১৯৪৫ সালের ৮ই মে; নাৎসি জার্মানি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে ইউরোপে দীর্ঘ ৬ বছরের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতি ঘটে। যদিও এশিয়ায় তখনও জাপানের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত। যুদ্ধোত্তর জার্মানি তথা ইউরোপের দিশা খোঁজার লক্ষ্যে Allied Control Council তৈরি করা হল। মিত্রপক্ষের তরফে জার্মানিকে ফরাসি, ব্রিটিশ, মার্কিন ও সোভিয়েত চারটি Occupation Zone-এ ভাগ করা হল। জার্মানির পূর্ব ভাগ গেল সোভিয়েতের দখলে, মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানি মার্কিন দখলে, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম জার্মানি হল ব্রিটিশাধীন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানি রইল ফ্রান্সের দখলে। অনুরূপ ভাগ হল জার্মানির রাজধানী শহর বার্লিনের, তাকেও করা হল চার টুকরো।
২৪শে জুন, ১৯৪৮; সোভিয়েত সেনার তরফে পশ্চিম বার্লিন (বার্লিনের ফরাসি, মার্কিন ও ব্রিটিশ অধিকৃত অংশ) যাওয়ার সকল ট্রেন, রাস্তা ও জলপথ বন্ধ করে দেওয়া হল। পশ্চিম বার্লিনে তখন কেবল ৩৬ দিনের খাদ্য ও ৪৫ দিনের মত কয়লা মজুত আছে। বার্লিন শহরটি পূর্ব জার্মানির অংশ হওয়ায় এবং পশ্চিম জার্মানি (জার্মানির ফরাসি, মার্কিন ও ব্রিটিশ অধিকৃত অংশ) থেকে শতাধিক মাইল দূরে হবার ফলে কার্যত পশ্চিম বার্লিনকে ঠেলে দেওয়া হল দুর্ভিক্ষের দিকে। কিন্তু কেন? উত্তর খুঁজতে ৪৪-৪৮ এই সময়ের মধ্যে ফিরতে হবে। অন্তত দুটো ঘটনার দিকে চোখ রাখতে লাগবে। এক, ১৯৪৫ সালের Potsdam Conference; দুই, ১৯৪৮ সালের মার্শাল প্ল্যান। আর এই দুটোকে বুঝতে ফিরতে হবে আরেকটু পেছনে, ১৯৪৪ সালের Morgenthau Plan-এ।
১৯৪৪ সালে আমেরিকার ট্রেসারি সেক্রেটারি Henry Morgenthau আত্মসমর্পণ-উত্তর জার্মানির রূপরেখা কী হবে সেই নিয়ে ‘Suggested Post-Surrender Program for Germany’ প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবগুলি মোটামুটি যেমন ছিল –
১. যুদ্ধোত্তর জার্মানির সামরিক ক্ষমতায়ন করতে সক্ষম সকল শিল্প-সম্ভাবনাকে ধংস করা হোক।
২. জার্মানিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হোক এবং অষ্ট্রিয়াকে ১৯৩৮ পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া।
৩. রূর অঞ্চলের সকল শিল্পসম্ভাবনার সমাপ্তি।
৪. জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। তার বদলে মিত্রপক্ষ জার্মানির শিল্পজাত দ্রব্য ও এলাকা দখল করে তা মিটিয়ে নেবে।
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রুজভেল্ট ও চার্চিল কিউবেক কনফারেন্সে Morgenthau Plan-কে মোটামুটি মেনে নেয়, কেবল জার্মানিকে ভাগ করার প্লানটি বাদ রেখে। জার্মানির শিল্পের ক্ষতি করে তাকে কৃষিপ্রধান দেশের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলে ৪০% জার্মানদের খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবসকীয় জিনিসের অভাব পড়বে এবং সেই দায় মিত্রপক্ষের ওপর বর্তাবে, এই চিন্তা থেকেই গেছিল।
জার্মানির আত্মসমর্পণের পর ১৭ই জুলাই, ১৯৪৫ জার্মানির বার্লিন শহর থেকে ২৪ কিমি দূরে পটসডাম শহরে সোভিয়েত তত্তাবধানে Potsdam Conference শুরু হল। ততদিনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পর হ্যারি ট্রুম্যান নতুন মার্কিন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ওদিকে ইংল্যাণ্ডে ভোটের ফল বেরিয়েছে কনফারেন্স চলাকালীন, ২৬শে জুলাই। এবং সবাইকে অবাক করে হেরে গেছেন চার্চিল। ইংল্যাণ্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ক্লিমন্ট অ্যাটলি।
Potsdam Conference-এ পোল্যাণ্ড, অষ্ট্রিয়ার সাথে সাথে ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে জার্মানিরও। তৈরি হয়েছে Allied Control Council যারা জার্মানি ও বার্লিনকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে।
১৯৪৭-৪৮ আসতে আসতে প্রথমে ব্রিটিশ ও মার্কিন অধ্যুষিত অঞ্চল একত্রে তৈরি করেছে বাইজনিয়া ও পরে ফরাসিভুক্তিতে তা ট্রাইজনিয়ার রূপ নিয়েছে (ট্রাইজনিয়া তখনও সাবেক পশ্চিম জার্মানি বা ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি হয়ে ওঠেনি, তবে আলোচনার স্বার্থে আমরা এই ট্রাইজনিয়াকে পশ্চিম জার্মানি বলে উল্লেখ করব)। রুজভেল্টের পর ট্রুম্যান হেঁটেছে অন্য পথে। Morgenthau Plan-এর জায়গায় সে Marshall Paln এনেছে। গ্রেট ডিপ্রেশন উত্তর আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে শিল্প ও অর্থনীতিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ফলে তার পক্ষে Laissez-faire অর্থনীতিকে প্রোমোট করতে তেমন ঘরোয়া বাধা পেতে হয়নি।
সোভিয়েত প্ল্যান ও Morgenthau Plan যখন জার্মানির শিল্পের কোমর ভাঙার দিকে এগোনোর পক্ষে তখন মার্শাল প্ল্যান জার্মানির পুনর্নির্মাণের পক্ষে সওয়াল করেছে। জার্মানিকে (এবং ইউরোপকে) সে দিয়েছে বিশাল অঙ্কের টাকা, যা দিয়ে জার্মানি (তথা) আদতে কিনেছে মার্কিন সামগ্রী এবং এতে ইউরোপের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সাথে সাথে মার্কিন অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করেছে। মার্শাল প্ল্যানের আরেকটি লক্ষ্য ছিল পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত আধিপত্যের অবসান এবং তা পরিষ্কার হয় যখন মার্শাল প্ল্যানের টাকা পোল্যাণ্ড বা জার্মানির আগে বরাদ্দ করা হয় গ্রীসের (যেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে সরকার বনাম কমিউনিস্টদের) ও তুর্কীর (যেখানে রুশ-তুর্কী বিবাদ চলমান) জন্য। মার্শাল প্ল্যানের প্রতি ২০ ডলার খরচের মধ্যে ১ ডলার খরচ হত CIA-এর জন্য, পশ্চিম ইউরোপকে সোভিয়েত সেন্টিমেন্ট থেকে দূরে রাখতে। মার্শাল প্ল্যানের আওতায় পূর্ব ইউরোপকে আনার আমন্ত্রণ জানালে স্তালিন তার লিবেরাল ইকনমির ফাঁদকে দেখতে পেয়ে তা খারিজ করেন।
১৮ই জুন, ১৯৪৮; মার্কিন ও ব্রিটিশ অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য তারা নিয়ে আসে নতুন নোট Deutschmark, যা প্রতিস্থাপন করে পুরনো Reichsmark-কে। সোভিয়েতের তরফে এই উদ্যোগকে দেখা হয় Potsdam Conference-এর লঙ্ঘন হিসেবে। এরপর ২৪শে জুন শুরু হয় বার্লিন অবরোধ (Berlin Blockade)।
মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা স্থলপথে ও জলপথে পশ্চিম বার্লিনকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকতে না চেয়ে উদ্যোগ নেয় আকাশপথে সংযোগ করার। ২৬শে জুন শুরু হয় Airlift.
পশ্চিম বার্লিনের ২,০০০,০০০ মানুষের জন্য ২০০০ ক্যালোরি ধরলে প্রয়োজনমাফিক প্রত্যহ ৫,০০০ টন উপাদান পাঠাতে হত যার মধ্যে ১৫০০ টন খাদ্য সামগ্রী (৬৪৬ টন খাবার, ১৮০ টন চিনি, ১০৯ টন মাংস, ৬৪ টন ফ্যাট, ৩৮ টন লবণ) এবং ৩৫০০ টন কয়লা ও অন্যান বস্তু। সেই সময় ব্যবহৃত C-54s ৩ টনের বেশি মাল বইতে সক্ষম ছিল না। ফলে প্রায় প্রতি ১ মিনিটে একটি করে প্লেন পৌঁছোতে হত বার্লিনে, যা আদপে অসম্ভবের মত শোনায়। প্রথম তিন দিনে পৌঁছোয় কেবল ৫০০ টন সামগ্রী। অক্টোবর মাস আসতে আসতে তা দৈনিক ৬০০ টনে পৌঁছোয়। প্লেন থেকে মাল খালি করার কাজে স্থানীয় বার্লিনবাসী হাত লাগালে অসম্ভব আর অসম্ভব থাকে না। ১১ মাসে প্রায় ২২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে, বাঁচিয়ে রাখা হয় বার্লিনকে। প্লেনের আধিক্যের জন্য পাঁচটি আলাদা উচ্চতায় প্লেন উড়ত। যদিও কিছু দুর্ঘটনা ঘটে এবং মারা যান ১০১ জন।
অবশেষে ১২ই মে, ১৯৪৯ সোভিয়েতের তরফে তুলে নেওয়া হয় অবরোধ। তবে তাতেও এয়ারলিফ্ট জারি থাকে আরও কিছু দিন, যতক্ষণ না রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।
১২ই মে অবরোধ উঠে যাওয়ার পর বার্লিনবাসী মনে করেন, এই বোধহয় ঘটল ঠাণ্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি। এরপর ২৩শে মে ১৯৪৯ গঠন হয় পশ্চিম জার্মানির, ৭ই অক্টোবর ১৯৪৯ গঠন হয় পূর্ব জার্মানির। তারপর ন্যাটো, ওয়ারস চুক্তি হয়ে জল গড়ায় ১৯৬১ সালের Berlin Wall পর্যন্ত।
লেখা – Arka Das
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel