাক্স গিগাস। অন্য নাম শয়তানের বাইবেল। সুইসরা এই রহস্যময় পাণ্ডুলিপি নিজেদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে রেখে দেয়। সুইস গবেষকরা এর উপর জেঁকে বসেন৷ সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, বেরিয়ে আসে রোমাঞ্চকর এক ইতিহাস। ২০০৭ সালে এই পাণ্ডুলিপি প্রাগ শহরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।
রহস্যময় বই কোডাক্স গিগাস
কোডাক্স গিগাস ল্যাটিন এ নামের বাংলা বিশাল বই৷ ৩১০ পৃষ্ঠার এই বই গাধা কিংবা বাছুরের চামড়া দিয়ে বানানো। বইটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ প্রায় ২০ ইঞ্চি। ১৬৫ পাউণ্ড ভারি এই পান্ডুলিপি প্রায় ৮.৭ ইঞ্চি মোটা। ওজনে ভারী হওয়া এই বই বহন করা দুঃসাধ্য৷ বইটির শেষ ৫২ পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণা করে জানিয়েছেন এই পৃষ্ঠাগুলো হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ছিড়ে ফেলা হতে পারে। মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় পান্ডুলিপির এই বই মোটামুটি বিশ্বকোষ ধাঁচে লেখা হয়েছিল এবং ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে এই বইয়ের লেখক একজনই। কিন্তু মধ্যযুগের এই বিশাল বইকে কেন শয়তানের বই বলা হয়? এর কারণ খুঁজতে হলে আমাদের এক লোককাহিনী তে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু একে লোককাহিনী না বলে পৌরাণিক কাহিনী বলা যেতে পারে কারণ এর সত্যতা বের করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের রাজা বেনেডিক্ট পোডলাজাইসের আশ্রমে হারম্যাইন নামের একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। তেরো শতকের প্রথম দিককার ঘটনা৷ হঠাৎ একদিন সন্ন্যাসী হারম্যাইন খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেন। আশ্রমের পরিবেশ নষ্ট করার অপরাধে রাজা হারম্যাইনকে এক বদ্ধ কুঠুরিতে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দিলেন। শুরু হয় হারম্যাইনের অসহনীয় দুর্ভোগ, পেরে উঠলেন না তিনি। একদিন আশ্রমের গুরুর কাছে শাস্তি কমানোর আর্জি পেশ করেন হারম্যাইন। সদয় আশ্রম গুরু রাজার অনুমতি নিয়ে তার শাস্তি কমানোয় রাজি হন৷ কিন্তু তার জন্য বেঁধে দেন একটি শর্ত৷ হারম্যাইনকে এমন একটি বই লিখতে হবে যেখানে মানুষের কল্যাণের সবকিছু প্রোথিত থাকবে। যা পাঠ করলে দেশ ও মানুষের মঙ্গল হবে।
এমন একটি বই লিখতে পারলেই তবে হারম্যাইন মুক্তি পাবেন। রাজা এও শর্ত জুড়ে দেন এই বই শেষ করার জন্য হারম্যাইন পাবেন মাত্র এক রাত। নিরুপায় হারম্যাইন রাজি হন অবশেষে। শুরু হয় বাইবেল লেখা। কিন্তু বিধি বাম। রাত পেরিয়ে যায় কিন্ত অর্ধ পৃষ্ঠা ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারলেন না সন্ন্যাসী হারম্যাইন। অনন্যোপায় হয়ে হারম্যাইন ধর্ণা দিলেন স্বয়ং নরকের রাজপুত্র শয়তান লুসিফারের কাছে। আবেদন জানালেন লুসিফার যেন তাকে বইটি শেষ করে দেয়। কিন্তু লুসিফারের আবদার এজন্য হারম্যাইন তার আত্মাকে লুসিফারের তরে সমর্পণ দিতে হবে। চারিদিকে বিপদে পড়া হারম্যাইন তার শর্তে রাজি হোন৷ কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে শেষ হয় বিশাল বই কোডাক্স গিগাস। যাবার আগে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ২৯০ তম পৃষ্ঠায় লুসিফার তার ছবি একেঁ দিয়ে যায়। আর এভাবেই হারম্যাইন নিজের আত্মা বন্ধকের বিনিময়ে লিখেন মধ্যযুগের সবচেয়ে বিশাল বই কোডাক্স গিগাস বা শয়তানের বাইবেল। বইটি ১৪৭৭-১৫৯৩ পর্যন্ত ব্রোমভ মনাষ্টরিতে ছিল। বইটির প্রতি ভালবাসা দেখে সম্মানস্বরুপ প্রাগের সন্ন্যাসীরা প্রাগ সম্রাট রুডলফ কে বইটি উপহার দিয়ে দেন। রহস্যময় এই বইতে দুটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল৷ একটি নরকের রাজপুত্র শয়তান লুসিফার এবং অন্যটি জনমানবশূন্য স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম। ২০০৭ সালে সুইডেন থেকে চেক প্রজাতন্ত্রে নিয়ে আসা হয় এই পান্ডুলিপি। কিছুদিন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হলেও পরে এই সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইতিহাস ও রহস্যপ্রেমীদের কাছে চিরকাল এই শয়তানের বাইবেল রোমাঞ্চকর। এই বইকে জড়িয়ে যে গল্প প্রচলিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে তার কোন ভিত্তি না থাকলেও রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরা এই কাহিনী মধ্যযুগীয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পান্ডুলিপির এই বইয়ের তুমুল আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে।
তথ্যসূত্র
Codex Gigas, also known as The Devil’s Bible is the largest medieval manuscript in the world
10 THINGS YOU SHOULD KNOW ABOUT THE DEVIL’S BIBLE (OR CODEX GIGAS)