অষ্টম শতকের দিকে ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে উত্থান ঘটেছিল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও দস্যুর দল। ইতিহাসে এরা পরিচিত ভাইকিংস বা নর্থম্যান নামে। যুদ্ধের মাধ্যমে নতুন অঞ্চল দখল করাই ছিল তাদের নেশা। আর এই কাজে তারা ইউরোপের বেশকিছু অঞ্চলে বেশ সাফল্যও লাভ করে। মধ্যযুগের ইউরোপীয় ইতিহাসে ভাইকিংস যুগ নামে পৃথক একটি যুগবিভাজনেরও তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাদের সামরিক প্রতাপের প্রতিক্রিয়ায়। বর্তমান নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল তাদের রাজত্ব। ভাইকিং যুগের গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজা ছিলেন ড্যানিশ কিং হেরাল্ড ব্লুটুথ। নিজ সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষার জন্য ৭৮০ সালে তিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন বেশ কয়েকটি দুর্গ। বৃত্তাকার দুর্গগুলোকে একত্রে বলা হয় ট্রেলোবগ বা রিং দুর্গ। উত্তর ইউরোপে বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে এমন কিছু রিং দুর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে সেগুলো ট্রেলোবগের মত জ্যামিতিক নকশা সমৃদ্ধ নয়। ড্যানিশ সরকার ওয়েস্ট জিল্যান্ড অঞ্চলের কয়েকটি রিং দুর্গকে নতুন করে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে হাজার বছর পুরনো এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হবে।

রিং দুর্গ, ব্লুটুথ ও ভাইকিং ক্যারিশমা

একটি ভাইকিং যুগের রিং দুর্গের একটি শৈল্পিক চিত্র © The dockyards

কেন তৈরি করা হয়েছিল ট্রেলোবগ?

ট্রেলোবগ নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে দুর্গ যেহেতু একটি সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেহেতু পররাষ্ট্র থেকে নিজ রাজ্যের সুরক্ষার ব্যাপারটি দৃশ্যমান হতে পারে। ৯৭৪ সালের দিকে ডেনমার্কের ভাইকিং রাজা হেরাল্ড ব্লুটুথ স্যাক্সনদের কাছে দেনেভির্ক ও দক্ষিণ জুটল্যান্ড অঞ্চল হারান। এর অব্যবহিত পর রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় তিনি গড়ে তুলেন রিং দুর্গ। কিন্তু এই দুর্গগুলো শুধুই দুর্গ ছিল না। আরেকটি মত বলছে, রাজা দ্বিতীয় হেরাল্ডের পিতা সোয়েইন ফোর্কবিয়ার্ড যখন ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন তার পূর্বে সেনাদের প্রস্তুতির জন্য ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো এই ট্রেলোবগ। অনেকে মনে করেন, এই দুর্গগুলো প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। এখনো পর্যন্ত ৭ টি রিং দুর্গের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এর মধ্যে ৫ টি ডেনমার্কে এবং সুইডেন থেকে ২ টি দুর্গ আবিষ্কার করা হয়েছে।

১। আগ্যারসবার্গ রিং দুর্গ

আগ্যারসবার্গ ডেনমার্কের বৃহত্তম রিং দুর্গ। উত্তর ডেনমার্কের আগারসান্ডের কাছে দুর্গটি নির্মাণ করা হয় ৯৮০ সালে। দুর্গটির ভেতরের ব্যাস ২৪০ মিটার। এর সাথে চারটি প্রধান সড়ক আড়াআড়িভাবে ভেতরের কেন্দ্রের সাথে বাইরের বৃত্তাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সংযোগ করেছিল।  প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন আগ্যারসবার্গ দুর্গের ৪৮ টি বাংলোকক্ষে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বসবাস করতে পারতো।

রিং দুর্গ, ব্লুটুথ ও ভাইকিং ক্যারিশমা

কিং হ্যারাল্ড ব্লুটুথ © Wikimedia

২।বোরেরিং দুর্গ

বোরেরিং বা ভাল্লো বোরগ্রিং নামের এই দুর্গটির অবস্থান ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের দক্ষিণপশ্চিমের জিল্যান্ড নামক জায়গায়। বৃত্তাকার দুর্গটি ১৪৫ ব্যাসবিশিষ্ট ও ১০ মিটার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ৯৭০ থেকে ৯৮০ সালের দিকে এই রিং দুর্গটি নির্মাণ করা হয়।

৩। বোরগেবি দুর্গ

এগারো শতকে নির্মিত এই দুর্গটির অবস্থান দক্ষিণ সুইডেনের স্ক্যানিয়াতে। ১৫০ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই দুর্গটিও নির্মিত হয়েছিল হেরাল্ড ব্লুটুথের রাজত্বকালে।

রিং দুর্গ, ব্লুটুথ ও ভাইকিং ক্যারিশমা

ডেনিশ রাজা হ্যারাল্ড “ব্লুটুথ” গোর্মসনের নামের সাথে ১০ শতকের সোনার ডিস্ক © Sandiegouniontribune.com

৪। ফিরক্যাট দুর্গ

ডেনমার্কের উত্তর জুটল্যান্ডের হোব্রোতে এই দুর্গ নির্মাণ করা হয় ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। দুর্গটির অভ্যন্তরীণ ব্যাস ১২০ মিটার। একে ঘিরে আছে টানা দেয়াল ও মাটি দ্বারা ঘিরে রাখা উঁচু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই দুর্গে ১৬ টি লংহাউস (বৃহৎ এককক্ষবিশিষ্ট বাড়ি) বিদ্যমান ছিল।

৫। ট্রেলবার্গ, স্লাগিলসি

প্রাচীন এই দুর্গগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ হচ্ছে ডেনমার্কের দ্বীপ জিল্যান্ডের স্লাগিলসিতে অবস্থিত এই ট্রেলবার্গ দুর্গটি। জ্যামিতিক নকশার দিক থেকে এই দুর্গটি অন্যান্য রিং দুর্গের চেয়ে অনেক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

রিং দুর্গ, ব্লুটুথ ও ভাইকিং ক্যারিশমা

রৌপ্য ভান্ডারের টুকরা যা কিংবদন্তি ডেনিশ রাজা হ্যারাল্ড ব্লুটুথের ছিল, যিনি ডেনমার্কে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে এসেছিলেন এবং যার নাম আধুনিক ব্লুটুথ প্রযুক্তিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। © cbsnews.com