সেই পুরাতন অক্ষরগুলি- ঢাকার নগর ঐতিহ্যের ধারক কিছু বানিজ্যিক সাইনবোর্ড পূর্বকথাঃ সাইন বোর্ড বা নির্দেশকের ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয় তার সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। ৮ম শতকে ইউরোপের সড়কে সরাইখানা ও পানশালার অবস্থান জানানোর জন্য পিপার ছবিযুক্ত সাইন ব্যবহারের প্রমান পাওয়া গেছে। তবে সাইনের ব্যবহার এর আগেও ছিল। প্রাচীনকালে প্রজাদের জন্য তৈরি রাজকীয় নানান দিকনির্দেশনা বড় আকারের বোর্ডে লিখে তা ঘোড়া বা গাধার পিঠে চাপিয়ে পুরো জনপদ ঘোরানো হত। উনিশ শতকের ঢাকায় বানিজ্যিক সাইনের ব্যবহার শুরু হয় মূলত সোনা-রূপার কারিগর দের হাত ধরে। ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে তারা নিজ নিজ দোকানের/ প্রতিষ্ঠানের নামে ছোট ছোট সাইনবোর্ড আঁকিয়ে নিতেন। সাহায্য নিতেন দেয়াল লিখনেরও। তবে এসব সাইনবোর্ডের শৈল্পিক দিকগুলো প্রাথমিক ভাবে উপেক্ষিতই ছিল। সাইনবোর্ডের উৎকর্ষতা আসে ঢাকায় আসা আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।
উনিশ শতকের পুর্ববঙ্গে পাট চাষের সমূহ সম্ভাবনার কারণে বহু আর্মেনীয় ব্যবসায়ী ঢাকা এবং নারায়নগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। পাট ব্যবসার পাশাপাশি আরো কিছু বৃহৎ ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ করেন জি এম শিরকোর, জে এ মিনাস, সি জে মানুক, আনানিয়া প্রমুখ আর্মেনীয় ব্যবসায়ী। ঢাকার বাংলাবাজার, পাটুয়াটুলী, শাঁখারীবাজার এলাকায় তারা চালু করেন ‘ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোর’ জাতীয় ব্যবসা। ‘মেসার্স আনানিয়া এন্ড কোম্পানি’ ছিল ঢাকার মদের দোকান। শাঁখারীবাজারের ‘জি এম শিরকোর এন্ড সন্স’ ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে উনিশ শতকের ঢাকার সবচেয়ে বড় ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোর। এই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ঢাকাবাসী বহু নতুন পণ্যের সাথে পরিচিত হয়। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ঘোড়ার গাড়ি, অপরটি চা। নগরবাসীর কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের বৃহদাকার সাইনবোর্ডগুলো ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বেশীরভাগ সাইন বোর্ডেই কাঠের বড় ও উঁচু হরফে (wooden raised letters) প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকতো। এসময়ে চা এর প্রচারের জন্য অভিনব সব সাইন বোর্ডের ব্যবহার দেখা যায়। টিনের তৈরি এসব হাতে আঁকা সাইনবোর্ডে স্থান পেতো চা এর উপকারিতা নিয়ে নানান তথ্য, এমন কি নানান ছড়াও।
একটি সাইনবোর্ডের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়- উজ্জ্বল হলুদ রঙের এই সাইনবোর্ডের উপরে লেখা ‘গরম চা’, মাঝে চা পানরত ঘোমটা দেয়া এক বধূ, আর একদম নীচে ছড়া “যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ, কিন্তু পান করে চিত্ত পরিতোষ।“ এই সাইনবোর্ডগুলো সাধারণত বসানো হত রেল স্টেশন আর শহরের চৌরাস্তাগুলোয় যেখানে বিনামূল্যে চা খাওয়ানোর সরকারি ব্যবস্থা থাকত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ঢাকার কোতোয়ালি, সুত্রাপুর আর লালবাগ এলাকায় এরকম ‘চা-ওয়ালা’ দেখা যেত। পাকিস্তান আমলে টিনের তৈরি সাইনবোর্ডের পাশাপাশি স্টিলের পাতের উপর সাইন লেখার প্রচলন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিকেন্দ্রিক কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঢাকাতেও ব্যবসা সম্প্রসারন করে। এদের সাইনবোর্ডগুলোতে করাচির সাইনকেই অনুসরণ করা হত, তবে মূল নকশা অক্ষুন্ন রেখে উর্দুর পরিবর্তে বাংলায়/ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হত। এসময় ঢাকায় সাইনবোর্ড লেখার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে; মিল্লাত, চ্যাম্পিয়ন, নেপচুন, এভারগ্রিন, রূপায়ন তাদের অন্যতম। ঢাকাবাসীরা এই পেশাজীবী শ্রেণীকে ‘আর্টিস্ট’ নামেই চিনতেন। এসময়ে তৈরি সাইনবোর্ডগুলো আকারে বেশ বড় হল। অনেক প্রতিষ্ঠানই সন্ধ্যার পর সাইনকে আলোকিত রাখবার জন্য মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের ব্যবহার শুরু করে। প্রথমে মৃদুভাবে জ্বলতে শুরু করলেও অল্পসময়েই পুরো সাইনবোর্ড মার্কারি ল্যাম্পের আলোতে ভেসে যেত। বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যে প্রসারের জন্য নিওন সাইন আসে আরো পরে। দেশ স্বাধীনের পর সাইন তৈরির অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে; এদের কয়েকটির নাম- মুক্তি আর্ট, উত্তরণ, উদয়ন, সাইনেজ ইত্যাদি। সাইনের ধরনেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন।
একসময় যে পুরানো ঢাকায় হাতে আঁকা টিন সাইনবোর্ড ছাড়া আর কোনো ধরনের সাইন দেখা যেতো না, এ যুগে সেখানেই আজ ডিজিটাল প্রিন্টে তৈরি ভিনাইল কিংবা এলইডি সাইনের ছড়াছড়ি। নতুন ঢাকাতে সাইনের রকমফের আরো বেশি- ঝলমলে নিওন সাইন থেকে শুরু করে মেটাল স্ট্রিপ সাইন, চ্যানেল সাইন, কত কি! পুরাতন সাইনবোর্ড নিঃসন্দেহে নগর ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারক। কিন্তু মুশকিল হল- আমাদের এই নগরে শতবর্ষী কোনো বানিজ্যিক সাইনের কি দেখা পাওয়া সম্ভব? পাঠক মাত্রই জানেন – এটা অনেকটাই অসম্ভব। কারণ বিগত একশত বছরে এই ভূখণ্ড তার পরিচয় পাল্টেছে দু’বার- ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ। বহু ব্যবসার মালিকানা বদলেছে, বদলেছে তাদের ধরন। বদল হয়েছে ঠিকানা, আদি স্থাপনা যে ভবনে ছিল তাও হয়তো ভেঙে পড়েছে। বাতিল হয়েছে পুরাতন সাইনবোর্ডগুলো। চমৎকার বাংলা কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে, সাথে হারিয়েছে পুরাতন সাইনবোর্ডে পরম মমতায় আঁকা অপূর্ব সব বাংলা লিখনশৈলী। হারানো কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এখনো হয়তো টিকে আছে এসব মরচেধরা পরিত্যাক্ত সাইনবোর্ডে কিংবা দেয়াল লিখনে। ইসলামপুর সড়কের এক দেয়ালে উৎকীর্ণ সাইন “লায়নে চলিতেছে” আজও তাই পথচলতি মানুষকে নিয়ে যায় তার হারানো সময়ে, যেখানে স্মৃতি হয়ে দিব্যি টিকে আছে আমাদের ‘লায়ন সিনেমা’।