ঢাকাইয়া চাচা কাদের সরদারের কাছ থেকে উপহারে পাওয়া ঘড়ি হাতে পরেছিলেন মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বদরুদ্দোজা চৌধুরী , আবদুস সামাদ আজাদের চোখে দেখা সরদারের নির্দেশনায় ঢাকাইয়া মানুষগুলো বাংলা ভাষা রক্ষায় রাজপথে ঝাঁপিয়ে পরা কিংবা মানুষের মুখে মুখে ন্যায় বিচারের গল্প দেখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান তাঁরই মহল্লার সরদারের নামে ‘ কিংবদন্তি এই
মানুষটি মীর্জা আবদুল কাদের সরদার। দেশের ইতিহাস বিনির্মাণের নেপথ্য এই বীরের কথা এভাবেই তুলে ধরছিলেন মঞ্চে উপবিষ্ট কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থের লেখক নাজির হোসেন, আন্তর্জাতিক শিল্প ব্যাক্তিত্ব সাঈদ আহমদ , সভাপতি মহানগর আওয়ামী লীগ মোহাম্মদ হানিফ, শেরেবাংলা পুত্র ফয়জুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইনুদ্দিন খান এবং ঢাকা সমিতির পঞ্চায়েত বিষয়ক সচিব মোহাম্মদ সাখী মিয়া। ঢাকার দিলকুশায় নব্বইয়ের দশকে কাদের সরদার ফাউন্ডেশন ঘোষণা অনুষ্ঠানে এভাবেই স্মরণ করা হয়েছিল এক সময়ে ঢাকার সরদারদের সরদারকে। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা সমিতির তৎকালীন মহাসচিব হাশেম সূফী, কাদের সরদারের একমাত্র সন্তান মীর্জা আবদুল খালেক, বুয়েট ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান, ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখ্শ।
কাদের সরদার ছিলেন বাংলাদেশ নির্মানের নেপথ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশের প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষক। সরাসরি রাজনীতির সাথে না জড়িয়েও মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে মানুষ না খেয়ে দিনযাপন করছিল , মৃত্য ব্যক্তিদের দাফন কাফনে সরকার হিমসিম খাচ্ছে ! এরকম সময়ে এগিয়ে এলেন কাদের সরদার । নিজস্ব অর্থ খরচে গনহারে সম্পন্ন করলেন দুর্ভিক্ষে মৃত মানুষদের দাফনকাফন। বিভিন্ন সময়ে দাঙ্গা পরবর্তী মামলা-মোকদ্দমার কারনে সাধারণ মানুষজন যারপরনাই কষ্টে জীবনযাপন করত। অর্থ কষ্টে পারিবারিক জীবনে নেমে আসত অন্ধকার । এরকম দুর্বিসহ অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় নিজ অর্থ ব্যয়ে হয়রানি হতে মুক্তির জন্য আতাউর রহমান খান , কফিল উদ্দিন চৌধুরী , রেজা-ই-করিম প্রমুখ নামকরা উকিলদের নিয়োগ দিতেন । মীর্জা আবদুল কাদের সরদার ; সরদারদের সরদার ।এখন যেমন মেয়র পদ। প্রাচীন ঢাকা বছরের পর বছর ধরে বেড়ে উঠেছে সরদারদের নেতৃত্বে। নীরবে নিভৃতে ঢাকার জন্য কাজ করে যাওয়া এই সরদারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইসলামপুরের কাদের সরদার। তিনিই উপমহাদেশে প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। লায়ন থিয়েটার তথা সিনেমা হলের মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নেতৃত্বটা তুলে নিয়েছিলেন নিজ হাতে। জন্মে ছিলেন ১৮৭৯ সনে লালবাগ থানার ছোট কাটারার মসজিদওয়ালা বাড়িতে। চলচ্চিত্রের সংগঠক একমাত্র সন্তান মীর্জা আবদুল খালেককে ছেড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৩ সনে। রেখে যান চার ভাতুষ্পুত্র এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি সংস্কৃতিজন নাসির আহমদ , নাজির আহমদ, হামিদুর রাহমান ও সাঈদ আহমদকে।
 
ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখ্শ দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন ঢাকা ও আদি বাসিন্দাদের নিয়ে। সকলের নিকট হয়ে উঠেছেন ঢাকার জীবন্ত তথ্য ভাণ্ডার। কাদের সরদারের অবদান প্রসঙ্গে বলেন কাদের সরদার ছিলেন দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত সমাজসেবক, তৎকালীন সময়ে রাজনীতিবিদদের ভরসার জায়গা। এমনকি মতবিরোধ থাকা সত্তেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নবাবদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশেষজ্ঞ হাশেম সূফী কাদের সরদারের শ্রেষ্ঠত্ব স্মৃতিচারণে বলেন ” কাদের সরদার কোন রাজনৈতিক দলের প্রধান সারির কোন কর্মকর্তা না হয়েও এদেশের অনেক প্রধান সারির রাজনৈতিক থেকেও বেশি অবদান রেখেছেন। রাজনীতিতে নওয়াব সলিমুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন । নওয়াব হাবিবুল্লাহর সহযোগী বন্ধু ছিলেন। আরও উল্লেখ করেন-শেরেবাংলার সাথে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা এমন ছিল যে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এলে কাদের সরদারের ইসলামপুরস্হ দোলেন ভিলায় থাকতেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় শেরেবাংলাকে কেন্দ্র করে ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের মিলন কেন্দ্র ছিল কাদের সরদারের বাসভবন । শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী , আবু হোসেন সরকারসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের পদধূলি পড়াটা কাদের সরদারের বাসভবনে ছিল নিয়মিত ব্যাপার”।
নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এই গুণী মানুষের প্রতি আমাদের উদাসীনতা- দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক এক প্রবন্ধে বলেন ” কাদের সরদার নামটি যে কেন কী করে ঢাকার মানুষ ভুলতে বসেছে । দেশের রাজনীতিতে কেন যে তিনি বিস্মৃত নাম ? এই ব্যাক্তিত্ব ছিলেন বাঙালির পৃষ্ঠপোষকতায় । আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে এক গন্ডা ছেলেমেয়ে পিএইচডি করতে পারত তার ওপরে “।
 
বিস্মৃত সমাজ সেবক, দেশের রাজনীতির নেপথ্য এই ব্যাক্তিত্বের প্রতি নিরন্তর শ্রদ্ধা। দেশে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন যারা জানেন মীর্জা আবদুল কাদের সরদারের সামাজিক কাজ ও দেশের জন্য অসামান্য অবদানের কথা। আমার এই বন্ধু তালিকায় আছেন বিভিন্ন শাখার গুনী মানুষজনরা। কেউ কি একজন পারেন না মীর্জা আবদুল কাদের সরদারের নামটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে ? গুনী এই মানুষটিকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা এবং বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুটি ” মীর্জা আবদুল কাদের সরদার সেতু ” নামকরনে সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। সরদার পরিবারের সদস্যদের নিকট অনুরোধ করছি আপনারা এগিয়ে আসুন। আগে রাষ্ট্র গুনী ব্যাক্তিত্বদের পুরস্কার দিত ; এখন আবেদন করতে হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে এই সম্মান শুধু সময়ের ব্যাপার। স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব
মীর্জা আবদুল কাদের সরদার।