বারোবাজার বাংলাদেশের গৌরবময় এক ঐতিহাসিক স্থান। প্রাচীনকাল হতেই বারোবাজার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল হিসাবে বিবেচিত। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম সভ্যতার সম্মিলিত চারণভূমি এই জায়গাটি বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে এসেছে। এমনকি গ্রীক ইতিহাস অনুযায়ী বারোবাজার গঙ্গারিডিদের রাজধানী ছিল বলেও জানা যায় বহু কীর্তি চিহ্ন মন্ডিত, বহু প্রাচীন, বহু বিস্তৃত এবং অধুনা অবহেলিত এমন স্থান এই প্রদেশে আর নেই।

টলেমির মানচিত্রে গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridai)

এই জায়গাটির অনেক দক্ষিণে মড়লীতে প্রাচীন জনপদ সমতটের রাজধানী ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১২০৪ খ্রি. পর্যন্ত এই অঞ্চল সেনরাজাদের এবং ১৩৮০ খ্রি. পর্যন্ত পাল রাজাদের তত্ত্বাবধানে ছিল রাজা শশাঙ্কের শাসনের পর সপ্তম শতকের মধ্যভাগে এই অঞ্চল বৌদ্ধদের দ্বারা শাসিত হয়।

বিখ্যাত বণিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য কেন্দ্র বারোবাজার ছিল বলে জানা যায়। বারোবাজার রেলস্টেশনের প্রায় ৪ কি.মি. পরিধির মধ্যে দৌলতপুর, সাদীপুর, মিঠাপুকুর, হাসিলবাগ বেলাত, বাজেদিহি, ফ’লবাড়ি, গৌরিনাথপুর, রহমতপুর প্রভৃতি নামের গ্রামগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে একটি মধ্যযুগীয় শহরের অস্তিত্ব দেখা যায় এর ঠিক উত্তরেই পুরাতন বৈরব নদীর একটি খাত প্রবাহিত। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ভৈরব নামটিতে মধ্যযুগীয় আরবীয় নৌবাণিজ্যের স্বাক্ষর রয়ে গেছে। ভৈরব নামটি আরবী বহর-ই-আব (পানির বন্দর) বলে মনে করেন।ত্রই যুক্তির সমর্থনে বৈর নদীর তীরে ত্রকটা জাহাজ ঘাট ও আবিস্কৃত হয়েছে। সুতারাং ত্রখানে মুসলিম স্থাপত্যে বেশ কিছ’ নিদর্শন পাওয়া যাবে ত্রমনটা মনে হওয়াই স্বভাবিক।

বারোবাজার: জোড়বাংলা মসজিদে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলক

বারোবাজারে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে তার প্রায় সবগুলোর বিভিন্ন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। রয়েছে কতিপয় পুকুর দীঘী। বারোবাজারের উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলো হচ্ছে পাঁচপীরের দীঘিপীরপুকুর চেরাগদানী দীঘি সওদাগর দীঘি ঘড়দীঘি পিঠি গড়া দীঘি. শ্রীরাম রাজার দীঘি মিঠাপুকুর লবণগোলা দীঘি ঘড়দীঘি বা রাজমাতার দীঘি ইত্যাদি। রয়েছে মাজার কবর মুরাদ রাজার জড় হাসিলবাগ গড় এসব।

বারো বাজারের ঐতিহ্য

কিছ’দিন আগেও বারোবাজারে লতা-গুল্মে ঢাকা ২৫/৩০টি উঁচু ঢিবি দেখা যেত। ১৯৮৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মধ্য দিয়ে কতিপয় মসজিদ আবিস্কৃত হয়। ১৯৯৩-৯৫ পর্যন্ত খননের মধ্য তিয়ে বারোজারের প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য আরও বেশি খানিকটা উন্নোচিত হয়। এ পর্যন্ত বারোবাজারের ১৪/১৫ টি ঢিবি খনন করে ১০ টির মতো মসজিদ আবিস্কৃত হয়েছে। বাকীগুলো মাজার, জাহাজহাটা ইত্যাদি। তবে বারোজারের ইতিহাস জানবা মত লির্খিত সূত্র ত্রখনো খুব যথেষ্ট নয়। এ যাবৎ মরাসরি কেবল জোড়বাংলা ঢিবি থেকে একটি লিপিতাত্বিক নিদর্শনে কয়েকটি ভাঙ্গা টুকরা পাওয়া গেছে। এই লিপির ভাষ্য অনুযায়ী ডিবির মসজিদটি বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আবুল মোজাফফর মাহমুদ শাহের শাসনামলে (১৫৩৩-৩৮) নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল কোন এক প্রশাসনিক শহর যার নাম ছিল মুহম্মাদাবাদ। এখানে একটা টাকশালের অস্তিত্ব ছিল। ৮০০ হিজরী তথা চতুর্দশ শতাব্দীতে ইলিযাস শাহী বংশের শাসনামল হতে সুলতানী আমল পর্য়ন্ত বিভিন্ন সময়ে এখানকার নিদর্শন এখানে পাওযা যায় না এতে বোঝা যায় যে, মোঘল যুগীয় সময়কালে বারোবাজারের তেমন কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল না। কেউ মনে করেন যে পরিকল্পিতভাবেই বারোবাজারের স্থাপত্যগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছিল। তবে তা ভিন্ন ইতিহাস।

যতদূর জানা যায় যে হযরত খান জাহান আলী (রঃ) রাজা গণেশের পুত্র জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহেদ শাসনামলে (১৪২৮-৩২ খ্রি) যশোর অঞ্চলে আসেন। একথা বলা হয় যে তিনি বাগেরহাট পৌছুবার আগেই এই অঞ্চলের মসজিদগুলো নির্মাণ ওদীঘিসমূহ খনন করা হয়। এ হিসাবে নিঃসন্দেয়ে বারজারের গোড়ার মসাজদ এবং অন্যান্য মসজিদসমূহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম মসজিদ। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এবং প্রত্ত্ববিধগণ ত্রই অভিব্যক্তিই ব্যক্ত করেছেন। যাহোক বারবাজারের গোড়ার মসজিদ এ অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্যের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ মসজিদটি সবচেয়ে কম ভগ্নাবস্থায় পাওয়া যায়। এটি মূলত একটি এক গম্বুজ মসজিদ। মসজিদের ভেতরের ও বাইরের দেওয়াল মেহরাবগুলোতে পোড়ামাটির ফলকে লতাপাতা ফুলের ডিজাইন শোভিত রয়েছে। জোড়াবাংলা মসজিদের নির্মাণশৈলী কিছুটা বাগেরহাটের সিঙড়া মসজিদের মতো মনে হবে। মসজিদটি মাটি হতে ১০-১২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ১৮x১৮ বর্গাকার এই মসজিদের পাশে কোন মক্তব ছিল না বলে ধারণা করা হয়। এখনও জোড়াবাংলা দীঘির তলদেশ পর্যন্ত বাঁধানো ঘাট রয়েছে এবং এই দীঘিতেই সুলতানী আমলের শিলালিপি পাওয়া গেছে। গলাকাটা মসজিদটি বারোবাজার গ্রামের মধ্য দিয়ে বারবাজার দীঘির উত্তর দিকে বিদ্যমান। মসজিদের স্তম্ভগুলো মূল্যবান পাথরের। মসজিদটি মোট ছয়টি গম্বুজ থাকায় এটি ছয় গম্বুজ মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদটির পোড়ামাটির ফলক অত্যন্ত সুন্দর। মসজিদের ঠিক উত্তরেই রয়েছে গলাকাটা দীঘি।

আদিনা মসজিদটা সাতগাছিয়া গ্রামে অবস্থিত বলে এটি সাতগাছিয়া মসজিদ নামেই বেশী পরিচিত। এ মসজিদের উপরের অংশ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আদিনা কথাটির অর্থ শুক্রবার। এ মসজিদটি ষাট গম্বুজ মসজিদের সমসাময়িক বলে মনে করা হয়।

পীর পুকুর মসজিদ

পীর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে পীর পুকুর মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের কেন্দ্রীয় মেহরাবের উত্তর পাশে দুটো সিঁড়ি এবং বিস্তৃত স্থান রয়েছে। সাদিকপুর মসজিদ সাদিকপুর মৌজায় অবস্থিত। মসজিদটির ছাদ একটা আধাবৃত্তাকার গম্বুজদিয়ে ঢাকা। বারোবাজারের অন্যান্য পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে কোটালি মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ, সওদাগর মসজিদ, আউলিয়া মসজিদ, শুকুর মল্লিক মসজিদ, চেরাগদানী মসজিদ ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ মসজিদই সংস্কার করা হয়নি। এ কারণে সব মসজিদে নামাজ জড়া হয় না। প্রতিটি মসজিদের পাশেই রয়েছে দীঘি। জনশ্রুতি অনুযায়ী এ অঞ্চলে রয়েছে ৬ কুড়ি ৬ টা বা ১২৬ টি দীঘি। এর মধ্যে ৭২ টি দীঘির নাম জানা যায়। এছাড়া এখানে রয়েছে গাজী কালূ চম্পাবতীর মাজার, শাহ সেকান্দরের বাড়ি।

৯৩-৯৪ সালের পর এখানকার সংস্কার কার্যক্রম একরকম বন্ধ হয়ে আছে। এখানে কোন জাদুঘর কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোন অফিস করা হয়নি। ফলে এখানে প্রাপ্ত সুলতানী আমলের মুদ্রা, লিপি, কোরআন শরীফসহ অনেক নিদর্শনই প্রভাবশালীদের দখলে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বারোবাজারের ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের আরও অনেক বেশী সচেতন হবার প্রয়োজ রেয়েছে।