সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির শুটিংয়ের জন্য ভারতবর্ষের কতো জায়গাতেই না ছুটেছেন, শুধু গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন জায়গা খোঁজার জন্য। তিনটি ছবির জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করেছেন — গুপি গাইন বাঘা বাইন, সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথ। বীরভূমের গ্রাম, বেনারসের অলিগলি আর ঘাট, সুদুর পশ্চিম রাজস্থানের মরু অঞ্চল, সিমলার বরফের পাহাড় ••• শুটিং করতে গিয়ে তাঁর যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটাই এখানে ধীরে ধীরে তুলে ধরবো।
পথের পাঁচালি
অপু দূর্গার বাড়ির সামনে মিষ্টিওয়ালা এসেছে, তার কাঁধের বাঁক থেকে মিষ্টির হাঁড়ি ঝুলছে। তাদের মিষ্টি খাবার ইচ্ছা আছে কিন্তু পয়সা নাই তাই দুইভাইবোন সেই ময়রার পিছে পিছে হেঁটে যায়। তিনি ন্যাচারাল ছোঁয়া দেবার জন্য ভাবলেন ওদের পেছনে যদি ভূলো কুকুরটা থাকে তাহলে বেশ হয়, কিন্তু বললেই তো ভূলো ছুটে আসবেনা তাই দূর্গার পিছনদিকে মুঠো করা হাতে আছে সন্দেশ আর সেই সন্দেহের লোভে ভূলো পাকা অভিনেতার মতো দূর্গার পিছন পিছন যাচ্ছে।
গুপি গাইন বাঘা বাইন
বীরভূম শিউড়ির কাছে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে বাঁশ বনে শুটিং হচ্ছে।বাঘা গুপির কথার মাঝে বনে বাঘ দেখা যায়, বাঘ দেখে দুজনে ভয়ে কাঠ। বাঘ কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে অন্যদিকে চলে যায়। এক সার্কাসের সাথে কথা বলে সব ঠিক করা হলো। দুইটা খাঁচায় করে দুইটা বাঘ আনা হয়েছে, একটা যদি ঠিকমতো কাজ না করে তবে অন্যটা দিয়ে কাজ চালাতে হবে। একজন একটা পাঁচ ফুট লম্বা লোহার শিক মাটিতে পুঁতে ফেলেছে তারপর লম্বা সরু লোহার তার একটা শিকের সাথে বেঁধে অন্য দিকটা যে সার্কাসে বাঘের খেলা দেখায় তার প্রিয় বাঘের গলায় পরানো হয়েছে। ক্যামেরা রেডি, খাঁচার দরজা খোলার সাথে সাথে বাঘ লাফ দিয়ে খাঁচা থেকে নেমে প্রচন্ড উল্লাসে লাফ- ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। বাঘের কান্ড দেখে সবাই থ’। তারপর কোনমতে শট নেবার পর আরেক কান্ড, বাঘ আর খাঁচায় ঢুকতে চায়না। পরে দেখা গেল সব শট পন্ড গেছে, ছবি ঠিকমতো আসেনি। আবার শুটিং করা হলো বাঘকে নিয়ে, এবার বোড়াল গ্রামের বাঁশবনে। এবার খাঁচার দরজা খুলতেই বাঘ হুংকার দিয়ে লাফ মেরে শুটিং দেখতে আসা একশো দেড়শো গ্রামবাসীর উপর চড়াও হলো, তারা প্রানভয়ে সব থরথর কম্পমান।তারের কারনে বাঘ গ্রামবাসীদের আক্রমন করতে পারেনি। এবারে কিন্তু বাঘ বাবাজী ঠিকঠাক মতোই শুটিংয়ের কাজ করেছিলেন।
এদিকে গুপি বাঘা ভুতের রাজার তিনটা বর পেয়ে গেছে। ভুতের রাজার জুতো পরে দুজনে দুজনের হাতে হাত মিলিয়ে হাততালি দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারবে। ‘শুন্ডী’ রাজ্যে গানের প্রতিযোগিতা হবে, তাদেরও যাবার সখ কিন্তু তাড়াহুড়ায় নামটা মনে পড়ছেনা তাই গুপি বলে ‘ঝুন্ডী’ আর বাঘা বলে ‘হুন্ডী’। গুপির কথামতো প্রথমে ঝুন্ডীতেই যাওয়া হলো কিন্তু একি !চারিদিকে বরফ, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হাতে তালি দিয়ে গরম কাপড় আনা হলো।তারপর দুজনে কিছুক্ষন ঝগডা করে তারপর হাততালি দিয়ে বাঘার কথামতো ‘হুন্ডী’ গেল কিন্তু এখানে যে বেজায় গরম, চারিদিকে শুধু ধূ ধূ বালি, মরুভূমি। তারা গরম জামা কাপড় সব খুলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো।
হাতে তালি দেবার পর তারা যে শুন্যে উঠে যায় সেটা করতে কিছুটা কারসাজি করা হয়েছিলো। একটা আটফুট উঁচু বাঁশের মাচাতৈরি করে ক্যামেরাটা তার নীচে বসানো হয় তারপর গুপি বাঘাকে মই দিয়ে বাঁশের মাচায় তুলে বলা হয় ঠিক ক্যামেরার সামনে লাফিয়ে পড়তে। পুরা ব্যাপারটা ছবি তোলার সময় ক্যামেরার মধ্যে ফিল্ম চলবে উল্টা দিকে। এই উল্টা তোলা ছবি সোজাভাবে চালালেই পর্দায় সেটা আবার উল্টে গিয়ে দেখা যাবে গুপি বাঘা নিচে না নেমে, নিচে থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। বরফের শুটিং হয়েছিলো সিমলা থেকে আট মাইল দুরে আরো একহাজার ফুট উপরে ‘কুফরি’তে, সেখানে শুধুই বরফ। এখানে লাফালাফির সময় তাদের ভুতের চোখ আঁকা জুতোগুলি বরফের নিচে তলিয়ে যায়, একস্ট্রা জুতো ছিলো বলে রক্ষা।
এবারে যাওয়া যাক ‘হুন্ডী’, এরজন্য যেতে হলো রাজস্থান । তারা বরফের রাজ্য থেকে এখন পড়বে মরুভুমিতে বালির রাজ্যে। কিন্তু বালি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বহু ঘোরাঘুরি করে তারা যখন রীতিমতো হতাশ তখন একটা জায়গা পাওয়া গেলো, মরিচীকাসহ মরুভূমি, শুটিংটা ছিলো দেড় মিনিটের। এই পাঁচ সাত মিনিটের শুটিংয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় ছুটেছেন একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাইতো তিনি সত্যজিৎ রায়। হাল্লা রাজা শুন্ডীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের দৃশ্য ধারন করা হলো রাজস্হানের মরু প্রান্তরে, ঘোড়ার বদলে উট। হাল্লার সৈন্যদের আনা হলো রংদার পাগড়ি, নাগরা, ঢাল- তলোয়ার, তলোয়ারের খাপ, বল্লম, পতাকা। সেনাপতির জন্য বিশেষ ধরনের পোষাক, বর্ম আর শিরস্ত্রান। এব্যাপারে জয়সলমীরের রাজা সাহায্য করেছিলেন।তিনি একহাজার উটের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। শেষে বাঘা ও গুপির ঢোল ও গানে সেই যুদ্ধ বন্ধ হয়। আকাশ থেকে মিষ্টির হাঁড়ি নেমে আসে। এই জায়গাটার একটি অংশে ছিল একাদশ শতাব্দীতে ভাটি রাজপুতদের বানানো একটি কেল্লা।
যুদ্ধের জন্য জন্য উট, সৈন্য রেডি কিন্তু সৈন্যরা তাদের জন্য আনা কাপড় না পরে তাদের নিজস্ব সাদা কাপড় পরে আছে। কারন কি? পরে জানা গেল উটওয়ালারা বেশির ভাই মুসলমান তাই সাদা ছাড়া অন্য রংয়ের কাপড় পরবেনা।পরে তাদের মাঝে গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের রাজি করানো হলো। গুপির গানে মিষ্টির হাঁড়ি পরবে আকাশ থেকে। এখানে দেখা গেলো উটওয়ালাদের মধ্যে যারা হিন্দু আছে তারা বললো, হিন্দু- মুসলমানের হাঁড়ি আলাদা করতে হবে। দুইদল একসঙ্গে এক হাঁড়ি থেকে খাবেনা। হাঁড়ি আলাদা করে দুইভাগ করা হলো—-। সব রেডি, সৈন্যরা হাঁড়ির দিকে ছুটবে তখন দেখা গেলো স্বয়ং মহারাজা জিপ নিয়ে তার মাঝখানে চলে এসেছেন , সাথে আছে রানী আর রাজকন্যা। রাজাকে বুঝিয়ে অন্য জায়গায় বসানোর ব্যাবস্থা করা হলো। বুভুক্ষের মতো মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছুটা আ্যাকটিংয়ের দরকার ছিল তাই সত্যজিৎ রায় তার ইউনিটের কিছু মানুষকে উটওয়ালাদের মতো সাজিয়ে মিষ্টি খেতে লাগিয়ে দেন।