হুমায়ুন আহমেদ তাঁর শৈশবকাল কাটিয়েছেন মহা আনন্দে, পড়ালেখাটা ছিলো ঢিলেঢালা। মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতেন। কখনও কখনও অপরাধ গুরুতর হলে শাস্তিও পেয়েছেন। বাবার পুলিশের চাকরিতে বদলীর সুবাদে ঘুরেছেন বাংলাদেশের ( তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিভিন্ন জেলায়।

এটা যে সময়ের গল্প, তখন তিনি ছিলেন সিলেটের মিরা বাজারে।শৈশবে একটা শিশুশিক্ষা, একটা ধারাপাত, একটা শ্লেট পেন্সিল দিয়ে পড়াশোনা শুরু হতো, পড়ার কোন চাপ ছিলো না। তাঁর বাবা বলতেন, ক্লাশে ফার্স্ট হতে হবে এমন কোন কথা নাই। আর স্কুল তো পালিয়ে যাচ্ছে না,ধীরে সুস্থে ভর্তি করলেই চলবে,শিশুকালটা আনন্দে কাটুক।

বাঁধনহারা দিনগুলি তাঁর আনন্দেই কাটছিলো,কিন্তু হঠাৎ করেই যেন বিনা বজ্রপাত হলো তাঁর জীবনে! কিছু মানুষের কেন জানি মনে হলো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তিনি বাঁদর হয়ে যাচ্ছেন। কাজেই তাঁকে বাঁদর থেকে মানুষ বানানোর জন্য তাঁর মেজো চাচা তাঁকে কিশোরীমোহন স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। হেডমাষ্টারকে বললেন, চোখে চোখে রাখবেন, বড়ই দুষ্টু!

প্রথমদিন স্কুলে গেলেন নতুন খাঁকি রঙের হাফ প্যান্ট পরে, যে প্যান্টের নেই কোন জিপার। তাতে কি যায় আসে, প্যান্ট পরে তিনি আনন্দে আত্মহারা, নতুন প্যান্ট বলে কথা!

পাঠশালায় মেঝেতে পাটি বিছানো,যেহেতু ছেলেমেয়েরা একসাথে পড়ে, তাই মেয়েরা বসে সামনের সারিতে আর ছেলেরা পিছনের সারিতে। ছেলেদের সাথে বসাটা তাঁর পছন্দ হলোনা, তাই সবাইকে ঠেলেঠুলে সামনের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির পাশে বসে পড়লেন। দুঃখের ব্যাপার তখনই হলো, যখন সেই সুন্দরী তাকে সিলেটে ভাষায় বললো, “তুই কি প্যান্ট পরেছিস? ভিতরের সবকিছুই তো দেখা যায়!” ক্লাশসুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। সেই বয়সেই তিনি বুঝে গেলেন, মেয়েদেরকে শারীরিকভাবে আক্রমন করা যাবে না। এই কথায় যে ছেলেটি সবচেয়ে বেশি জোরে হেসেছে…, ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার উপর। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেলো, দেখা গেলে ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙ্গে গেছে!

হেডমাষ্টার তাঁর কান ধরে ক্লাশের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। সবাইকে সাবধান করলেন, এ কিন্তু মহা গুণ্ডা, সবাই সাবধান। পুলিশের ছেলের গুণ্ডা হওয়াই স্বাভাবিক, বলে তিনি পড়ানোতে মন দিলেন।

ক্লাশ ওয়ান দুই ঘণ্টার ক্লাশ, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর তেমন খারাপ লাগলো না। স্কুলের পাশেই আনসার ক্যাম্প, তাদের অণুশীলন দেখে বড়ই আনন্দ পেলেন। ঠিক করলেন বড় হয়ে আনসার হবেন। ক্লাশে দ্বিতীয় দিনেও কানধরার শাস্তি পেলেন মেয়েদের সাথে বসার জন্য। তৃতীয় দিনে ক্লাশের একজনের শ্লেট ভেঙ্গে ফেললেন।যার শ্লেট তার হাত কেটে গেলো, আবার রক্তারক্তি কাণ্ড, আবার কান ধরে দাঁড়াতে হলো।

তিনি ভাগ্যকে মেনে নিলেন.., মানুষ স্কুলে যায় পড়তে আর তিনি স্কুলে যান দুই ঘণ্টা কান ধরে দাঁড়ানোর জন্য! শিক্ষকও বুঝে গেলেন, এই ছেলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেই ভালো, ক্লাশে কোন ঝামেলা হবে না।

ক্লাশ ওয়ানটা তাঁর কেটেছে কেবল কান ধরে দাঁড়িয়ে, অবশ্য তিনি একাই দাঁড়াতেন না। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গী হতো মাথামোটা শংকর, সে ছাড়া তাঁর আর কোন সঙ্গী জুটলো না। মারামারিতে সে হুমায়ুন আহমেদের মতো এতোটা দক্ষ না হলেও, গরিলার মতো আঁ আঁ শব্দ করে পিলে চমকানো শব্দে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। শংকরকে নিয়ে শিশুমহলে চললো তার ত্রাসের রাজত্ব!

ক্লাশ টু তে উঠার পর, যে সুন্দরী মেয়েটি তাঁর হৃদয় হরণ করেছিলো, তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “বড় হয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো?” এই প্রস্তাবে মেয়েটি খুশি তো হলোই না উল্টে বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর উপর। খাঁমচি দিয়ে হাতের কয়েক জায়গার চামড়া উঠিয়ে ফেললো। শিক্ষকের কাছে নালিশ গেল। ফলাফল শুধু কান ধরে দাঁড়ানো নয়,দুই হাতে দুই ইট নিয়ে দুই ঘন্টা নীল ডাইন হয়ে থাকতে হলো।

প্রেমের কারনে প্রেমিকের কঠিন শাস্তি ভোগ করা নতুন কিছু নয়, কিন্তু তাঁর মতো এতো কম বয়সে প্রেমের কারনে এমন শাস্তির নজির মনে হয় আর নাই।

তথ্যসূত্র— আমার ছেলেবেলা লেখক —- হুমায়ুন আহমেদ