জেরুসালেম, অত্যন্ত প্রাচীন একটি শহর। আব্রাহামীয় ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রধান তিন সম্প্রদায়, খ্রিষ্টান, ইহুদি এবং মুসলমানদের কাছে এ’টি একটি পবিত্র নগর। জেরুসালেম কখনো ছিল না প্রাচুর্য্যময়। কিন্তু এই সম্পদহীন নগরকে কেন্দ্র করেই হয়েছে অসংখ্য বিবাদ-সংঘাত, প্রাণহানি হয়েছে অগণিত মানুষের, একে করায়ত্ত করতে অনেকের জেগেছে অদম্য অযৌক্তিক অভিলাষ। জেরুসালেম দখল-বেদখল হয়েছে বারবার। প্রাচুর্য্যহীন এ নগর সাক্ষী হয়ে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার, যা’র মূল্যায়ন পার্থিব অর্থের পরিমাপে করা অসম্ভব। জেরুসালেমের পবিত্র ভূমিতে জন্মগ্রহণ এবং বিচরণ করেছেন অনেক নবী-সৃষ্টিকর্তার বার্তা-বাহক, প্রচার করেছেন ধর্মের চিরন্তন শাশ্বত বাণী, নির্যাতিত হয়েছেন অনেকে এ মাটিতেই, আবার এখানেই সমাধিস্থ হয়েছেন তাঁদেরই কয়েকজন।

মানব ইতিহাসের নব্য প্রস্তর যুগ পেরিয়ে ব্রোঞ্জ যুগে পদার্পনের সময় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সমৃদ্ধশালী সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সভ্যতা ছিল এশিয়ার সিন্ধু আর গঙ্গার অববাহিকায় মহেঞ্জাদারো এবং হরপ্পা, আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য, চীনের ইয়াংজি (Yangtze), মধ্যপ্রাচ্যের সুমেরি, পেরুর নরতে চিকো (Norte Chico) এবং তুর্কীর চাতালহয়েক (Çatalhöyük)। এসব বিশাল সভ্যতার সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল কিছু ছোট ছোট প্রান্তিক জনপদের। কালের পরিক্রমায় এমন কিছু ক্ষুদ্র জনপদ ইতিহাসে হয়ে উঠেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

এগুলোর দু’একটি এখনও সময়-সময় বিশ্বকে জানান দিচ্ছে তাদের তাৎপর্য্য। মনে করিয়ে দিচ্ছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের প্রভাব। এমনই এক ছোট প্রান্তিক জনপদের নাম জেরুসালেম। কিন্তু এ প্রভাবশালী শহরটির সৃষ্টি কোথা থেকে? আনুমানিক সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে গড়ে উঠা এ ছোট্র জনপদটির ইতিহাস যেমন বর্ণিল, তেমনি নির্মম এবং জটিল। এ শহরটির ৬০ কিঃ মিঃ পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, আর ৩৬ কিঃ মিঃ পূর্বে মৃত সাগর (Dead Sea) অবস্থিত। এ দু’টোর মাঝে জুদাইয়ান পর্বতমালার উপত্যকায় পশুপালন-নির্ভর এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অস্থায়ী বসতি নির্মাণ করে। এর প্রধান কারণ ছিল, আশেপাশের রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ী ভূমিতে ঐ নির্দিষ্ট এলাকাতেই ছিল একটি পানির ঝর্ণা, যা’র নাম গীহন (Gihon)।

ব্রোঞ্জ যুগের সেই যাযাবর পশুপালক জনগোষ্ঠীর ধর্ম ছিল কেন্নানাইট (Cannanite)। তারা একাধিক দেবতার উপাসনা করতো। ঐ দেবতাদের মধ্যে একটির নাম ছিল সালেম। তাকে বলা হতো শান্তি এবং গোধূলি লগ্নের দেবতা। সালেম দেবতার নামেই এ জনপদটির তখন নাম দেয়া হয় জেরুসালেম, যা’ আজো একই নামে ডাকে সবাই। জেরুসালেম শব্দের অর্থ, “সালেমের শহর”। আধুনিক জেরুসালেম শহরের অভ্যন্তরে প্রাচীরঘেড়া এক বিশেষ পুরোনো এলাকা রয়েছে। মধ্যযুগ থেকেই জেরুসালেমের এ এলাকাটিকে ইহুদি, মুসলিম, খ্রিস্টান এবং আর্মেনিয়ান -এ চারটি মহল্লা বা কোয়ার্টারে ভাগ করা হয়। আব্রাহাময়ী বিশ্বাসের প্রধান তিন সম্প্রদায়ের কাছে বৃহত্তর জেরুসালেমের এ ক্ষুদ্র পুরোনো এলাকাটি ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন, ইহুদি এবং মুসলমানদের কাছে কুব্বাত-আস-সাকরা বা ডোম অব দ্য রক (Dome of the Rock) ও আল-আক্বসা এলাকা; এবং খ্রিষ্টানদের কাছে সেপালচার গীর্জা (Church of the Holy Sepulchre) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদিদের কাছে পশ্চিম দেয়াল (Western Wall) বা বোরাক প্রাচীরও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।

জেরুসালেমের আল-আক্বসা মুসলমানদের জন্য তৃতীয় পবিত্র এলাকা। মক্কার আগে প্রাচীনকালে দৈন্দিন প্রার্থনার জন্য মুসলমানদের প্রথম কেবলা বা দিক ছিল এই এলাকাটিই। আল-আক্বসা, বায়তুল মাক্বদিস, টেম্পল মাউন্ট (Temple Mount), অথবা হারাম আশ-শরীফ -যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এটি কোন নির্দিষ্ট ইমারত বা স্থাপনা নয়। সমান্তরাল দুই বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভুজ আকৃতির এলাকাটিকে বলা হয় আল-আক্বসা বা মাউন্ট টেম্পল। সংক্ষিপ্তভাবে, আল-আক্বসা আসলে একটি ১৪ একরের কম্পাউন্ড, যেখানে রয়েছে কুব্বাত-আস-সাকরা বা ডোম অব দ্য রক, এবং মসজিদুল আল-আক্বসা বা ক্বিবলা মসজিদ।

জেরুসালেমের এ পুরোনো এলাকাটিতে রয়েছে মুসলমানদের জন্য পাঁচটি তাৎপর্যপূর্ণ মসজিদ বা প্রার্থনা করার স্থান। এগুলো হলো, মসজিদুল ক্কাদিম, মসজিদুল মারোয়ানী, মসজিদুল আল-আক্বসা বা ক্কিবলা, মসজিদুল বোরাক, এবং মসজিদুল ওমর। আনুমানিক ৬৩৭-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) রোমানদের কাছ থেকে জেরুজালেম বিজয়ের পর এই আল-আক্বসা এলাকাটির ভেতরেই নির্মাণ করেন ক্বিবলা বা আল-আক্বসা মসজিদ। কালো রঙের একটি সাধারণ গম্বুজ-সম্বলিত এই মসজিদটিতেই বর্তমানে নিয়মিত জামাতে নামাজ পড়া হয়। কুব্বাত-আস-সাকরা বা ডোম অব দ্য রকের পাদদেশ থেকেই ৬২১ খ্রিস্টাব্দে

ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ (সাঃ) মেরাজে গিয়েছিলেন। মোহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর, উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ৬৮৫-৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে আল-আক্বসার ভেতরে মেরাজে যাবার ঐ স্থানটির উপর একটি গম্বুজ-সম্বলিত স্থাপনা নির্মাণ করেন, যা’ বর্তমানে কুব্বাত-আস-সাকরা বা ডোম অব দ্য রক নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে গম্বুজটিকে সোনালী রঙ করা হয়। এই স্থাপনাটি ক্কিবলা মসজিদের (মসজিদুল আল-আক্বসা) ঠিক পেছনেই অবস্থিত। অনেকে এই সোনালী গম্বুজ-সম্বলিত স্থাপনাটিকেই মসজিদুল আল-আক্বসা মনে করে ভুল করে থাকেন।

ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে আল-আক্বসা এলাকাটি টেম্পল মাউন্ট নামেই অধিক পরিচিত। কিন্তু এই একই স্থান ইহুদিদের কাছেও কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ? ইহুদীদের প্রথম উপাসনালয় বা মন্দিরের (First Temple) অবস্থান ছিল বর্তমানের আল-আক্বসার ডোম অব দ্য রকে, যেখান থেকে মোহাম্মদ (সাঃ) মেরাজে গিয়েছিলেন। ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, আনুমানিক ৯৬২ খ্রীষ্টপূর্বে  রাজা সলোমন (মুসলমানদের নবী সুলায়মান আঃ) এখানে প্রথম প্রার্থনার স্থান বা উপাসনালয় (First Temple) নির্মাণ করেন। ৫৮৬ খ্রীস্টপূর্বে ব্যাবিলনীয়রা এ প্রার্থনালয়টিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। শুধু তাই নয়, রোমানরা ইহুদীদেরকে জোর করে জেরুসালেম থেকে বিতাড়িত করে। এর কিছুকাল পর, পারস্যের সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস (Cyrus II) ঐ একই স্থানে (বর্তমানে আল-আক্বসার ডোম অফ দ্য রক যেখানে) দ্বিতীয় উপাসনালয় (Second Temple) নির্মাণ করার অনুমতি দেন। অনুমান করা হয়, ৫১৬ খ্রীস্টপূর্বে রাজা হেরড সেখানে দ্বিতীয় উপাসনালয় নির্মাণ করেন। আবারো, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সামরিক কমান্ডার টাইটাস (Titus) দ্বিতীয় উপাসনালয়টিও ধ্বংস করে ফেলে। ইহুদীরা বিশ্বাস করে, ঐ একই জায়গায়, বর্তমানে আল-আক্বসার ডোম অফ দ্য রকে, নির্মাণ করা হবে তাদের তৃতীয় উপাসনালয় (Third Temple)। ইহুদি এবং মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করে যে, আল-আক্বসাতেই ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর পুত্র ইসহাককে কোরবানি করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন।

জেরুসালেম খ্রিস্টানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেন? এই শহরেই রয়েছে মেরী বা মরিয়ম (আঃ)-এর সমাধি। তাঁর সন্তান যিশু খ্রিস্ট (ঈসা আঃ) জন্মগ্রহণ করেন এখানে এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এ নগরেই তিঁনি ধর্ম প্রচার করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস মতে, জীবনের শেষে এখানেই তিঁনি ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছেন এবং সৃষ্টিকর্তা দ্বারা পুনরুত্থিত হয়েছেন। ইসলামের বিশ্বাস মতে, ঈসা (আঃ)কে হত্যা করা হয় নি, সৃষ্টিকর্তা ঈসা (আঃ)কে জীবিত অবস্থায়ই তুলে নিয়ে যান।

মজার ব্যাপার হলো, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে ভিন্নতার চেয়ে সাদৃশ্যের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। জেরুসালেম এখনো পর্যন্ত সেই সাদৃশ্যগুলোকে ধরে রেখেছে বিশ্বস্থতার সাথে। ডোম অব রকের সুদৃশ্য সোনালী ডোমটি আজো বহন করছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের একেশ্বরবাদের এক নিদর্শন।

আল-আক্বসার ডোম অব রকের সামনে লেখক, ২০১৯

চলবে…. 

তথ্যসূত্র:

* Dumper, M. (2002). The Politics of Sacred Space: The Old City of Jerusalem in the Middle East. Lynne Rienner Publishers.

* Patel, I. (2006). Virtues of Jerusalem: An Islamic Perspective. Al-Aqsa Publishers.

* Asali, K. (1990). Jerusalem in History. Interlink Books.

* রাইহান, মা: ই: (২০২১). মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ। (২য় খন্ড), প্রকাশক : মাকতাবাতুল আযহার