যখন আমরা জাগজিৎ, গুলাম আলী, মেহেদী হাসানের গজল শুনি, মনটা ভরে যায়।গজলের কথা আর তাঁদের গলার কারুকাজ আমাদের আচ্ছন্ন করে। কখনো কি ভেবেছি কে লিখলো এত সুন্দর পংক্তিগুলি আর কিভাবেই বা এই শ্রুতিমধুর গজলগুলি আমাদের কাছে এসে পৌঁছালো? গজল, যা আমাদের মনকে দারুনভাবে আলোড়িত করে আর মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে বাহ্ শব্দটি! জেনে নেই গজল কি, এবং সেইসব মহান রচয়ীতাদের নাম যাঁদের কল্যানে এখন এগুলি আমরা প্রানভরে উপভোগ করছি—

গজল অত্যন্ত বিস্তৃত একটি কাব্য ও সঙ্গীতের ধারা। গজলে যেমন রয়েছে খোদার প্রেমের স্তুতি, আবার তেমনই রয়েছে মানব-মানবীর প্রেমের স্তুতিও। শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে, ‘প্রেমিকার সাথে কথোপকথন’, ‘প্রেমালাপ’ কিংবা ‘রমণীর সঙ্গে বাক্যালাপ’। তবে শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। উৎপত্তিগতভাবে গজল শব্দটির অন্যতম অর্থ হচ্ছে ‘সুদৃশ্য দ্রুতগামী মৃগবিশেষ’। অর্থাৎ গজলের আবেদনের সাথে মিল পাওয়া যায় হরিণের মায়াবী রূপের আবিষ্টতার।

শিকারী বাঘ তাড়া করছে, ফলে হরিণ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে।  হঠাৎ তার বড় ঝাকড়া শিং আটকে গেলো বুনো ঝোপের কাঁটায়। আসন্ন মৃত্যু নিয়ে তার ভয়, নিজেকে মুক্ত করার যতই চেষ্টা করছে, ততই কাঁটায় জড়িয়ে যাচ্ছে সে, আরও ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তার দেহ। জোরে চিৎকার করতে পারছে না, যদি পেছনে থাকা শিকারী বাঘ তাকে ধরে ফেলে! এমন পরিস্থিতিতে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া হরিণের গুমরে ওঠা আর্তনাদের সাথে যেন মিলে যায় গজলের অভিব্যক্তি।

আরেকটি অর্থ হচ্ছে, ‘কস্তুরী হরিণের আর্তচিৎকার’। কস্তুরী বা মৃগনাভী এমন একটি দুর্লভ জিনিস, যা শত শত বছর পরে হয়ত কোনো এক হরিণের ভাগ্যে আসে। যে হরিণ তার পেটে কস্তুরী ধারণ করে, তার শরীর থেকে তীব্র মাদকতাপূর্ণ ও আবেদনময়ী সুগন্ধ বের হতে থাকে। সারা বনে সেই আকর্ষণীয় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, ঐ কস্তুরী পাওয়ার জন্য হরিণটির পেট চিরে তা বের করতে হবে, তাই কস্তুরীর এই সুগন্ধ হরিণটির জন্য মৃত্যুর মতো। এ সুগন্ধি যেন হরিণটির আর্তচিৎকার হিসেবে অঙ্কিত হয়। গজলও মানুষের হৃদয়ের এই হাহাকার হিসেবে প্রকাশ পায়।

যেমন মির্জা গালিব লিখেছেন—

রুটি যদি নাই জুটে দুঃখ সেঁকে খাব তৃষ্ণায় অসাড় জিহ্বা অশ্রুতে ভেজাব। বন্ধুহীন সেও ভালো শত্রুকে নেবো না মন্দকালই বাহাদুর ভুলেও ভেবো না গালিব এখনও আছে ষোলআনা হুঁশে কবিরাই জেগে থাকে ঘুমায় মানুষে। (অনুবাদ: কবি সৈয়দ শামসুল হক)

কিংবা মীর তকি মীর লিখেছেন—-

বলছ আমার ইচ্ছা স্বাধীন কিন্তু তুমি যা চাও, তা-ই আমাকে দিয়ে করাও অথচ মিছিমিছি দোষী কর আমাকেই।

গজলের ব্যাপ্তিকে তাই যেকোনো এক গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা যায় না। প্রেম থেকে ভক্তি অথবা আর্তবেদনায়ও গজলের সুর বাজে। আদি গজল কিন্তু এদেশি গীতধারা নয়। দশম শতক নাগাদ ইরানে প্রথম এটির খোঁজ পাওয়া যায়। অবশ্য শিকড়টা ইরানেও নয়, ছিলো প্রাচীন আরব্য কাব্যসাহিত্যে। সেখানে ‘কসীদাহ’ নামের একধরনের রাজস্তুতির ধারা প্রচলিত ছিলো। ইরানে এসে কসীদাহ’র বিবর্তন শুরু হয়। কসীদাহ’র তিনটি প্রকার আছে নসীব, রহীল আর বিবিধ শৈলী ।নসীব অংশটিই পরবর্তীকালে গজল নামের একটি আলাদা গীতধারা হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে কাসিদার একটি অংশ থেকে গজলের উৎপত্তি ঘটে। কাসিদা ও গজল এই দুটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে ধরা হয়।

গজল আর কাসিদার পার্থক্য বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে, কাসিদা প্রধানত কারো প্রশংসা বা শোকগাথা। যেমন আমাদের দেশে প্রচলিত মার্সিয়া সংগীত। বিশেষত কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে আমাদের দেশে প্রতিবছর মার্সিয়া সংগীত ও মিছিলের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে গজল হচ্ছে প্রেমালাপ, যা স্রষ্টা, পরমাত্মা কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ঘটে থাকে।

বিশিষ্ট গজল গবেষক জুলি স্কট মাইসামি (১৯৯৮) তার মেডিয়েভাল পারসিয়ান কোর্ট পোয়েট্রি গ্রন্থে বলেছেন, গজল হচ্ছে ভালোবাসা বিষয়ক কবিতা, যা কাসিদা থেকে আলাদা এবং স্বাধীন সংক্ষিপ্ত কাব্য।  অথবা আরেক গবেষক আলেসান্দ্রা বোসানি (১৯৬৫) তার গজল ইন পারসিয়ান লিটারেচার গ্রন্থে লিখেছেন, গজলের বিভিন্ন বিষয়বস্তু রয়েছে। যেমন, প্রেম, বসন্ত ঋতু, শরাব, খোদাতত্ত্ব ইত্যাদি।

উমাইয়া আমলে কবিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এ সময়ে গজল আলাদা কাব্যধারা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি এই ধারণার জন্ম হয় যে গজলের বিষয়বস্তু হচ্ছে বিগত ভালোবাসার জন্য অনুভূতি, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতা। এ ধারাটিতে বিষাদ প্রাধান্য পায় বেশি। প্রেমের কবিতা বা গজল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উমাইয়া খেলাফতের অন্যান্য অঞ্চলে। এতে আবার দুটি ধারা দেখা যায়। প্রথমটি হচ্ছে ‘শহুরে গজল’, এটা মূলত বিনোদনধর্মী গজল। মক্কার উমর ইবনে আবি রাবীয়া এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি। আরেক প্রকার হচ্ছে ‘যাযাবর বেদুঈনদের গজল’। এই ধারার প্রধান কবি হচ্ছেন জামীল। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত প্রেমের উপাখ্যান ‘লাইলি-মজনু’ তার হাতের অমর সৃষ্টি। পরবর্তীতে এই ধারাটিই গজলের শক্তিশালী ধারা হয়ে ওঠে।

উমাইয়া আমলের কবিদের মধ্যে তুভাইস, সাইয়েদ ইবনে মিসজাহ আল গারীদ, ইবনে মুহারী, ইবনে মা’বাদ, জামিল বিন মামর, আব্দ-আল রহমান, উরওয়াহ বিন হিজাম, তাওবাহ বিন আল হুমাইর, উমর বিন আবি রাবি এবং মহিলা কবি জামিলাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সময়ের পরিক্রমায় গজল বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে চর্চিত হলেও, এই বিষয়বস্তু যেন ওতপ্রোতভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এই অনুভূতি, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতার ভাবধারাটি কখনও রোমান্টিক, প্রেমমূলক, অতীন্দ্রিয়, স্বর্গীয় কিংবা খোদার সাথে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে।

আব্বাসীয়দের আমলে কাসিদার চেয়ে গজল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরে গজল আরো বিকশিত হয়। ধীরে ধীরে গজল চর্চা পারস্য অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। একপর্যায়ে গজল পারস্য সাহিত্যের প্রধান সম্পদে পরিণত হয়।

‘পারস্য প্রতিভা’ গ্রন্থে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেছেন—-

“পারস্য সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট অংশ গজল বা গীতি-কবিতা। ইউরোপের গীতি-কবিতার চেয়ে পারস্য গীতি-কবিতার বিশেষ পার্থক্য এই যে, এটা একাধারে গীতি এবং কবিতা। পারস্যের গৌরবের দিনে এ সব গজল ‘বরবত’ নামক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সভায় বসিয়া গাওয়া হইতো।যেদিন নিশীথে চাঁদের আলোতে ভরিয়া যাইত, দক্ষিণ হাওয়ার বিবশ পরশে প্রাণ আবেশে ঢুলু ঢুলু করিত, সেই সকল রজনীতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বা উদ্যানবাটিকায় সাহিত্যিকদের সভা বসিত। আর, চন্দ্র যখন পশ্চিমাকাশে কৃষ্ণ নিবিড়তার ভিতর ঘুমাইয়া পড়িত, তখন পর্যন্ত তাহাদের সেই ‘গোলাবের ইতিহাস’, ‘বুলবুলের প্রণয়কথা’, ‘সুরার মহিমা’, ও ‘প্রেমের মাধুরী’ গীতাকারে চলিতে থাকিত।“

পারস্যে এ সময়ে বড় বড় কবি ও সাধকের আগমন ঘটে। তাদের হাত ধরে গজল শুধুমাত্র প্রভাবশালী ও শক্তিশালী সাহিত্যধারাই তৈরি করে না, বরং একটি আধ্যাত্মিক ধারারও সূত্রপাত ঘটায়। পারস্যে রুদাকি, ফেরদৌসী, আসাদি তুসি, ওমর খৈয়াম, ইমাম গাজ্জালি, হাকিম সানাই, ফরিদউদ্দীন আত্তার, শেখ সাদী সিরাজী, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, হাফিজ সিরাজির মতো বড় বড় কিংবদন্তির জন্ম হয়। তাদের হাত ধরে গজল কাব্য ও সঙ্গীত চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করে।

পরে তাদের প্রভাবে সারা বিশ্বে এই আধ্যাত্মিক প্রেমের সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে। আমির খসরুর হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশেও গজলের আগমন ঘটে। এরপর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, মোহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ্‌, মীর দার্দ, মীর তকি মীর, মির্জা গালিব, দাগ দেহলভী, আল্লামা ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ প্রমুখ প্রভাবশালী কবি ও সাধকগণ গজল চর্চা করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর মতো ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের রচিত অনেক গজলের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় কবি নজরুল ইসলাম অনেকগুলো গজল রচনা করলেও পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে এই প্রবণতা তেমন লক্ষ করা যায়নি।

এসব কবিরা যে শুধু গজলই চর্চা করেছেন, এমনটা নয়। একজন সাহিত্যিক যেমন বিভিন্ন ধারার সাহিত্য চর্চা করে থাকেন, এ গজল সম্রাটগণও তেমনি তাদের অন্যান্য সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গজল চর্চা করেছেন। তবে পারস্যের কবিরা প্রধানত গজলই চর্চা করেছেন। গজলের উৎপত্তিকাল থেকেই গজল কাব্য ও সঙ্গীত হিসেবে কখনো স্বতন্ত্রভাবে, আবার কখনো গীতিকাব্য হিসেবে কবিতা ও সঙ্গীত আকারে চর্চিত হয়ে আসছে। এটি সাধারনত উর্দু ও ফার্সি ভাষায় রচিত এক ধরনের ক্ষুদ্রগীত। আমির খসরু এ গানের স্রষ্টা এবং প্রচারের ক্ষেত্রেও তার অবদান অপরিসীম। তিনি সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজিকে প্রতিরাতে একটি করে গজল শোনাতেন।

এসব কবিরা যে শুধু গজলই চর্চা করেছেন, এমনটা নয়। একজন সাহিত্যিক যেমন বিভিন্ন ধারার সাহিত্য চর্চা করে থাকেন, এ গজল সম্রাটগণও তেমনি তাদের অন্যান্য সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গজল চর্চা করেছেন। তবে পারস্যের কবিরা প্রধানত গজলই চর্চা করেছেন। গজলের উৎপত্তিকাল থেকেই গজল কাব্য ও সঙ্গীত হিসেবে কখনো স্বতন্ত্রভাবে, আবার কখনো গীতিকাব্য হিসেবে কবিতা ও সঙ্গীত আকারে চর্চিত হয়ে আসছে। এটি সাধারনত উর্দু ও ফার্সি ভাষায় রচিত এক ধরনের ক্ষুদ্রগীত। আমির খসরু এ গানের স্রষ্টা এবং প্রচারের ক্ষেত্রেও তার অবদান অপরিসীম। তিনি সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজিকে প্রতিরাতে একটি করে গজল শোনাতেন।

মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের আরেকটা শায়ের দিয়ে শেষ করছি——

হাজারোঁ খাহিশে এ্যয়সে কে হর খাহিশপে দম নিকলে বহত নিকলে মেরে আরমাঁ লেকিন ফিরভি কম নিকলে

হাজারো বাসনা হৃদয়-গভীরে, যার প্রতিটিই প্রাণহরা যদিও মিটেছে অনেক বাসনা, রয়ে গেছে কত অধরা।

#তথ্যসূত্র #বাংলাপিডিয়া #উইকিপিডিয়া