বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিসের গুরু ক্লিসথেনিস ছিলেন সক্রেটিসের শিষ্য। ক্লিসথেনিস থাকতেন এথেন্স থেকে ছয় মাইল দূরে।সক্রেটিসের কথা শোনার জন্য তিনি প্রতিদিন সেই ছয় মাইল পথ হেঁটে এথেন্সের বাজারে হাজির হতেন।

সক্রেটিসের সাদামাটা জীবনের আদর্শ ডায়োজিনিস তাঁর গুরু ক্লিসথেনিসের মাধ্যমে পান। তাঁর জীবনের এই সহজ, অনাড়ম্বরভাব ভাব আবার প্রভাবিত করে তাঁর শিষ্য দার্শনিক জেনোকে, যাঁর প্রচারিত বিখ্যাত স্টোয়িক দর্শন বহুশতাব্দী ধরে ইওরোপের দর্শনের একটি প্রধান ধারা হিসাবে বহমান ছিলো।

ডায়োজিনিস মনে করতেন, মানুষের জীবন হওয়া উচিত সহজ- সরল, অনাড়ম্বর এবং মহৎ চিন্তা আর মহৎ মূল্যবোধে দীপিত। তাঁর স্বপ্ন ছিলো… plain living and high thinking. তারই উদাহরণ হিসাবে তিনি তাঁর গোটা জীবন কাটিয়েছেন একটা টাবের ভিতরে। তিনি বলতেন, উন্নত চিন্তায় সমৃদ্ধ একটি আনন্দময় জীবনের জন্য মানুষের এরচেয়ে বেশি কিছুর দরকার নাই। জীবন যত সহজ আর সাদামাটা হয় ততই সেটা হয়ে ওঠে নির্জলা আনন্দের আকর।

কিংবদন্তি আছে, পানি খাওয়ার জন্য তাঁর একটা সাদামাটা গ্লাশ ছিলো। কিন্তু একদিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন…. একটি মানুষ দুই হাতের আঁজলা দিয়ে পানি পান করছে। দেখে তাঁর মনে হলো পানি পান করার এমন সহজ পথ থাকতে, তিনি কেন অযথা গ্লাসের মতো বাড়তি জিনিস দিয়ে জীবনকে ভারাক্রান্ত করছেন ? গ্লাশটি তিনি নদীর পানিতে ফেলে দিলেন।

এরকম বহু গল্প আছে তাঁকে নিয়ে….

একবার ডায়োজিনিস আলেকজান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে এতো দেশ জয় করছো, তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?”

আলেকজান্ডারের উত্তর ছিলো, আমি সমগ্র গ্রীস জয় করবো!” “তারপর?” জিজ্ঞেস করলেন ডায়োজিনিস।

“তারপর পুরা এশিয়া মহাদেশ জয় করবো!” বললেন আলেকজান্ডার।

“তারপর?” ডায়োজনিসের প্রশ্ন

“তারপর সমগ্র পৃথিবী জয় করবো!”

“তারপর?” “তারপর আর কী! শান্তির সাথে বিশ্রাম নিবো!”

ডায়োজিনিস হাসলেন, “ শান্তিতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এতো যুদ্ধ- হাঙ্গামা করতে হবে? বিশ্রাম তো এখনই নেয়া যায়!”

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে তিনি লণ্ঠন জ্বালিয়ে বাজারে গেলেন।দিনের আলোয় তাঁর হাতে লণ্ঠন দেখে মানুষজন মজা পেলো…. “দিনের বেলা লণ্ঠন জ্বালিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?” লোকজনের কথার উত্তরে তিনি বললেন…. “আমি আসলে মানুষ খুঁজছি, গ্রিসের কোন জায়গায় মানুষ পাওয়া যাবে বলতে পারো?” গ্রিকদের তিনি ঘৃণা করতেন, আর এতোটাই ঘৃনা করতেন যে,তাদের মানুষ বলে গন্য করতেন না। তিনি ভাবতেন…. গ্রিকরা তাদের দারিদ্রতাকে আপন করে নেয়নি,তাই তারা দারিদ্রের সাথে জড়িত স্বনির্ভরতা ও অমলিন স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে পারে না, তারা আজীবন অপূর্নই থেকে যাবে।

তবে সব গল্পের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি হলো…তাঁর সাথে আলেকজান্ডারের দেখা করতে আসার গল্পটি।

আলেকজান্ডার ছিলেন এ্যারিস্টোটালসহ সেকালের বেশ কয়েকজন দার্শনিকের ছাত্র— সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনে তাঁর ছিলো গভীর অনুরাগ। ডায়োজিনিসকেও তিনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। দুজনের দেখা হওয়ার এই গল্পটা আছে ঐতিহাসিক প্লুটার্কের ‘জীবনীমালা’ বইয়ে।

এথেন্স অধিকার করার পর আলেকজান্ডার ঠিক করলেন, তিনি দার্শনিক ডায়োজিনিসের সাথে দেখা করবেন। ডায়োজিনিস তখন বাস করছেন এথেন্সের এক প্রান্তে, একটা কুকুরের খামারের পাশে। আলেকজান্ডার তাঁর পাত্র মিত্রদের নিয়ে একদিন সকালে বেরোলেন ডায়োজিনিসের সাথে দেখা করতে। দিনটা ছিলো কনকনে ঠান্ডা। ডায়োজিনিসের আস্তানায় পৌঁছে তিনি দেখলেন… ডায়োজিনিস পথের ধারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। আলেকজান্ডার ঘোড়া থেকে নেমে সরাসরি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সৈন্যসামন্তদের হৈচৈয়ে ডায়োজিনিস এরমধ্যেই চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার তাঁর সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ আমি আলেকজান্ডার, আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?’ আলেকজান্ডার সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়ানোয় তাঁর শরীরের ছায়া পড়ছিলো ডায়োজিনিসের উপর, এতে করে শীতে তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। আলেকজান্ডারকে তিনি বললেন, “যদি অনুগ্রহ করে রোদটা ছেড়ে একপাশে একটু সরে দাঁড়াও তো খুব উপকার হয়।”

উত্তর শুনে আলেকজান্ডার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এটা কি করে সম্ভব যে একটা মানুষের এই জগতে কিছুই চাওয়ার নেই! দেশের সর্বশক্তিমান রাজা পর্যন্ত তাঁর কাছে কিছুই না! ঘটনার পর আলেকজান্ডার ফিরে চললেন শিবিরের দিকে।

প্লুটার্ক এই কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন : তাঁর সঙ্গে আসা পাত্রমিত্র,সেনাপতি,সভাসদেরা বুঝতেও পারলো না, রাস্তার ধারের এমন তুচ্ছ একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে তাদের এই মহা পরাক্রমশালী প্রভু অযথা কেন এখানে এসেছেন?

অথচ আলেজান্ডারের মনে তখন অন্য ভাবনা। মনে মনে তিনি ভাবছেন, “আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম তাহলে হয়তো ডায়োজিনিস হতে চাইতাম।”

পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রতীক আলেকজান্ডার এবং আর্থিক নিঃস্বতা ও আত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক ডায়োজিনিসের এই সাক্ষাৎ মানব ইতিহাসের এক প্রতীকী ঘটনা।

এই হলেন ডায়োজিনিস, এরকম ছোট বড় অনেক গল্প আছে তাঁকে নিয়ে। সরল ও নিষ্কলঙ্ক জীবনের মর্যাদা ও গৌরবে ভরা সেই সব গল্পগুলি।

তথ্যঋণ গ্রন্থ— বহে জলবতীধারা লেখক— আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ।