এশিয়া মহাদেশের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছিল দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনে। সংখ্যালঘু মরো মুসলিমদের সাথে ফিলিপাইন সরকারের দ্বন্দ্ব দেশটিকে খবরের শিরোনাম করেছিল লম্বা একটা সময়ব্যাপী। মরোদের দাবি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ, তাদের নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র কিংবা নিদেনপক্ষে স্বায়ত্তশাসন। ১৯৮৯ সালে তারা সফলও হয়। Autonomous region of muslim mindanao নামের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তুলে মরো মুসলিমরা। যা ২০১৯ সালে হয় Bangsamoro autonomous region of muslim mindanao.

তাদের এই সংগ্রাম নতুন ছিল না। এই সংগ্রামের ছিল সুদীর্ঘ ইতিহাস। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মরো মুসলিমরা জাপানি, স্প্যানিশ, আমেরিকান আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। দখলদারদের সাথে লড়াই সংগ্রাম করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়েছে তাদের। নিজ দেশ ফিলিপাইনের খ্রিস্টানদের সাথে জড়াতে হয়েছে ধর্মযুদ্ধে। মরো মুসলিমদের সাথে খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ আজকের নিবেদন। সাথে উঠে আসবে ফিলিপাইনে মুসলিম আগমনের ঐতিহাসিক সূত্র, মরোদের পরিচয় এবং বর্তমান অবস্থা।

ফিলিপাইন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ। এখানে শতকরা ৯১ ভাগ হচ্ছে খ্রিস্টান, মুসলিম ৫ ভাগ আর মালয় ১.৫ ভাগ, চীনা এবং অন্যান্য ৩ ভাগ। ১২৭৫ সালে আরব বণিক এবং মুসলিম মিশনারীদের মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। ফিলিপাইনের মুসলমানগণ মূলত কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জে বাস করে থাকে। যেগুলোকে বলা হয় autonomous region muslim বা ARM. মোট ৯ টি দ্বীপের সমন্বয়ে দুটি অঞ্চলে ভাগ করে সেখানে বসবাস করে থাকে তারা। অঞ্চল দুটি হচ্ছে মিন্দানাও এবং সুলু দ্বীপপুঞ্জ। দুটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের একত্রে মরো বলা হয়। মিন্দানাও, সুলু ও পালাওয়ান দ্বীপকে মরো মুসলিমরা নিজেদের দেশ বা বাংগসামরো বলে মনে করে। মরো মুসলিমরা নিজেদেরকে বাংগসামরোর মানুষ ভাবতে গর্ববোধ করে।

আমেরিকান সৈন্যরা মোরো যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, Photo Credit: wikimedia

মরো নামকরণ যেভাবে হল 

স্পেন যখন মুসলমানদের কর্তৃত্বে ছিল তখন স্পেনের স্থানীয়রা আরবদের নেতৃত্বে থাকা আফ্রিকান মুসলমানদের মুর নামে অভিহিত করত। ১৪৯২ সালে যখন চূড়ান্তভাবে মুসলিমরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয় তখন পুরো ইউরোপজুড়ে এক থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হয়। নিজেদের দেশ থেকে বহিরগতের বিদায় করে দিয়ে স্পেনের তথা ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে এক নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হয়। তারই সাথে শুরু হয় ক্রুসেডীয় উন্মাদনা। নিজেদের সাফল্যগাঁথা বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্পেনের খ্রিস্টানরা বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে নৌপথে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়ে।এ অভিযানের এক পর্যায়ে ষোড়শ শতকে তারা ফিলিপাইনে এসে পৌছায়। সেখানে এসে তারা কিছু মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল দেখতে পায়। স্পেনীয়ার্ডরা  তখন সেই মুর ‘দের অনুকরণে তাদের মুর নামে আখ্যায়িত করে। প্রথম দিকে ফিলিপানের মুসলিমরা মুর নামটি প্রত্যাখান করে। ১৫৭০ সালে যখন ফিলিপাইনের মুসলিমরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন বিশ্বব্যাপী তাদের সে সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়ে৷ তারো চার শতক পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে ফিলিপাইনে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে মরো মুসলিমদের সশস্ত্র আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে এবং তাদের বীরত্বগাঁথা পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই ‘মরো’ শব্দটি শৌর্যবীর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখন আর ফিলিপাইনের মুসলিমরা নিজেদের মরো বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনা, বরং মরো পরিচয় দিতে তারা এখন গর্ব বোধ করে।

ফিলিপাইনের দ্বীপপুঞ্জে খ্রিস্টানদের আগমন এবং ধর্মযুদ্ধের সূচনা

১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে স্পেন থেকে মুসলিমদের বিতাড়ন করে দেয়ার তিন দশক পর ১৫২১ সালে স্পেনীয়রা ক্রুসেডের উদ্দীপনা নিয়ে খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য লিসবন থেকে রওনা দিয়ে সেনেগাল-মালি অতিক্রম করে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে সাফাল এবং মাদাগাস্কারের মধ্যদিয়ে জাঞ্জিবারে এসে নোংগর গাড়ে। সেখান থেকে তারা ফিলিপাইনের দ্বীপপুঞ্জে এসে উপস্থিত হয়। স্পেন থেকে যে মুর মুসলিমদের বিতাড়ন করতে খ্রিস্টানদের এক দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই মুসলিমদের এখানে দেখতে পেয়ে খ্রিস্টানরা খুব বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। উপরন্তু এখানে মুসলিম সালতানাত দেখতে পেয়ে তাদের অতীত প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠে। সেই বিদ্বেষ আর ক্রোধ থেকে তারা মরো মুসলিমদের আক্রমণ করে বসে। পালটা প্রতিরোধে মাঠে নামে মরো মুসলিমরা। আর এভাবেই শুরু হয়ে যায় মরো মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যকার ধর্মযুদ্ধ। যা মরোদের ভাষায় বলা হয়- পারাং সাবিল বা আল্লাহর পথে যুদ্ধ। ১৫৭০ সালে স্পেনীয়রা রাজা সুলায়মান শাসিত ম্যানিলার জনপদ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। পরে তারা ম্যানিলার নিকটবর্তী আরেকটি মুসলিম প্রদেশও ধ্বংস করে ফেলে। স্পেনীয় খ্রিস্টানরা মুসলিমদের শক্ত ঘাঁটি মিন্দানাও এবং জুলু দ্বীপপুঞ্জ দখলের চেষ্টা চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়। এই দুই ঘাঁটি দখল করতে গিয়ে খ্রিস্টানরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়৷ এভাবে প্রায় তিনশো বছর তারা মরো মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে কিন্তু কাংখিত সাফল্য পেতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়৷ হতাশ খ্রিস্টানরা শেষ পর্যন্ত ১৮৯৮ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে ফিলিপাইনে তাদের বিজিত এলাকা আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করে ১৮৯৯ সালে ফিলিপাইন ত্যাগ করে। আর এরই সাথে দ্বার খুলে খ্রিস্টান-মুসলিম সংঘর্ষের নতুন অধ্যায়। শুরু হয় আমেরিকানদের সাথে মরো মুসলিমদের ধর্মযুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়।

২১ জুলাই ১৯১১, জোলোতে তিনটি মোরো বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, Photo Credit: wikimedia

১৮৯৯ সালে আমেরিকা ফিলিপাইনে এসেই শক্তিশালী মুসলিম সালতানাত সুলু দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করে বসে৷ মরো মুসলিমরা এ আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে প্রতিরোধ আমেরিকার পক্ষে ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত মরো মুসলিমদের উপর আমেরিকানদের পুনঃপুন আক্রমণ অব্যাহত থাকে। যার ফলে ধীরে ধীরে মরো সালতানাত দুর্বল হতে থাকে কিন্তু একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আমেরিকানরা পরবর্তীতে ফিলিপাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার লক্ষ্যে কমনওয়েলথ স্টেটের মর্যাদা দেয় এবং ১৯৪৬ সালে স্বাধীন দেশের মর্যাদা দিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে সুলু দ্বীপপুঞ্জকে ফিলিপাইনের নিকট হস্তান্তর করে দিয়ে যায়৷ এতদ্বসত্বেও মরো মুসলিমদের সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। তখন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল নিজ ফিলিপিনীয় খ্রিস্টানদের রক্তচক্ষু৷ ইতিপূর্বে স্পেনীয় আর আমেরিকানরা মরো মুসলিমদের নিয়ে ফিলিপাইনের খ্রিস্টানদের মনে এক ধরণের হিংসার বীজ রোপণ করে দিতে সক্ষম হয়। সাথে খ্রিস্টানদের অস্ত্র সহায়তা এবং অন্যান্য সহায়তাও প্রদান করে দিয়ে যায়। এতে করে খ্রিস্টানরা মরো মুসলিমদের উপর আগ্রাসী তৎপরতা চালাতে থাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মরো মুসলিমরা এবার Moro liberation front এবং Moro Islamic Liberation front নামের দুইটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের পাল্টা হিসাব নিকাশে মরোরাও খ্রিস্টান জনপদে হামলা চালাতে শুরু করে। ১৯৬০ এর দশকে ফিলিপিনো সরকার ও মরো বিদ্রোহীদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এই সময়ের সংঘর্ষের সবচেয়ে তীব্র ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসের ১৮ তারিখ। সেদিন ৬০ জন ফিলিপিনো মরো মুসলিম কমান্ডার মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যের পূর্বাংশ দখল করার এক অপারেশনে নিহত হয়। এটি জেবিদাহ গণহত্যা নামে পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে ফিলিপিনের খ্রিস্টান শাসকরা উত্তরাঞ্চল থেকে খ্রিস্টানদের ধরে এনে মরো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ছেড়ে দেয়। তবুও দমে যায়নি তারা। তাদের প্রবল প্রতিরোধে শেষপর্যন্ত ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়৷ খ্রিস্টানরা তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে আসে এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব পেশ করে।

২১ জুলাই ১৯১১, জোলোতে তিনটি মোরো বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, Photo Credit: wikimedia

বর্তমান অবস্থা

১৯৭০ সাল থেকে স্বাধীনতার দাবি করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত ফিলিপাইনে প্রায় ১ লাখ মরো মুসলিম নিহত হয়েছে। শেষপর্যন্ত সশস্ত্র দুই সংগঠন সরকারের সাথে সমঝোতা করে অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিলে ফিলিপাইন সরকার মরোদের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি  মাসে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে এক গণভোটের আয়োজন করে। প্রথম দফার এ গণভোটে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে মরোরা স্বতস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। তাই শত বছরের লড়াই আর আত্মত্যাগ একদম বৃথা যেতে দেয়নি মরোরা। হয়তো অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে একদিন স্বাধীন হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে তারা।

তথ্যসূত্র 

সমসাময়িক বিশ্বে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ইতিহাস-অধ্যাপক মোঃ শামছুল আলম