সময়টা ১৬৫৭। মোঘলদের দুর্দান্ত প্রতাপ। ১৫২৬ সালে বাবরের ভারত বিজয়ের মাধ্যমে মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা। ভারতে এসে তারা ভারতকে ভালবেসে ফেলে। পূর্বের অন্যান্যদের মত ভারতের সম্পদ লুট করে তাদের নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যাননি বরং ভারতকে তারা শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে।

মোঘলরা কারা ছিল?

মুঘল রাজবংশ যা ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ৩৩১ বছর ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছিল। মুঘল শাসন আমলে ভারত উপমহাদেশের অর্থনীতি,সংস্কৃতি এক অন্যরকম উঁচু পর্যায়ে উন্নতি লাভ করে।

                                                                 মুঘল সাম্রাজ্যের ম্যাপ

মোঘলরা ছিল মধ্য এশিয়ার অত্যন্ত শিক্ষিত এক মুসলিম জাতি। আব্বাসীয় শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে রেনেঁসা ঘটেছে, সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানরা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। মোঘলরা সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐতিহ্য সাথে করে ভারতে নিয়ে এসেছিল। এছাড়া তাঁরা পূববর্তী হিন্দুদের জ্ঞানের সাথে সন্মিলন ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের জ্ঞান বিজ্ঞানের বিপ্লব ঘটালেন ভারতবর্ষে। বাবরের পর হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, তারপর শাহজাহান সবাই ভারত উপমহাদেশকে সমৃর্দ্ধ করে গেছেন এবং তারপরে দারা শিকোও তার অনবদ্য অবদানের জন্য চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। দারা শিকো ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞান পিপাসু, রোমান্টিক ও ভাবুক এবং ভারতের হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান ঘটানোর রূপকার। তিনি অনুবাদ করলেন হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ‘উপনিষদ’।

Dara Shikoh, an extraordinarily learned and erudite prince, was the first to translate the Upanishads into Persian.

তখন শাহজাহান দিল্লির বাদশাহ। তাঁর ছেলে শাহজাদা দারা শিকো গভীরভাবে বৈদিক ধর্ম গ্রন্থগুলি পড়াশোনা শুরু করেন। সেসময় উপনিষদ পড়ার পর, বারবার বুঝতে চেষ্টা করলেন এর গভীর বিষয়গুলো। তাঁর এই কাজে সাহায্য করতে কবিন্দ্রাচার্য সরস্বতী সহ কয়েকজন পণ্ডিত বেনারস থেকে হাজির হলেন দিল্লী দরবারে। তাদের সাথে তিনি অধ্যায়ন করলেন হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ উপনিষদ। পরবর্তীকালে দারা শিকো ফারসি ভাষায় উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। নাম দেন ‘শির-ই-আকবর’। ইতিহাসের দিকে তাকালে, এমন সহাবস্থানের উদাহরণ আরও অনেক আছে। স্বয়ং মুসলিম রাজপুত্রকে উপনিষদ শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই বেনারস থেকেই পণ্ডিতরা পৌঁছে গিয়েছিলেন দিল্লী। সেখানে আসেনি কোন ধর্মের বাধা-নিষেধ। আজ সেই ভারতে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ফিরোজ খানের বিরুদ্ধে যে বিষেদাগার হচ্ছে, তা সত্যিই কি হিন্দু-মুসলিমের সহাবস্থান বজায় রাখতে পারছে?

কে ফিরোজ খান?

Banaras Hindu University, formerly Central Hindu College, is a public central university located in Varanasi, Uttar Pradesh.

                                                             Banaras Hindu University (File Photo: IANS)

হ্যাঁ, অধ্যাপক ফিরোজ খান সেই ‘মুসলিম’ শিক্ষক, যাকে সংস্কৃত ও ধর্ম পড়ানোর জন্য নিয়োগ করেছিল বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। যিনি সংস্কৃতিতে পড়াশুনা করেছেন এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদে, তাঁকে এই পদ থেকে সরে যেতে হলো। তাদের যুক্তি ছিল যে, কোন মুসলিম শিক্ষক হিন্দুদের সংস্কৃত ও ধর্ম শেখাতে পারেন না। এই পরিস্থিতি, সেই ৩৫০ বছর আগের ইতিহাসগুলোর বৈপরিত্য ঘটিয়ে আমাদেরকে চরম বিশৃংখলার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যেখানে এই দুটি ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছিল না, ছিল পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহাবস্থান ও সম্মানের। তাহলে কি দেখা যাচ্ছে?

সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক মুসলিম হওয়ায় তাঁর নিয়োগ দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ দেখান বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালে পড়ুয়াদের একাংশ।

সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক মুসলিম হওয়ায় তাঁর নিয়োগ দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ দেখান বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালে পড়ুয়াদের একাংশ। Image Source: bangla.tdnworld.com

সম্রাট পুত্রের ডাকে হিন্দু পন্ডিত বেনারস থেকে ছুটে গেলেন এবং শেখালেন। এমনকি শাহজাদা দারা শুধু শিখলেন না, বই অনুবাদও করলেন। সংস্কৃত ভাষা যে শুধু হিন্দুর ভাষা তা বলা যাবে না। আর হিন্দুর ভাষা হলেই যে কেউ তা পড়তে পারবে না, তাও বলা যাবে না। ফিরোজ খানের ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা বৈপিরত্য ঘটতে দেখলাম ১০০ বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে। আজকে তাঁর ইতিহাসও প্রাসঙ্গিক বলেই এখানে উল্লেখ করছি।

কে এই মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ?

বহুভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতীয় উপমহাদেশের স্মরণীয়, বরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অসামান্য দখল ছিল।

একুশের মাসে রাষট্রভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে আমরা স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। তিনি বাংলা ভাষার ওপর উর্দু চাপানোর বিরুদ্ধে জোড়ালোভাবে লড়েছিলেন। বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচ্যের অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলায় ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক করে, মূলভাষায় বেদ অধ্যয়নের স্বপ্ন নিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ কোর্সে ভর্তি হয়েছেন তরুণ শহীদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পণ্ডিত সত্যব্রত সামধ্যায়ী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই ছাত্রকে পড়াবেন না। কারণ, ছাত্রের নাম মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। একজন ‘মুসলমান’ পড়বে বেদ? এত বড়ো কথা! পন্ডিত সত্যব্রতের হয়তো খেয়াল ছিল না, শহিদুল্লাহ সেই ছেলেবেলা থেকেই সংস্কৃত ভাষাটা আয়ত্ত করছেন। মৌলবী সাহেবের কাছে মার খাওয়ার ভয়ে ফার্সি ক্লাসে না বসে, গিয়ে বসতেন সংস্কৃত ক্লাসে। এমনকি সংস্কৃততে রীতিমতো কবিতাও লিখেছেন কিশোর বয়সে। কিন্তু কে শোনে কার কথা ! তবে শহীদুল্লাহ হাল ছাড়লেন না। তিনি বলেন- ‘শাস্ত্রে শুদ্র এবং নারীকে বেদ পড়ানো নিষিদ্ধ বলা আছে। আমি তো নারী নই, শূদ্রও নই, তাহলে আমাকে বেদ পড়াতে আপনার আপত্তি কোথায়?’ তাঁর এই যুক্তি মানেননি অধ্যাপক সত্যব্রত।

 যুবক সময়ে শহীদুল্লাহ

যুবক শহীদুল্লাহ। Image Source: wikipedia

তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলেন। আশুতোষ দেখলেন, এই ছাত্র দমবার পাত্র নই, তাই তিনি শিক্ষক সত্যব্রতকে অনুরোধ করলেন যে, তাকে পড়াতে । তখন সত্যব্রত পাল্টা হুমকি দিলেন, যদি মুসলমানকে বেদ পড়ানো হয়, তিনি কলেজ ছেড়ে চলে যাবেন। তখন পুরো কলকাতায় একটা তুমুল গন্ডোগোলের সৃষ্টি হলো । যারা গোড়া হিন্দু তারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে চলে গেল। তখনকার সমাজে এটাকে কেউই ভালোভাবে দেখলো না। এমনকি এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলো। অধ্যাপককে ঘিরে কঠোর সমালোচনা বের হলো। এই অবস্থায় শহীদুল্লাহর আগের এক শিক্ষক হরিনাথ বললেন, প্রতিহিংসাপরায়ণ শিক্ষকের কাছে তাঁর সংস্কৃত না পড়াই ভালো। সত্যব্রতও তাঁর জায়গা থেকে সরলো না। শেষে স্যার আশুতোষের অনুরোধে শহীদুল্লাহ নতুন ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব’ বিভাগে প্রথম ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন এবং অনার্স শেষ করলেন।

পরে তিনি ধর্মের গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে হাতে কলম ধরেছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণা এবং সাহিত্য চর্চার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘মদন ভস্ম’ নামে তার একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। তাতেও বিপত্তি ঘটলো। কারো মতে, তিনি মুসলমানের বেশে হিন্দু, আর কারো মতে, ‘আপন আচরি’ বাদ দিয়ে পরধর্মে প্রীতি। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক এবং আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯২৮ সালে প্যারিস থেকে পি.এইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮ টি ভাষা জানতেন।

‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ গঠন তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কাজী নজরুল করাচির সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় এসে এই সমিতির অফিস ঘরে উঠেছিলেন। সেসময় নজরুলের বহু লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। দেশভাগের আগে ‘৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করলে। এই মতের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন শহীদুল্লাহ। দ্বিধাহীন ভাষায় তিনি সেদিন লেখেন- ‘দেশে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে সেটা হবে বাংলা। দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলার সঙ্গে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।’ পাকিস্থানীরা বাংলা ভাষা লেখার মধ্যে আরবি ও রোমান হরফ ঢুকাতে চেয়েছিলো, তখন তিনি এর প্রতিবাদ করেন এবং ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান একথা যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য এই যে আমরা বাঙালি।’ এখান থেকে পাকিস্থানীরাও তাকে আর পছন্দ করতো না। তারা তাকে ভারতীয় চর বলতো। কিন্তু কোন বাঁধাই শহীদুল্লাহকে বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে সরাতে পারেনি। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বিভিন্ন সভা-সমিতিতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। একজন প্রকৃত গবেষকের কাছে ভাষার, মানুষের কোন জাত-ধর্ম হয় না। ১৯৬৯ সালে বিভিন্ন ভাষায় অসাধারণ ও অসামান্য দক্ষ পন্ডিত ও জ্ঞানতাপস শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সমাধি

                                                                           ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সমাধি

সবশেষে কথা হলো, এখন বর্তমানে আমরা কি দেখছি? আমরা কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব? আমরা কবে ব্লিওপেট্টা, শহীদুল্লাহর মতো একের বেশি অধিক ভাষা শেখার অধিকার পাবো? তা না পারলে ভবিষ্যৎের সুন্দর পৃথিবী আমরা গড়তে পারবো না।

তথ্যসূত্রঃ
১। গৌতম রায়, ‘আচার্য শহীদুল্লাহ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিবেক।’
২। গোলাম সাকলায়েন, ‘অন্তরঙ্গ আলোকে ড. শহীদুল্লাহ’, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ঢাকা।
৩। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৪। ইন্টারনেট ও নিউজপেপার।