১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম প্রস্ফুটিত ফুল যেখানে বীজ বপন করা হয়েছিল বৃহত্তর মুক্তির। এই মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ভারত, মধ্য ভারত ও পশ্চিম ভারত জুড়ে। প্রতিটি অঞ্চলে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন নেতা। ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডে, ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ, কানপুরের তাতিয়া টোপী, ফৈজাবাদের মৌলভী আহমদ শাহ, লখনৌর বেগম হযরত মহল। কিন্তু এতোসব নামের আড়ালে প্রায় চাপা পড়ে আছে অন্য এক মহান বিপ্লবীর কথা যিনি একটি বই বিক্রেতা থেকে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। তিনি পাটনার পীর আলী খান। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে যাকে সবার সামনে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। পাটনার তৎকালীন কমিশনার উইলিয়াম টেইলর যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন শহরের প্রধান বিদ্রোহী হিসেবে। ইতিহাসের ভুলে যাওয়া সেই বিপ্লবীর বর্নাঢ্য জীবনে প্রবেশ করা যাক।

উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার মোহাম্মদপুরে জন্মগ্রহণ করেন পীর আলী খান। সাত বছর বয়সে তিনি পালিয়ে পাটনায় চলে আসেন। সেখানের এক স্থানীয় জমিদার তাঁকে আশ্রয় দেন এবং তার ভরণপোষণেরও দায়িত্ব নেন। এই পাটনায় পীর আলী খানের পেশাগত জীবন শুরু করেন এক বই দোকানদার হিসেবে। পরবর্তীতে তার এই বইয়ের দোকান হয়ে উঠে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের আস্তানা হিসেবে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দলত্যাগী ভারতীয় সৈন্যদেরও গোপন আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল তার এই দোকান। তার দোকান থেকেই বিপ্লবীদের কাছে বিভিন্ন গোপন তথ্য ও খবর পাঠানো হতো। ক্রমে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এই বিপ্লবীদের একজন নেতা।

পাটনার তৎকালীন ব্রিটিশ কমিশনার উইলিয়াম টেইলরের মতে, পীর আলী খানের বাড়ি ছিল লখনৌতে। তিনি পাটনায় এসে বই বিক্রেতা হিসেবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি এই দোকানের মাধ্যমে নিজেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে নেন।

পীর আলী গোপনে লিফলেট ও সাংকেতিক খবর প্রেরণ করতেন বিদ্রোহীদের কাছে। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের বাতাস পাটনায়ও লেগে যায় তখন তিনি হয়ে উঠেন এখানকার নেতা। ১৮৫৭ সালের ৩ জুলাই পাটনায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়। পীর আলীর নেতৃত্বে গড়া বিপ্লবীর দল প্রথমে শহরের রোমান ক্যাথলিক গির্জার যাজককে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে কিন্তু যাজক কোনমতে পালিয়ে রক্ষা পান। তারপর তারা ড. লিয়েল নামক এক স্থানীয় আফিম এজেন্টকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাস্থলে ব্রিটিশ সৈন্য পাঠালে অনেককে গ্রেফতার করা হয় এবং অনেক বিপ্লবী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত চেম্বারের বই The history of indian revolt and the expedition persia, china and japan 1856-7-8 গ্রন্থে ৩ জুলাইয়ের পাটনা বিদ্রোহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে,

”  ৩ জুলাই রাত ৮ টায় ৮০ বা ২০০’র মত একটা মোহামেডানের (মুসলমান) দল পীর আলীর নেতৃত্বে শহরের রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও মিশন কেন্দ্রে দুইটি বড় সবুজ পতাকা নিয়ে ড্রাম বাজিয়ে আলী আলী চিৎকার করে যাজককে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ঐ যাজক বেঁচে যান। তারপর তারা রাস্তায় গিয়ে সাধারণ জনগণকে তাদের সাথে যোগদানের জন্য আহ্বান জানায়। ঐ মুহূর্তে নয়জন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে ডক্টর লিয়েল নামের আফিম এজেন্টের প্রধান সহকারী দাঙ্গার স্থানে উপস্থিত হোন। বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তারা ছিড়ে ফেলে। এক পর্যায়ে শিখরা এসে তার মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যায় এবং কিছু বিদ্রোহীদের হত্যা করে”

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশগ্রহণের জন্য মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়

এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রিটিশ সরকার পীর আলীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বেশকিছু গোপন চিঠি ও অস্ত্র  খুঁজে পায় এবং তারপর থেকে সরকারিভাবে উইলিয়াম টেইলর পীর আলী খানকে বিদ্রোহের প্রধান নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। উইলিয়াম টেইলর সেদিন আরো বর্ণনা দেন, বিদ্রোহের পরদিন তদন্ত কমিটির প্রধান ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মওলা বকশ খুব হাসিহাসি মুখ নিয়ে তার সামনে আসেন। তার হাতে ছিল বেশকিছু ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ও চিঠি। পরে এই চিঠির মাধ্যমে জানা যায় বেশ কয়েক বছর ধরেই পীর আলী খান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন।

ব্রিটিশ সরকার এরপরে পীর আলী সহ পাটনার অন্যান্য বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে অনেক বিপ্লবীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পীর আলীর ওপর অভিযোগ আনা হয় ডক্টর লিয়েল হত্যাকাণ্ডের। সর্বোপরি পাটনার বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে তাঁকে কোন শুনানি ছাড়াই প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পীর আলীকে একটা সুযোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহ সম্পর্কে আরো তথ্য দেয়ার বিপরীতে তাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে এমন প্রস্তাবও দিয়েছিল তারা। কিন্তু পীর আলী খান সম্মানের সাথে তা প্রত্যাখান করেন। অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার পরিবর্তে তিনি ফাঁসির কাষ্ঠ বেছে নিয়েছিলেন। উইলিয়াম টেইলর তার নোটে লিখে গিয়েছিলেন,

” মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর আমি যখন পীর আলীর মুখোমুখি হই আমি সহ আরো অনেক ইংরেজ লোকের সামনে শিকল পড়া পীর আলী খান যার ময়লা কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে আছে এমন সময়ে আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হল কিন্তু সে তার আদর্শ থেকে বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত হল না। “

সেদিন উইলিয়াম টেইলরের সামনে পীর আলী খান অসীম সাহসের সাথে বলেছিলেন,

” তোমরা হয়তো আমাকে হত্যা করবে অথবা আমার মতো আরো অনেককে হত্যা করবে কিন্তু আমার মতো আরো হাজার জন তৈরি হবে এবং তোমাদের উদ্দেশ্য কখনোই বাস্তবায়ন হবে না”

জুলাই মাসের ৭ তারিখ ১৮৫৭ তে পীর আলী খানকে প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পীর আলীকে যেখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল সেখানে বিহার সরকার শহীদ পীর আলীর স্মরণে একটি পার্ক নির্মাণ করেছে। এক সাধারণ বই বিক্রেতা কিভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে তা ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় সূচিত করেছে। অখ্যাত এই মহানায়ক চিরকাল ভাস্মর থাকবেন সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে।

তথ্যসূত্র

Peer Ali Khan, The Bookseller Who Led The 1857 Uprising In Patna : Kanupriya

Peer Ali Khan

Peer Ali Khan Patna, Bihar