ভাটিবাংলায় সূচিত হলো ১৫৭৮ সাল। নতুন বছরের শুরু থেকেই পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মোগলরা সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছে, এমন একটা সংবাদ শোনা যাচ্ছিল। কবছর ধরে ভাটিবাংলার মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের সাথে মোগলদের দ্বন্দ্ব চলছে, কোনো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মোগলরা তাই এবার চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ঈসা খানও বসে ছিলেন না। তাঁর নৌবাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছিল মেঘনা ও ব্রক্ষ্মপুত্র নদীতে। বর্ষার শুরুতে ভাটি অঞ্চল তার প্রকৃত চেহারা ফিরে পেল। বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা পানিতে ভরে গেল, শুরু হলো স্থানীয়দের জলবন্দী জীবন। পরবর্তী চার মাস এভাবেই কাটবে তাদের। বাংলার সুবাদার মোগল সেনানায়ক খান জাহান অবস্থান করছিলেন ঝাড়খন্ড জেলার তান্ডা নগরে। বর্ষার শুরুর দিকে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে নৌপথে ভাটিবাংলার দিকে রওনা হলেন। ভাওয়াল পরগনার চৌরা (১) শহরে মোগল বাহিনী শিবির স্থাপন করে। এখান থেকে তিনি ঈসা খানের বিরুদ্ধে বাহিনী প্রেরণ করেন।

ঈসা খাঁ; Image source: Wikimedia

মেঘনার পশ্চিম তীরে কাইথল (২) নামক স্থানে ঈসা খানের বাহিনীর মুখোমুখি হয় মোগল বাহিনী। দুই বাহিনীই তাদের নৌবহর নিয়ে প্রস্তুত ছিল। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লো নদীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। বর্ষার প্রমত্তা মেঘনার বুকে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও আহতদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল। যুদ্ধের প্রথমদিকে খান জাহানের বাহিনী বিজয়লাভ করে। ঈসা খান কৌশলগত কারণে তাঁর বাহিনী নিয়ে পিছু হটেন। ঈসা খানের বাহিনীর ফেলে যাওয়া জাহাজ লুণ্ঠনে মোগলরা ব্যস্ত ছিল, এরইমধ্যে ঈসা খান তাঁর দুই সহযোগী মজলিশ দিলাওয়ার ও মজলিশ প্রতাপের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ করেন। মোগল বাহিনী এই হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হামলার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে তারা পিছু হটে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে তারা তান্ডায় ফিরে আসে। কাইথলের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ঈসা খানের মূল জমিদারী সরাইল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে জোয়ানশাহী পরগনার ভেতরে। মোগল বাহিনী এই প্রথম অনুভব করলো তারা এক শক্তিশালী সেনানায়কের মুখোমুখি হয়েছে, যিনি নিজের সীমানার বাইরে গিয়েও লড়াই করতে পারদর্শী।

সরাইল।
নিজের প্রাসাদের বারান্দায় বসে আছেন ঈসা খান। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। রোদ উঠলেও তাতে প্রখরতা নেই। চারপাশে পরিবেশ নীরব। কোনো হৈ চৈ নেই। দিনটি কোথাও ঘুরে আসার জন্য চমৎকার। অন্যসময় হলে ঈসা খান হয়তো তা-ই করতেন। কিন্তু আজ তাঁর ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। মোগল বাহিনীর প্রস্থান ঈসা খানকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিনি জানেন মোগলদের সাথে যে লড়াই শুরু হয়েছে, কোনো এক পক্ষের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই লড়াই থামবে না। ‘তখত ইয়া তাজ’ (সিংহাসন অথবা শবাধার) প্রাচীন মোগল প্রবাদটি মনে পড়লো তাঁর। ঈসা খান জানেন, মোগলরা আবার আসবে। আরো বেশি সামরিক শক্তি নিয়ে। সম্রাট আকবর, তৃতীয় মোগল, পিতার মতো ভাবালু ও রোমান্টিক নন, তিনি অবশ্যই বাংলাকে তাঁর করায়ত্ত করার সকল চেষ্টা চালাবেন।

বড় সরদার বাড়ি যা ঈশা খাঁর জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত, সোনারগাঁও ; Image source: Wikimedia

ঈসা খান উঠে দাঁড়ালেন। দূরে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি দেখা যাচ্ছে। মাঠে লোকজন কাজ করছে। ‘শক্তি অর্জনের জন্য ১৪ বছর বেশ দীর্ঘ সময়’–আনমনে ভাবলেন ঈসা খান। ১৪ বছর আগে, ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরাইলের জমিদারি লাভ করেন। এর আগে জীবন ছিল কঠিন। ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খানের পিতা সোলায়মানকে হত্যা করার পর ঈসা ও খান ও তাঁর ভাইকে তুর্কিস্তানের বণিকদলের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। ১৫৬৩ সালে চাচা কুতুবুদ্দিন তাঁর দুই ভাতিজাকে তুর্কিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনেন। শুরুতে কিছুদিন তিনি গৌড় সরকারের অধীনে কাজ করেন। কিছুদিন পর লাভ করেন সরাইলের জমিদারি। ১৫৬৪- ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে ঈসা খান তাঁর জমিদারি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এসময় তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। সেসময় চলছিল কররানিদের শাসন। তারা বিহার ও উড়িষ্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়া মোগলদের সাথেও তাদের লড়তে হচ্ছিল, ফলে ভাটিবাংলা সম্পর্কে তারা ছিলেন অনেকটাই উদাসীন। ঈসা খান তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তবে নিজের জমিদারিতে তিনি ছিলেন স্বাধীন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান সোনারগাঁয়ে অবস্থানরত মোগল সেনাপতি শাহ বরদির বাহিনীকে আক্রমণ করে বিতাড়িত করেন। এর ফলে ঈসা খান মোগলদের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে যান। ইতিমধ্যে ১২ জুলাই ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানি পরাজিত ও নিহত হন।

দাউদ খান কররানির পরাজয় ও মৃত্যুর সংবাদ ঈসা খানকে বিচলিত করে তোলে। তিনি জানতেন মোগল বাহিনী এবার বাংলার দিকে হাত বাড়াবে। তখন পর্যন্ত ঈসা খান নিজের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। রাজমহলের যুদ্ধের কিছুদিন পর তিনি চট্টগ্রাম চলে যান। ফটিকছড়ির ঈশাপুর নামক পরগনায় কাজি সদর জাহান নামে একজন সুফিসাধকের কাছে কিছুদিন অবস্থান করেন। এসময় তিনি নিজের বাহিনী গঠনের কাজও চালিয়ে যান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৫৭৬-১৫৮৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে ঈসা খান বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন। তাঁর নামেই ঈশাপুর পরগনার নামকরণ করা হয়। (৩)

দাউদ খান কররানী; Image source: Wikimedia

১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে কাইথলের যুদ্ধে পরাজিত মোগল বাহিনী ভাটিবাংলা ত্যাগ করে। পরবর্তী চার বছর তারা এদিকে নজর দেয়ার সুযোগ পায়নি। এর কারণ ছিল মোগল বাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে বসে। এর ফলে বিহার, বাংলা ও উড়িষ্যায় বেশ গোলযোগের সৃষ্টি হয়। সম্রাট আকবর এই বিদ্রোহ দমন করতেই ব্যস্ত ছিলেন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে খান আযমকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই চলতে থাকে। বিদ্রোহীদের একজন নেতা মাসুম খান কাবুলি ঘোড়াঘাট থেকে পালিয়ে এসে ঈসা খানের বাহিনীতে যোগ দেন। মাসুম খান কাবুলি ও তাঁর দলকে পাশে পেয়ে ঈসা খানের শক্তি বৃদ্ধি পায়।

মোগলদের সাথে চারবছরের অলিখিত যুদ্ধবিরতি চলাকালে ঈসা খান নিজের শক্তি আরো বাড়িয়ে তোলেন। সোনারগাঁ, মহেশ্বরদি, জোয়ানশাহী, কতরাব–এসব এলাকা তিনি নিজের দখলে নিয়ে আসেন। ১৫৮৪ সালের মধ্যেই তিনি খিজিরপুর, সোনারগাঁ, এগারসিন্দু, বাজিতপুর এসব এলাকায় একাধিক শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেন ফেলেন। একইসাথে নিজের সদরদপ্তর সরাইল থেকে সরিয়ে সোনারগাঁতে নিয়ে আসেন। ঈসা খান দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ততদিনে তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে ঢাকা জেলার অর্ধাংশ ও ময়মনসিংহ জেলার প্রায় সম্পুর্ণ।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ।
আরও একবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে চলেছিল ভাটিবাংলা। সে বছর মার্চ মাসে নতুন মোগল সুবাদার শাহবাজ খান তাঁর বাহিনী নিয়ে গঙ্গার পথ ধরে ভাটির দিকে অগ্রসর হলেন। প্রথমেই তিনি ঈসা খানের শক্তিশালী নৌঘাটি খিজিরপুর(৪) দখল করেন। সেখানে মোগল ঘাঁটি স্থাপন করে তিনি এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। ততদিনে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। মেঘনার দুকূল ছাপিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে মোগলরা মাসুমাবাদ ও সোনারগাঁ দখল করে নেয়। ঈসা খান কার্যত তাদের প্রতিরোধ করার কোনো চেষ্টাই করেননি। মোগলরা আরো এগিয়ে এগারসিন্দুরে হামলা করে। এখানে মাসুম খান কাবুলির বাহিনীর সাথে তাদের তীব্র লড়াই হয়। মোগলরা কাপাসিয়ার টোক গ্রামে দুর্গ নির্মাণ করে।

ঈসা খান তাঁর বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বাজিতপুরে। মোগল সেনাপতি তরসুন খান একটি বাহিনী নিয়ে বাজিতপুরের দিকে রওনা হন। সংবাদ পেয়ে মাসুম খান কাবুলি অতর্কিতে হামলা করে তরসুন খানকে পরাজিত ও হত্যা করেন। ইতিমধ্যে ঈসা খান ব্রহ্মপুত্র নদীর পনেরোটি স্থানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দেন। একইসাথে শাহবাজ খানের সাথে সন্ধি নিয়ে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। বর্ষার তীব্রতা বেড়ে গেলে ঈসা খান বাঁধগুলো খুলে দেন। আচমকা পানির তোড়ে ভেসে যায় মোগল শিবির। মোগলরা যখন তাদের ডুবে যাওয়া শিবির টেকাতে ব্যস্ত তখনই ঈসা খান হামলা করে বসলেন। একদিকে ডুবন্ত শিবিরে দিশেহারা মোগল সেনারা, অপরদিকে ঈসা খানের যুদ্ধজাহাজগুলো একের পর এক গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে মোগল শিবিরে। এই যুদ্ধে মোগলরা নির্মমভাবে পরাজিত হয়। তাদের প্রচুর সেনা নিহত হয়। অনেক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হতাশ শাহবাজ খান তাঁর বাহিনী নিয়ে তান্ডায় ফিরে যান। তিনি ফিরে যেতেই সাত মাসের যুদ্ধে তিনি যেসব দুর্গ ও শহর জয় করেছিলেন সব আবার ঈসা খানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

ঈসা খান। বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ভুঁইয়া। এবং তিনিই সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ভুঁইয়ারা ছিলেন স্বাধীন শাসক। মোগল আগ্রাসনের মুখে তারাই প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলেছিলেন। তাদের বাধার কারণে ভাটিবাংলা দখল করতে মোগলদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আকবরের আমলে বারো ভুঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান। তিনিই মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আবদুল করিম লিখেছেন, এ সময় নেতাসহ ভুঁইয়াদের মোট সংখ্যা ছিল ১৩ জন। ঈসা খান বাদে অন্য ভুঁইয়ারা ছিলেন, ইবরাহিম নারাল, করিমদাদ মুসাজাই, মজলিশ দিলাওয়ার, মজলিশ প্রতাপ, টিলা গাজি, বাহাদুর গাজি, চাঁদ গাজি, সুলতান গাজি, সেলিম গাজি, কাসিম গাজি, কেদার রায় ও শের খান।

ঈসা খানকে পরাস্ত করতে না পারলে ভাটিবাংলা মোগলদের নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থাকছিল। আবার ঈসা খানকে পরাজিত করাও সহজ ছিল না। তাঁর জমিদারির এলাকায় বছরে ৬ মাস পানি থাকে। এসময় হাওর-বিল, নদী-নালা সবগুলো পানিতে টইটম্বুর থাকে। মোগল সেনাদের জন্য এসকল নৌরুট ছিল বিপদজনক। তারা সবগুলো নৌপথের সাথে পরিচিত ছিল না। কিন্তু প্রতিরোধকারীরা ছিলেন ভাটিবাংলার সন্তান। ফলে তারা যেকোনো নৌপথ বেছে নিয়ে মোগলদের আচমকা আক্রমণ করতে পারতেন।

শাহবাজ খান ফিরে যেতেই ঈসা খান নির্দেশ দিলেন দুর্গগুলোর সংস্কার করতে। এতদিন তিনি অবস্থান করছিলেন কতরাবু এলাকায়। এলাকাটি ছিল নদীর তীরে। যেকোনো সময় এখানে মোগলদের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। এজন্য ঈসা খান নিজের পরিবারের সুরক্ষার জন্য একটি নিরাপদ এলাকা খুঁজছিলেন। খোঁজাখুঁজি করে এমন একটি এলাকা পেয়েও গেলেন। কিশোরগঞ্জ জেলার জংগলবাড়ি এলাকা। এখানে শাসন করছিলেন রামহাজড়া ও লক্ষণহাজড়া। ঈসা খান এখানে আক্রমণ করে এলাকাটি নিজের দখলে নিয়ে আসেন। এখানে মজবুত বাসস্থান নির্মাণ করে পরিবারের লোকজনদের এখানে নিয়ে আসেন। এসময় পুত্র মুসা খানকে তিনি আটিয়া পাঠান।

পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তিনি নৌবাহিনী শক্তিশালী করেন। তার নৌবহর মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, বানার ও শীতলক্ষ্যায় ঘুরে বেড়াত। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে তার রাজ্যসীমা ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা, কুমিল্লার অর্ধেক, সিলেটের অর্ধেক ও ঢাকার উত্তর-পূর্বাংশ।

শাহবাজ খানের ব্যর্থ অভিযানের সংবাদ শুনে সম্রাট আকবর খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েক বছর আকবর বারবার বাংলায় অভিযানের ইচ্ছা করলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মোগল বাহিনীকে এ সময় বিহার ও উড়িষ্যার শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। এসময় যাদেরকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা ভাটিবাংলার দিকে আগানোর সাহস করেননি। ফলে এই সময়টায় ঈসা খান নিরুপদ্রব শাসন পরিচালনা করছিলেন।

১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে মানসিংহকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। এর আগে তিনি ছিলেন বিহারে। সেখানকার বিদ্রোহ দমনে তিনি ছিলেন সফল। ফলে আকবর চাচ্ছিলেন তার মাধ্যমেই বাংলার ভুইয়াদের শায়েস্তা করতে।

৭ নভেম্বর ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ তান্ডা থেকে রাজধানী সরিয়ে রাজমহলে নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে তিনি বারো ভুঁইয়াদের সাথে চুড়ান্ত লড়াইয়ের ঘোষণা দেন।

সে বছর ডিসেম্বরে মানসিংহ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ভাটিবাংলার দিকে রওনা হলেন। তিনি রাজশাহী অতিক্রম করে বগুড়ার শেরপুরে একটি পুরাতন দুর্গ সংস্কার করেন। ইতিমধ্যে বর্ষা শুরু হলে তিনি করতোয়া নদী অতিক্রম করে ঘোড়াঘাট শহরে অবস্থান করেন। সংবাদ পেয়ে ঈসা খান ও মাসুম খান কাবুলি মোগলদের আক্রমণ করার জন্য তাদের বাহিনী নিয়ে ঘোড়াঘাটের বারো ক্রোশের মধ্যে পৌঁছে যান। এই সময়ে দুটি ঘটনা ঘটে। মানসিংহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপরদিকে নদীর পানি দ্রুত কমে যায়। নদীতে নৌযান আটকে যাবে এই আশংকায় ঈসা খান তার বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলেন। ফলে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই মোগলরা ঘোড়াঘাটে অবস্থান করতে থাকে।

রাজা মানসিংহ; Image source: Wikimedia

পরবর্তী দুবছর কোনো পক্ষই শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দের বর্ষাকালে আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। মানসিংহ এবার প্রেরণ করেন তার ছেলে দুর্জন সিংহকে। ৫ সেপ্টেম্বর ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। এই যুদ্ধে মোগলদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। দুর্জন সিংহ নিহত হন। এই যুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল ঢাকার ডেমরা, খিজিরপুর, ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর আশপাশের এলাকা। পুত্রের শোকে শোকাহত মানসিংহ সম্রাট আকবরের কাছে কিছুদিন বিশ্রামের অনুমতি চান। সম্রাট সম্মত হলে মানসিংহ ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে বাংলা ত্যাগ করেন। সম্রাটের আদেশে তার ছেলে জগত সিংকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু যাত্রার শুরুতে আগ্রাতেইও তিনি মারা যান। পরে মানসিংহের পৌত্র মহাসিংহকে বাংলায় পাঠানো হয়। মানসিংহ অবস্থান করছিলেন আজমীরে।

প্রায় তিন দশক ধরে মোগলদের যিনি ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন সেই স্বাধীন শাসক মসনদ-ই-আলা ঈসা খান মারা যান ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। এর কয়েক মাস আগে ১০ মে তারিখে অসুস্থ হয়ে মারা যান তার অন্যতম সেনাপতি মাসুম খান কাবুলি। বছরের পর বছর ধরে শক্তিশালী মোগল বাহিনী যাদের পরাজিত করতে পারেনি জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে তারা পাড়ি জমালেন পরকালের উদ্দেশ্যে। আকবরের দরবারি ঐতিহাসিক আবুল ফজল এই মৃত্যুতে ছিলেন বেশ খুশি। আকবরনামায় আনন্দের সাথে এই তথ্য লিখতে ভুল করেননি তিনি। এখানে বলে রাখা ভাল, মানসিংহের সাথে ঈসা খানের অসিযুদ্ধের যে গল্প শোনা যায় তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তাদের দুজনের কোনো সাক্ষাতই হয়নি কোথাও।

ঈসা খান ও মাসুম খান কাবুলির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভাটিবাংলার প্রতিরোধ সংগ্রামের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সমাপ্ত হয়। যদিও ঈসা খানের মৃত্যুর সাথে সাথেই মোগলরা ভাটিবাংলা অধিকার করতে পারেনি। দখলের জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো এক দশক। ঈসা খানের সুযোগ্য সন্তান মুসা খান পিতার পথ ধরে প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘদিন। শেষে মোগল সুবাদার ইসলাম খানের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন তিনি। (৫)

বর্ষায় এখনো জোয়ানশাহী হাওর জলে টইটম্বুর হয়। পানিতে ভেসে থাকে সবুজ গ্রামগুলো। সাদা জ্যোৎস্নায় মেঘনার পানি চিকচিক করে ওঠে। কে বলবে সাড়ে চারশো বছর আগে এখানেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছিল মোগল আর ঈসা খানের বাহিনী!

লেখকঃ ইমরান রাইহান

টীকা
১। বর্তমানে গাজিপুর জেলার কালিগঞ্জ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
২। বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন।
৩। প্রবন্ধ বিচিত্রা ইতিহাস ও সাহিত্য, পৃ-৩২-৩৪ – আবদুল হক চৌধুরী। বাংলা একাডেমী।
৪। সোনারগাঁ থেকে চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
৫। মসনদ-ই-আলা ঈসা খান- মাহবুব সিদ্দিকী। দিব্যপ্রকাশ।